এআই: আপনি কি কোডাকের পথে হাঁটছেন? একটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন 

Published: 20 November 2025

Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA

আজ থেকে মাত্র দু’দশক আগেও ফটোগ্রাফি মানেই ছিল ইয়েলো বক্স। ক্যামেরা নির্মাতা কোডাক (Kodak) তখন ছিল শিল্পের রাজা, বিশ্বজুড়ে ফটোগ্রাফিতে তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত‍্য। কিন্তু সেই কোডাকই একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে গেল, দেউলিয়া হয়ে গেল। এর কারণ কি ছিল তাদের প্রযুক্তির অভাব? মোটেও না। বরং, এক চরম পরিহাসের বিষয় হলো, কোডাকেরই একজন এন্জিনিয়ার  ১৯৭৫ সালে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরার প্রোটোটাইপ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু কোডাক কোম্পানি তাদের সেই সময়ের লাভজনক ফিল্ম ব্যবসাকে বাঁচাতে গিয়ে ভবিষ্যতের জন‍্য লাগসই সেই উদ্ভাবনকে ভয়ে কবর দিয়েছিল। ফলে কী হল? প্রযুক্তি এগিয়ে গেল, আর কোডাক হারিয়ে গেল।

ঠিক তার উল্টো পথে হেঁটেছিল অ্যাডোবি (Adobe)। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) যখন প্রথম আসলো, তখন অ্যাডোবির মূল ব্যবসা (সৃজনশীল সফ্টওয়্যার) সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে গেল। কিন্তু তারা প্রতিরোধ না ক’রে এআই-কে আলিঙ্গন করল, নিজেদের মূল পণ্যের মধ্যেই ‘ফায়ারফ্লাই’ (Firefly) নামে এআই টুল যুক্ত ক’রে দিল। অ্যাডোবি বুঝেছিল, হয় নিজেকে উপযোগী করো, নয়তো বিলীন হয়ে যাও।

আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আমাদের সবার সামনে সেই একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে: আপনি কি কোডাক হবেন, নাকি অ্যাডোবি হবেন? আপনার পেশা, আপনার ব্যবসা, আপনার জীবিকা – সবকিছুই এখন এক নজিরবিহীন পরিবর্তনের মুখে। এআই বিপ্লবের এই মুহূর্তে স্থির হয়ে বসে থাকার উপায় নেই। আপনার দক্ষতা, আপনার প্রতিষ্ঠান ও সব চাইতে বড় কথা আপনার মানসিকতা – সবকিছুই এখন এই ঐতিহাসিক পরীক্ষার মুখে।

কোডাকের মর্মান্তিক  ভুলের গল্পটি আমাদের শিখিয়ে দেয়, কীভাবে অতীতকে আঁকড়ে থাকলে মূল‍্য দিতে হয়, কীভাবে আরামদায়ক বর্তমানের নিরাপত্তা ভবিষ্যতে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে, কীভাবে  সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যেতে হয়। কোডাকের মূল ভুলটি কিন্তু একটি প্রযুক্তিগত ভুল ছিলনা, বরং আমি বলব এটি ছিল  মানসিকতার ভুল! তারা যখন ডিজিটাল ক্যামেরার প্রোটোটাইপ পেল, তখন ম্যানেজমেন্টের চোখ ছিল তাদের সেই সময়ের ২৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ফিল্ম বাজারের দিকে। তাদের মনে হয়েছিল, নতুন এই উদ্ভাবন তাদের বর্তমানের নিশ্চিত লাভকে হুমকির মুখে ফেলবে। তাই তারা সেই সম্ভাবনাকে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিল।

একসময় ফিল্ম ব্যবসা সত্যিই বিশাল লাভজনক ছিল। কিন্তু সেই লাভজনক সময়টা ছিল আসলে ‘অন্ধকারের আগের শেষ আলো’। যখন ডিজিটাল ঢেউ এলো, যখন ক্যামেরা ফোনের ব‍্যবহার শুরু হলো, তখন কোডাকের মূল ব্যবসা রাতারাতি বাষ্পীভূত হয়ে গেল। যে ভবিষ্যতকে তারা নিজেরাই সৃষ্টি করতে পারত, তাকে ভয় পেয়ে প্রত্যাখ্যান করার ফলস্বরূপ মাত্র কয়েক বছরেই তাদের সাম্রাজ্য ধ্বসে পড়ল। তারা প্রযুক্তির অগ্রগতির অনিবার্য গতিকে চিনতে পারেনি। এআই-এর যুগে যারা নিজেদের পুরানো দক্ষতা বা পুরানো কাজের পদ্ধতিকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, তারা অনিবার্যভাবে কোডাকের পথেই হাঁটবে।

অন্যদিকে, অ্যাডোবি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের মূল শিল্প এআই-এর প্রথম শিকারদের মধ্যে অন্যতম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তারা এআই-কে শত্রু হিসেবে দেখেনি, বরং এটিকে লেভারেজ (Leverage) হিসেবে দেখেছিল। যখন জেনারেটিভ এআই-এর (যেমন মিডজার্নি) আবির্ভাব হলো, তখন অ্যাডোবি এটিকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াই না ক’রে, এটিকে তাদের অস্ত্র বানাল। তারা নিজেদের জনপ্রিয় সফটওয়্যারগুলোতে এআই টুল ‘ফায়ারফ্লাই’ যুক্ত করল যার মাধ্যমে তারা তাদের গ্রাহকদের কাছে এই বার্তা দিল – ‘তোমাদের এআই দরকার? আমরাই তোমাদের এআই-চালিত সৃজনশীলতার কেন্দ্র’। ফলে অ্যাডোবি কেবল টিকে থাকেনি, তারা সমৃদ্ধ হয়েছে। নিজেদের পুরানো পদ্ধতিকে নিজেরাই পরিবর্তিত করার এই সাহসের ফলস্বরূপ তারা এআই-এর মাধ্যমে নতুন আয়ের স্রোত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অ‍্যাডোবি আমাদের শিখিয়েছে পরিবর্তিত অবস্থাকে মেনে নিয়ে তার সাথে খাপ খাইয়ে চলার নাম হেরে যাওয়া নয়, তার নাম এগিয়ে চলা।

এই ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকে এবার বর্তমান বাস্তবতায় ফেরা যাক। এআই কেন এত জরুরি? কারণ, এর গতি নজিরবিহীন। বিদ্যুৎ আবিষ্কার হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে বিদ্যুৎ ঘরে ঘরে পৌঁছাতে লেগেছিল ৪৬ বছর, ইন্টারনেটের লেগেছিল ৭ বছর। আর চ্যাটজিপিটি মাত্র ৫ দিনে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এই গতি আমাদের বলে দেয় যে, আপনার চাকরি নাই হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বহু দশক ধরে চলবে – এমন না, বরং মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ঘটে যেতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, সময় বদলাতে সময় লাগেনা।

নিজেকে এই প্রশ্নটি করুন: “এআই কি আমার কাজটি আমার চাইতে দ্রুত, সস্তায় এবং নির্ভুলভাবে করতে পারে? যদি আপনার কাজ হয় পুনরাবৃত্তিমূলক অর্থাৎ প্রতিদিন একই ডেটা এন্ট্রি করা বা নথি প্রক্রিয়াকরণ করা; অথবা অনুমানযোগ্য অর্থাৎ গ্রাহক সহায়তার সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বা ইনভয়েস প্রক্রিয়া করা; অথবা প্যাটার্ন-নির্ভর যেমন হাজার হাজার চুক্তির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ধারা খুঁজে বের করা বা অ্যাকাউন্টিংয়ের সাধারণ শ্রেণিকরণ করার মত হয়, তাহলে এটা মেনে নিন যে আপনার কাজটি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি চাকরি অটোমেশনের কারণে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। আইন, অ্যাকাউন্টিং এবং এমনকি সাংবাদিকতার মতো হোয়াইট কলার চাকরীগুলোও এর বাইরে নয়।

তবে, এআই-এর আগমন মানেই এক্ষুণি এই মুহূর্তেই সব শেষ নয়। টিকে থাকতে হলে আমাদের একটি কর্মপরিকল্পনা (Playbook) অনুসরণ করতে হবে। নিজের দক্ষতা একটু বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী আমাদের কাজের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এমন কী কী এআই টুলস রয়েছে সেগুলো আমাদের শিখতে হবে যাতে আমার সহকর্মীর চাইতে আমি এক ধাপ এগিয়ে থাকতে পারি, আমরা যেন চাকরী ছাঁটাইয়ের প্রথম শিকার না হই। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে এআইকে আমার প্রতিস্থাপক নয়, বরং আপনার সহকারী ক’রে নিতে পারি। ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ‘Audit & Adapt’ আপাতত সেই কাজটিই করতে হবে আমাদের।

এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা না করলে অনেকে আমার লিখাটির ভুল অর্থ ক’রে ফেলতে পরেন। আমি এতক্ষণ যে এআই-এর কথা বলছিলাম তা মূলত Suerper Intelligence AI আসার আগ পর্যন্ত পরিস্থিতির জন‍্যে প্রযোজ‍্য আমাদের করণীয়।

অনেককে বলতে শুনেছি, নতুন কোনো প্রযুক্তি আসলে পুরনো কাজগুলো চলে যায় বটে, তবে তৈরী হয় নতুন নতুন চাকরীর সুযোগ। শিল্প বিপ্লবের কারণে বহু পেশার অবলুপ্তি ঘটেছিল কিন্তু কল কারখানায় নতুন নতুন অনেক চাকরীর সুযোগ আসে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, মোটরযান আবিস্কারের পর অনেক পেশার বিলুপ্তি ঘটলেও অটোমোবাইল এন্জিনিয়ারিং সহ অনেক কাজের সুযোগ হয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। পাথরে পাথর ঘষে আগুন তৈরী করা, চাকা আবিষ্কার করা – সবই ছিল একটি যন্ত্র বা উন্নতমানের প্রযুক্তিগত পদ্ধতি আর এখন আমরা আবিস্কার করছি ‘আবিস্কারক’! Super intelligent AI এসে গেলে তারাই আরো প্রগতিশীল AI তৈরী করতে পারবে, তখন আমাদের আর কিছুই তৈরী করত হবে না এবং তারা যে কী তৈরী করবে তা আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবেনা।

২০২৮ সাল থেকেই মানুষের  প্রায় সব কাজ AGI দ্বারা করানো সম্ভব। এর অর্থ এই নয় যে, ২০২৮ সাল থেকেই সবাই AGI ব‍্যবহার করা শুরু করবে । অনেক সময় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এসে গেলেও সর্বস্তরে বা আপমর জনতা এর ব‍্যবহার করতে একটু সময় নেয়। যেমন ধরুন, ভিডিও ফোন সত্তরের দশকে আবিস্কার করা হয়েছিল কিন্তু আই ফোন আসার আগ পর্যন্ত সবাই এটিকে ‍ব‍্যবহার করেনি। কাজেই আগামী কয়েক বছরে বা এক দশকে আমরা কী কী করতে পরি তা-ই নিয়ে এখন ভাবিনা কেন? আমাদের বাবা মায়েরা ১০/২০ বছরের পরিকল্পনা করতে পারতেন। তাঁদের বাবা মায়েরা হয়তো ৪০/৫০ বছরের পরিকল্পনা করতে পারতেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ৪/৫ বছরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা-ই করতে পারিনা আর আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা থাকবে কেবল অনিশ্চয়তার। কাজেই আমর এই আলোচনা অদূর ভবিষ্যৎকে ঘিরেই।

যেহেতু আমরা আপাতত অদূর ভবিষ্যতের জন‍্যে প্রস্তুতির কথা নিয়ে আলোচনা করছি, তাই চলুন আবার ফিরে যাই সেই কোডাক আর অ‍্যাডোবির গল্পে। আমরা দেখলাম, পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে তাকে আলিঙ্গন করার এই দর্শনই অ্যাডোবিকে আজকের বিজয়ীতে পরিণত করেছে। এটাই বিবর্তন!

প্রযুক্তির অগ্রগতি কিন্তু কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। আপনি বিশ্বের কোন নাম করা বিশ্ব বিদ‍্যালয়ে পড়েছেন; কত বছর লাগিয়ে কত বড় ডিগ্রী অর্জন করেছেন; আপনার পরিশ্রম; আপনার অতীতের সাফল্য – এসব ভেবে  ইগো নিয়ে বসে থেকে বা তৃপ্তির জাবর কেটে কোনো লাভ নেই। এর কোনো কিছুর প্রতিই প্রযুক্তির কোনো আবেগ নেই। প্রযুক্তি কেবল একটি জিনিস-ই বোঝে: আপনি কি এমন ফলাফল এনে দিতে পারেন যা এআই পারেনা?

যে বিখ্যাত উক্তিটি এখানে সবচাইতে বেশী প্রাসঙ্গিক তা হলো, “শক্তিশালী বা বুদ্ধিমানেরা টিকে থাকে না, বরং তারাই টিকে থাকে যারা পরিবর্তনের সাথে সবচাইতে বেশী মানিয়ে নিতে পারে”। ইতিহাস আমাদের বারবার এই শিক্ষাই দিয়েছে। কোডাক চেয়েছিল বর্তমানকে রক্ষা করতে, তাই তারা বিলীন হয়েছে। অ্যাডোবি চেয়েছিল ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করতে, তাই তারা সমৃদ্ধ হয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের। আমরা কি কোডাকের মতো বিলুপ্তির পথে পা বাড়াবো, নাকি অ্যাডোবির মতো নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার ক’রে এই বিপ্লবের অংশ হব? বিবর্তন নাকি বিলুপ্তি?

…………………………….

লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA, MBBS DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক, কলামিস্ট ও পাবলিক স্পীকার।