কমিউনিটিতে আলোচনায় বাংলাদেশ সেন্টার লন্ডন
কমিউনিটিতে আলোচনায় বাংলাদেশ সেন্টার লন্ডন
সভা ডেকে অপদস্ত হলেন হাই কমিশনার!
স্টাফ রিপোর্টার :

বাংলাদেশ সেন্টার লন্ডনের সভা চলাকালীন সময়ে হাই কমিশনার আবিদা ইসলাম অপদস্থ হওয়ার ঘটনা এখন কমিউনিটিতে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোমবারের ঘটনার পর হাই কমিশনার আবিদা ইসলাম মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে তাকে এবং তার অধিনস্ত কর্মকর্তাদের অপদস্থ করার ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) রাতে বাংলাদেশ সেন্টারে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার আবিদা ইসলামের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে তাকে অপদস্থ করার ঘটনা ঘটেছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আবিদা ইসলামকে নিরাপত্তা প্রদান করে। একজন হাই কমিশনারকে ক্যামেরার সামনে অপদস্ত করার বিষয়টি বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য বিব্রতকর ও নিঃসন্দেহে নেতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।
জানা গেছে, সোমবার রাতে উত্তর লন্ডনের কেনসিংটনে বাংলাদেশ সেন্টারের নিজস্ব ভবনে সেন্টারের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ডাকেন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের হাইকমিশনার ও সেন্টারের চেয়ারম্যান আবিদা ইসলাম। সভাস্থলে পৌঁছেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন তিনি।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্রে হাই কমিশনার আবিদা ইসলামকে ঘিরে ধরে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন দেলোয়ার হোসেন ও তার অনুসারিরা। হাই কমিশনার কথা বলতে চাইলেই তাকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন না তারা। এমনকি মিডিয়ার কাছে ইন্টারভিউ দিতে গেলেও তিনি বাঁধার সম্মুখিন হন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বাংলাদেশ সেন্টারে প্রবেশের পরই হাই কমিশনার আবিদা ইসলামের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলী আহমেদ বেবুলসহ কয়েকজন ব্যক্তি। তা রেকর্ড করতে শুরু করেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক।
হাইকমিশনার সভাস্থলে এমন আক্রমনাত্বক কথাবার্তা রেকর্ড করা সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। হট্টগোলের কারণে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চাইলেও তীব্র হট্টগোলের কারনে বক্তব্য দিতে না পেরে সেন্টার ত্যাগ করেন। এ সময় তার সঙ্গে আসা হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার বলয়ের কয়েকজনের তর্ক-বিতর্ক হয়।
ঘটনার প্রায় বিশ মিনিট পর পুলিশের একটি দলের উপস্থিতিতে হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম পুনরায় সেন্টারে ফিরে আসেন এবং দেলোয়ার হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য শোনেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আবিদা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সেন্টারকে ঘিরে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত নিরসনে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
তিনি জানান, আগামী ২৬ নভেম্বর বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সে কারণে সেন্টারে নতুন নির্বাচন আয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে।
সোমবারের ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশ সেন্টারের একাংশের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে হাইকমিশনার আবিদা ইসলামের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচিত কমিটি। আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ না করে হাইকমিশনার কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের সভা ডেকেছেন। পদাধিকারবলে তিনি বাংলাদেশ সেন্টারের চেয়ারম্যান হলেও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁর কোনো ভোটাধিকার নেই। সোমবারের সভা যাতে না হয়, সেই পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি।’ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ২৬ নভেম্বর বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হতে চললেও চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ সেন্টারের এক সাধারণ সভায় সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা কন্ঠভোটে বর্তমান কমিটির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দিয়েছেন। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে হাইকমিশনারের কথায় কোনও নির্বাচন নয়, বরং আমরা কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের সভা ডেকে পরবর্তী করণীয় এবং গঠনতন্ত্র সংশোধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো। তারপর নির্বাচন হবে।
এদিকে অপর পক্ষের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শহীদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ সেন্টারে ব্যবস্থাপনা পরিষদের একটি পুর্ব নির্ধারিত সভা কতিপয় সদস্যদের অসামাজিক কার্যকলাপ বশত বিঘ্নিত হয়। সভার সূচনাতে সেন্টারের চেয়ারপার্সন ও মাননীয় রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামের আগমনের সাথে সাথে অপ্রত্যাশিত ভাবে একদল সাংবাদিক বেপরোয়া ভাবে তাঁকে ঘেরাও করে রাখে এবং নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভায় সাংবাদিকদের অননুমোদিত উপস্থিতি ও তাঁদের এই অপ্রত্যাশিত আচরণের বৈধতা প্রশ্ন সাপেক্ষ। শুধু তাই নয়, ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে মাহবুব আহমেদ, আলী আহমেদ বেবুল, শিব্বির আহমেদ, মামুনুর রশিদ (ভিডিও ফুটেজ অনুকরণে) সহ তাঁর কতিপয় সহযোগী অত্যন্ত অশালীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন এবং সভাস্থলে চরম হাঙ্গামা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন। তাঁদের শিষ্টাচার বহির্ভূত অসামাজিক আচরণ যেমন চিৎকার করে অশ্লীল ভাষায় কথাবার্তা বলা, সভাস্থলের চেয়ার টেবিল গুটিয়ে ফেলা সভা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য ও চেয়ারপার্সনের উপস্থিতিতে সভাস্থলের চেয়ার টেবিল প্রত্যাহার করে নিয়ে চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেন্টারে যে নারকীয় তান্ডব চালিয়ে মহতী উদ্যোগকে নস্যাৎ করা হল তা কেবল মাত্র নিন্দনীয়।
সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন আবিদা ইসলাম : যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার আবিদা ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সোমবার বাংলাদেশ সেন্টারের কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের একটি সভা তিনি আহবান করেন। সেই সভায় বাংলাদেশ সেন্টারের সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যই ছিল এই সভার লক্ষ্য। সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সেন্টারের বার্ষিক সাধারণ সভা দ্রুত আয়োজন করা এবং কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন নিয়ে আলোচনা করা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেন্টারের দ‘ুটি বিবাদমান পক্ষ আছে। এই বিবাদের কারণে সেন্টারের সংবিধান অনুযায়ী ২৬শে নভেম্বর ২০২৩ইং‘র নির্বাচনের পর কোন সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠন হয় নাই। ফলে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে সংবিধান অনুসরণ করে সোমবার সভা আহবান করেন।
আবিদা ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, তিনি যখন সভার জন্য সেন্টারে উপস্থিত হন তখন দেখতে পান একটি পক্ষের স্ব-ঘোষিত সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে উক্ত পক্ষের লোকজনের চরম অসহযোগিতা ও নৈরাজ্য। তিনি বলেন, নির্ধারিত সভা যাতে তারা না করতে পারেন সেজন্য সকল চেয়ার পূর্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের সাথে তাদের কোন বিদ্বেষ নেই। সোমবারের সভাটি ছিল কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের সভা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সাংবাদিকদের পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে রাখা হয়েছিল। যাতে করে তাকে ও তার কর্মকর্তাদের হেনস্তা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারে। যা পরবর্তীতে বাস্তবায়নও হয়েছে। তিনি বলেন, তাদের চরম অসহযোগিতার কারণে তিনি ও তার কর্মকর্তারা সেন্টার ত্যাগ করতে বাধ্য হন। গাড়ীতে উঠার সময়ও তাদের সাথে মারমুখি আচরণ এবং তার একজন কর্মকর্তার উপর গাড়ীর দরজা খুলে আক্রমন করা হয়। ইহাকে তিনি ন্যাক্কারজনক বলে অভিহিত করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আবিদা ইসলাম বলেন, বিগত ২৬শে নভেম্বর ২০২৩ইং তারিখে বাংলাদেশ সেন্টারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেন্টারের সংবিধান অমাণ্য করার ধারাবাহিকতা প্রতিয়মান হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী কাউন্সিল অব মেনেজমেন্ট সেন্টারের চেয়াম্যানের সভাপতিত্বে একটি সভা আহবানের মাধ্যমে কমের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জেনারেল সেক্রেটারীসহ বিভিন্ন পদে মনোনয়ন দেওয়া এবং নতুন নির্বাহী কমিটি বা ইসি আনুষ্ঠানিক ভাবে গঠন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান, ফাউন্ডিং মেম্বার, কর্পোরেটস ফাউন্ডিং মেম্বারস এবং নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী অপর প্যানেলের বিজয়ী সদস্যদের অনুপস্থিতিতে দেলোয়ার হোসেন শুধু তার পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে নির্বাচনের রাতে নিজেই নিজেকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। যা সংবিধান পরিপন্থি। পরবর্তীতে অন্যান্য পদগুলির পাশাপাশি এক্সিকিউটিভ কমিটিতেও যথাযথ কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের মিটিং ছাড়া চেয়ারম্যানের অজ্ঞাতে দেলোয়ার হোসেন ও তার প্যানেল নিজেদের মতো করে নিজেদের লোকদের নিয়োগ দেন।
পরবর্তীতে অন্য প্যানেলেও একই প্রক্রিয়ায় পৃথক এক্সিকিউটিভ কমিটি গঠন করে এবং কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন পদে নিজেদের লোকদেরকে নিয়োগ দেন। এর ফলে কার্যত: দুটি কাউন্সিল ও ম্যানেজমেন্ট বা ইসি গঠিত হয় যা বাংলাদেশ সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনাকে বিপথে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, এই উদ্ভ’দ্ধ বিরোধটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাবে সমাধানের লক্ষ্যে সাবেক হাই কমিশনার ও পদাধিকার বলে সেন্টারের চেয়ারম্যান বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং উভয় পক্ষের সাথে পৃথক ভাবে এবং যৌথ ভাবে বৈঠক করেন। ২৪ এপ্রিল ২০২৪ইং এর সভায় উক্ত উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে বাংলাদেশ সেন্টারে কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চেয়ারম্যান কমিউনিটির ঐতিহাসিক এই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি এবং সুনাম অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে সকল মতবেদ ভূলে একটি সর্বসম্মত কমিটি এবং ইসি গঠনের জন্য উভয় পক্ষকে উদাত্ত আহবান জানান। কমিটি ও ইসি গঠনে কঠিন পরিস্থিতি প্রতিয়মান হওয়ায় চেয়ারম্যান সভার এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে একটি রুদ্ধধার বৈঠকে বসেন। তবে উভয় পক্ষের অনঢ় অবস্থানের কারণে সমস্যা সমাধানে কোন অগ্রগতি হয়নি।
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং হাইকমিশনে পুনরায় একটি বিশেষ সভা করে। সভায় উভয় পক্ষ কমিটি ও ইসি গঠনে নীতিগতভাবে সম্মত হন এবং উভয় পক্ষ ৮ই অক্টোবর একটি বিশেষ সভা আহবানের সম্মতি জ্ঞাপণ করেন। কিন্তু নতুন করে দু‘পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে সভাটি আর আহবান করা হয়নি।
আবিদা ইসলাম বলেন, তিনি যুক্তরাজ্যে যোগদানের পর বিষয়টি নিয়ে উভয় পক্ষের সাথে পৃথক ভাবে মিটিং করেন এবং তাদের বক্তব্য শুনেন। কিন্তু অগ্রগতির কোন লক্ষণ দেখতে পাননি। এর মধ্যে যখন কাউন্সিল অব ম্যানেজন্টের মেয়াদ আগামী ২৬ নভেম্বরের মধ্যে শেষ হতে চলেছে তাই সোমবার কাউন্সিল অব ম্যানেজেমেন্টের সভা আহবান করেন। যেখানে তিনি দ্রুত সেন্টরের এজিএম আহবান এবং কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্টের দ্বি-পাক্ষিক নির্বাচন দ্রুত সম্পন্ন করে সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্ট এবং এক্সিকিউটিভ কমিটি গঠন করে দীর্ঘ দিনের বিবাদ পিছনে ফেলে একটি নতুন ও কার্যকর বাংলাদেশ সেন্টার গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
তিনি বলেন, যারা নতুন কমিটি চান না তারাই সোমবারের মিটিংটি পণ্ড করেছেন।




