মঞ্চায়িত হয়েছে ট্রিওআর্টস এর নাটক জয়ন্তিকা
‘ইতিবাচক চিন্তাভাবনা জীবনে সফলতা আনতে সাহায্য করতে পারে’
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, লন্ডন: ট্রিওআর্টস এর নাটক ‘জয়া’ থেকে ‘জয়ন্তিকা’ হয়ে উঠার গল্প। মাতৃত্বকালীন সময়ে সমস্যায় জর্জরিত মায়েদের ‘টানেলের শেষে যে আলো আছে’ সেই বার্তা ফুটে উঠেছে ‘জয়ন্তিকা’ নাটকে।
‘বেবি ব্লুজ’ বা সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষণ্নতা কী তা অনেকে জানেননা, জন্মদাত্রী নিজেও মেনে নিতে পারেননা, আত্মীয়স্বজন অনেক সময়ে সহানুভূতিশীল না হয়ে সমস্যাকে জটিল করে তোলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে শিক্ষণীয় নান্দনিক নাটক হলো ‘জয়ন্তিকা’।

‘ট্রিওআর্টস’ এর পরিবেশনায় ৩০শে নভেম্বর রবিবার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রদর্শিত হয়েছে নাটক ‘জয়ন্তিকা’। বিকেল পাঁচটায় এবং সন্ধ্যা সাতটায় পর পর দুটি শো প্রদর্শিত হয়েছে এবং প্রতিটি শো-ই ছিল দর্শক পরিপূর্ণ। শায়লা শারমিন এর লেখায় নাট্যরূপ, নৃত্য পরিচালনা ও নির্দেশনায় ছিলেন রুবায়েত শারমিন ঝরা। নাটকের নাম ভূমিকায়ও ঝরা চমৎকার অভিনয় করেছেন।
পরিবারের নিকট আত্মীয়ের নেতিবাচক আচরণ ও জয়ার দুঃসময়ে দর্শক সারিতে ছিল বেদনার ছায়া। পরবর্তীতে পরিচিত জনের সহযোগিতায়, বন্ধু, জীবনসঙ্গী, ডাক্তারের পরামর্শে জয়া চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সফল হয়েছেন। আওয়ার্ড পেয়েছেন। জয়ার ‘জয়ন্তিকা’ মানে বিজয়ী হওয়াতে, কৃতিত্বে দর্শক মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তাঁদের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
নতুন মায়েরা সন্তান জন্মদানের পর প্রথম দিন থেকেই ‘বেবি ব্লুজ’ এর সম্মুখীন হতে পারেন। সাধারণত হরমোনের পরিবর্তনে সৃষ্ট অপ্রীতিকর অনুভূতির কারনে বিষণ্নতা, খিটখিটে মেজাজ, উদ্বেগ, কান্না এবং ঘুমের অসুবিধার মত সমস্যা হয়ে থাকে। সমাজে এটি এখনো এক ধরনের লুকোচুরির বিষয়। যদিও বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জিং, তথাপি প্রসবোত্তর বিষণ্নতা থেকে উত্তরণ সম্ভব, যা নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
নাটকে সকলে ভাল অভিনয় করেছেন। ননদীনির ভূমিকায় রুমি হকের অভিনয় ছিল দারুন। শিশু শিল্পী ইহান শহীদ ও আজান চৌধুরীর অভিনয় ছিল সাবলীল। মাহবুবা লিথি ও কাজী ফারহানা আখতার নাচ, অভিনয় দু’জায়গাতেই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। স্বামীর ভূমিকায় সাদেক আহমেদ চৌধুরী সাদি ও ডাক্তারের ভূমিকায় সাউদ মোহাম্মদ এর অভিনয় দর্শক উপভোগ করেছেন।
এই নাটকটির মাধ্যমে জয়ন্তিকার পরিচালক দেখাতে চেয়েছিলেন যে, দয়া এবং করুণা কীভাবে জীবন বদলে দিতে পারে, বিশেষ করে বেবি ব্লুজ এবং প্রসবোত্তর বিষণ্ণতার প্রেক্ষাপটে। জয়া চরিত্রটি এই বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করেন, যে দয়া এবং ইতিবাচক চিন্তাভাবনা একটি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করতে পারে এবং জীবন উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা অনেক মহিলার জন্য একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ, তবুও এটি প্রায়শই আমাদের সমাজে অকথ্য থেকে যায়। যত্ন এবং সময়ের সাথে সাথে এটি উন্নতি করতে পারে, তবে এটি বিপজ্জনক পর্যায়েও বৃদ্ধি পেতে পারে। এই কঠিন মুহুর্তগুলিতে, মহিলাদের সহানুভূতি, বোধগম্যতা এবং দৃঢ় সমর্থন প্রয়োজন – তাদের পরিবার এবং বৃহত্তর সম্প্রদায় থেকে।
ট্রিওআর্টস ২০১৯ সাল থেকে “এ সিজন অফ বাংলা ড্রামা”- তে অংশ নিয়ে আসছে এবং এই প্রথমবার পরিচালক পাপেট প্রবর্তন করেছেন। পাপেটটি জয়ার অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা নাটকটিকে একটি নতুন এবং অনন্য মাত্রা দেয়।

পরিচালক অনেক প্রক্ষেপণ ব্যবহার না করে একটি সরল এবং সরল মঞ্চ পরিবেশনও বেছে নিয়েছিলেন । নীল আলো, কিছু সাবধানে নির্বাচিত আলোকসজ্জার প্রভাব সহ, বেবি ব্লুজ এবং প্রসবোত্তর বিষণ্ণতার আবেগময় সুর প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়েছিল। তারা সাদা কাগজের পাখিও ব্যবহার করেছে, যা প্রায়শই আশা, আলো এবং নতুন সূচনার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে ।
লেখিকা শায়লা শারমিন বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রাণীদের প্রতি দয়া দেখানোর চেষ্টা করেছেন। নাট্যকার সুদীপ চক্রবর্তী সেই ধারণা প্রকাশের জন্য কাগজের পাখি ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। পরিচালক রুবাইয়াত শারমিন ঝরা দৃশ্যটিকে একটি সহজ কিন্তু অর্থপূর্ণ উপায়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, যা এটিকে আরও বাস্তব এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। এই গল্পের প্রেক্ষাপটে, সাদা পাখিগুলি জয়ার নিরাময় এবং নিজেকে পুনরায় আবিষ্কারের দিকে যাত্রাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে।
এই নাটকের গানগুলি লেখক এবং পরিচালক উভয়ই ভেবেচিন্তে বেছে নিয়েছিলেন। পরিচালক নাটকে একটি choir গানও যুক্ত করেন এদেশের শিশুদের উৎসাহিত করবার উদ্দেশ্যে। গানটি গেয়েছে এহান শহীদ। আরও যোগ করেছেন বুলবুল একাডেমি অফ ফাইন আর্টস ইউকে শাখা এবং ট্রিওআর্টসের শিল্পীদের কয়েকটি নৃত্য পরিবেশনা। এতে অংশ নেন – দেবীনা রায়, কাজী ফারহানা আক্তার, মেহবুবা লিথি এবং রুবাইয়াত শারমিন ঝরা। এই উপাদানগুলি বর্ণনায় রঙ, গভীরতা এবং উষ্ণতা যোগ করেছে।

জয়ার আবেগ এবং ইতিবাচক মানসিকতা তার নিরাময় এবং সাফল্যের দিকে যাত্রাকে পরিচালিত করে। পরিশেষে, এই নাটকটির লক্ষ্য ছিল দর্শকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা, এবং নতুন মায়েদের চাহিদাগুলি প্রতিফলিত করতে উৎসাহিত করা।
৩০শে নভেম্বর ছিল মাসব্যাপী চলা নাট্যোৎসবের সমাপনি দিন। নাট্যপ্রেমীদের আগামী নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষার পালাশুরু হলো। এবারের নাট্যোৎসবের থিম ছিল ‘কাইন্ডনেস’। আগামী বছরের নাটকের থিম নির্ধারিত হয়েছে ‘কিউরিসিটি’।ট্রিওআর্টস আগামীতেও ভাল নাটক উপহার দিবে বলে দর্শকদের আশা।





