অর্ধশতাব্দী পর যে বাংলাদেশ পেলাম আমরা

Published: 4 December 2020

।। ড. আর এম দেবনাথ ।। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এই মাসেই বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয় এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

এ মাসেই আবার বাংলা মাস অগ্রহায়ণ। নতুন ফসল-আমন ঘরে তোলা শুরু হয়েছে। সামনে পৌষ মাস, পৌষ সংক্রান্তি ও পৌষমেলা।

সর্বোপরি চলছে মুজিব শতবর্ষের নানা অনুষ্ঠান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। এতসব ঘটনার মধ্যে বাংলাদেশ এখন আনন্দমুখর, উৎসবমুখর থাকার কথা ছিল। উৎসবমুখর থাকার কথা ছিল আরও একটি কারণে। সামনে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান- ২৬ মার্চ, ২০২১। এতসব অনুষ্ঠান, এতসব উপলক্ষ কত আনন্দময় হওয়ার কথা ছিল। না, সব মাটি করে দিল ‘কোভিড-১৯’ ভাইরাস। সারা বিশ্ব এ মহামারী অতিমারিতে এখন আতঙ্কগ্রস্ত।

চলছে এর মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ। আমরা এর ব্যতিক্রম নই। অবশ্য এরই মধ্যে জীবন আমাদের চলমান। রোগ-শোকের মধ্যেই স্মরণ করতে হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের কথা। সেদিন ছিল মহা-আনন্দ-উল্লাসের দিন, আবার বেদনারও, লাখ লাখ শহীদের রক্তের তখনও তাজা গন্ধ। কতদিনের ঘটনা। মনে হয় সেদিন। কিন্তু দেখতে দেখতে ৪৮-৪৯ বছর চলে গেছে স্বাধীনতার। টেলিভিশনের খবর-ছবি-প্রতিবেদন দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এ সুদীর্ঘ ৪৮-৪৯ বছরের মধ্যে আমাদের অর্জন কী। আমরা কতটুকু এগোতে পেরেছি? সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা-সাহিত্য সবকিছু মিলিয়ে আমরা আজ কোথায় আছি? ভালো কী মন্দ?

চোখ বুজে বলা যায়, ১৯৭১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমাদের অর্জন বিস্ময়কর। আমি পরিসংখ্যানগত অর্থাৎ পরিমাণগত অর্জনের কথা বলছি। দৃশ্যমান জগৎ থেকেই বোঝা যায় আমাদের অর্জন। শহর-গ্রামে অভাবিত পরিবর্তন। প্রথম কথা, মানুষ এখন ভাতে-কাপড়ে আছে। কেউ ভুখা-নাঙ্গা থাকে না। স্বাধীনতার আগে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৮৮ শতাংশ লোক (যুগান্তর ২.১২.১৮), আজ সেই সংখ্যা ২০ শতাংশের নিচে। উত্তরাঞ্চলের মানুষ ভুগত ‘মঙ্গায়’। সেই ‘মঙ্গা’ এখন ইতিহাসের পাতায়। বিগত প্রায় ৫০ বছরে ধান-চালের উৎপাদন প্রায় চারগুণ হয়েছে। অথচ লোকসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।

মানুষ ভাত, কাপড় পাচ্ছে। শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ-ডিমের উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু ভোগও। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার স্বাধীনতার পর থেকে অনেক দিন ছিল ৩-৪-৫ শতাংশ। আজ তা ৮ শতাংশের ওপর। ফলে মাথাপিছু আয় আমাদের বেড়েছে প্রচুর। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। আর তা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২০৭৯ ডলার। স্বাধীনতার পর আমাদের রাজস্ব বাজেটের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা।

আর ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের মোট বাজেটের পরিমাণ ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) পরিমাণ তখন ছিল মাত্র ৫০১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ রেমিটেন্সের পরিমাণ স্বাধীনতার সময় ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৮০ কোটি ডলার। আর আজ তা কত? অবিশ্বাস্য রকমের বৃদ্ধি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছে ১৮ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি)।

আর চলতি অর্থবছরে তা ক্রমাগতভাবে বাড়ছেই। গত নভেম্বর মাসেই এসেছে ২০৭ কোটি ডলার। রিজার্ভে বলতে গেলে কোনো ডলারেই ছিল না।

সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এর পরিমাণ ৪১ বিলিয়ন ডলার (নভেম্বর)। অথচ ২০১৯-এর ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৩২ বিলিয়ন ডলার। ভাবা যায়! এখন ডলারের কোনো অভাব নেই। ৩-৪ মাসের আমদানির জন্য যা দরকার তাহলেই চলে। আর আমাদের আছে ৮-৯ মাসের। অবিশ্বাস্য উন্নতি রিজার্ভে। বিদেশে লেখাপড়া, চিকিৎসা, বেড়ানোর জন্য এখন ডলারের কোনো অভাব নেই। এমনকি আমাদের ব্যবসায়ীরা সরকারিভাবে ডলার বিদেশে নিয়ে ব্যবসা করছেন। এই ডলার আমাদের প্রধান শক্তি ও অর্থনীতির শক্তি। রিজার্ভ কম হলে বিপদ। আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা যায় না। বিদেশিরা দেউলিয়া ভাবে। আমরা এখন ভীষণ শক্তিশালী দেশ।

আমার মনে আছে, স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫টি ডলারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের কাছে আমাকে যেতে হয়েছিল। ডলার ছিল না। সেই তুলনায় আমরা এখন ডলারের মজুদে ভাসছি। স্বাধীনতার পরপর আমাদের ১০০ টাকা দিয়ে ভারতীয় ৩৫-৪০ রুপি পাওয়া যেত। আর আজ? এখন পাওয়া যায় ৮৫-৯০ টাকা। আবার পাকিস্তানিদের অবস্থা আরও খারাপ, তারা ১৫০ রুপি দিয়ে এখন এক ডলার ক্রয় করে।

অথচ তারা স্বাধীনতার আগে বলেছিল, স্বাধীন হলে তোমরা খাবে কী? তোমাদের আছে পাট, চা ও চামড়া। এদিয়ে তোমাদের ‘সংসার’ চলবে না। ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত হবে। একই কথা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট কিসিঞ্জার।

তার কথা : ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’। কী মনে হয় এখন পাকিস্তানি এবং তাদের দোসর কিসিঞ্জারের! অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল এখন আমরা। সর্বত্র আমাদের প্রশংসা। কৃষি, তৈরি পোশাক রফতানি এবং রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি এখন।

শিক্ষা, গড় আয়ু, আমদানি, রফতানি, রিজার্ভ, ডলারের মান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয়ের মতো প্রতিটি সূচকে এখন আমরা পাকিস্তানিদের তুলনায় এগিয়ে। অনেক সামাজিক সূচকে আমরা এখন ভারত থেকেও এগিয়ে। ভারতীয় মিডিয়ায় আমরা এখন আলোচনার বিষয়। বিস্ময়কর উত্থানের কারণ খুঁজছে তারা।

গ্রামাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ রয়েছে। বার্ষিক মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বশেষ পরিমাণ ২৪ হাজার মেগাওয়াট। খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪৫১ লাখ মেট্রিক টন, অর্থাৎ সাড়ে চার কোটি টন। স্বাধীনতার আগে এর পরিমাণ ছিল এক কোটি টনেরও নিচে। এক থেকে দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে চাকরি করে দেশে ডলার পাঠাচ্ছে, ভাবা যায়! এর অর্থ চার থেকে ছয় কোটি লোক এখন রেমিটেন্সের সুবিধাভোগী। যেখানে রেমিটেন্স, সেখানেই ক্যাশের ছড়াছড়ি। ১২-১৫ লাখ হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী। দশ হাজারের ওপর ব্যাংক শাখার সংখ্যা। কমপক্ষে ৫০ হাজার ব্যাংক ম্যানেজার এখন দেশে।

১৫০-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল কলেজ, সাধারণ কলেজের সংখ্যা না গোনাই ভালো। আমাদের সময়ে জেলায় ১-২টা কলেজ ছিল। এখন উপজেলাতেই কয়েকটা কলেজ, এর মধ্যে রয়েছে আলাদাভাবে মহিলা কলেজ। গ্রামের বাজার এখন সপ্তাহে একদিন নয়। প্রতিদিন বাজার দিন-রাত।

রাতের বাজারে দোকান ঝলমল বৈদ্যুতিক বাতিতে। শত শত দোকান। স্বাধীনতার আগে বাজারে এত দোকান ছিল না। দোকান ছিল নদীর পারে। এখন নদী নেই। এখন দোকান-বাজার চৌরাস্তায়। বাংলাদেশে এখন মাকড়সার জালের মতো রাস্তাঘাটের নেটওয়ার্ক, সেজন্য মুহিত সাহেব বলেছিলেন আমাদের রাস্তার দরকার নেই।

দরকার শুধু সংরক্ষণ ও সংস্কার। গ্রামের বাজারে মহিলারা এখন অবলীলাক্রমে বাজার করে, পর্দানশীন মহিলারাও করে। ১০-২০ মাইল ঘুরে বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে মোটরসাইকেলে এখন বাড়ি ফেরা যায় আধা ঘণ্টার মধ্যে। শত শত মোটরসাইকেল। এসব কিস্তিতে পাওয়া যায়। জেলে, কামার, কুমার, তাঁতি ইত্যাদি পেশার লোকজন এখন কর্মচ্যুত। চীনা সস্তার পণ্য এসে এদেরকে কর্মচ্যুত করেছে। তারা নতুন নতুন পেশায় জড়িত হচ্ছে। আসছে ঢাকা শহরে।

বাজারে এখন সব পাওয়া যায়। ঢাকায় আমার কোনো দরকার নেই। মোবাইল ফোন, জামা-কাপড়, জুতো, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে শুরু করে সবই এখন গ্রামের বাজারে ঢাকার দামে পাওয়া যায়। পাইকাররা দোকানে দোকানে মাল নিয়ে আসে। দোকানপাটের ঢাকায় আজ বাবুরহাটে যেতে হয় না। টাকা পরিশোধ হয় বিকাশে- কোনো ঝুঁকি নেই। সোনার দোকান?

স্বাধীনতার আগে গ্রামের বাজারে কর্মকার পোদ্দার শ্রেণির লোকরাই পুরনো সোনা নিয়ে অলঙ্কার বানাত। এখন আলো ঝলমল এয়ারকন্ডিশন্ড সব সোনার দোকান। রেমিটেন্স প্রাপক এবং নব্য ধনীরা এসব দোকানের ক্রেতা। এসব দেখে এখন গ্রাম চেনার, বাজার চেনার আর কোনো উপায় নেই। মনে হয় এসব ছোট ছোট ঢাকা। শুধু চিকিৎসাব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে।

উপজেলা শহরে ডজন ডজন সরকারি অফিস। শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা সবই মিলে এখন উপজেলা শহরকে জমজমাট করে রেখেছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের উপজেলা পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। হাতে হাতে মোবাইল ফোন। মিনিটে মিনিটে খবর। ডাকঘরে ছোট বেলায় দেখেছি ‘টরে টক্কা’ মেশিন যার মাধ্যমে খবর আসে, খবর যায়- টেলিগ্রাম। এখন এসব নেই। চিঠিপত্রের কোনো ব্যাপারই নেই। ডাকঘর উঠে যায়, ডাকপিয়ন কোথায়?

এ এক নতুন বাংলাদেশ। একে চেনার কোনো উপায় নেই। নতুন একটা ধনী শ্রেণির জন্ম হয়েছে। গ্রামের বিচারব্যবস্থা মুরব্বিদের হাত থেকে মাস্তানদের হাতে চলে গেছে। শহর থেকে গিয়ে নব্য ধনীরা গ্রামের দিকে বাগানবাড়ি বানাচ্ছে। এদিকে শহরে ইংরেজির কদর বেড়েছে।

বেড়েছে যুবকদের মধ্যে বিদেশ গমনের প্রবণতা। গ্রামের যুবকরা কাজ করতে চায় না, লেখাপড়া করে না। তাদের গন্তব্য সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ। সেখানে রোজগার বেশি। অল্পদিনের আয়ে বাড়ি পাকা করা যাবে। টিউবওয়েল লাগানো যাবে, পয়োব্যবস্থা করা যাবে। মানুষের কত স্বপ্ন! দেশের উত্তরাঞ্চলে নদী উঠে যাচ্ছে।

পালতোলা নৌকা নেই। মাঝির গান নেই। মাঠে মাঠে গরু-ছাগলও চড়ে না। এদের খাবার এখন বাজারের দোকানে পাওয়া যায়। মাছ-মাংসের জন্য এখন খামার হয়েছে। জেলেরা কর্মচারী হচ্ছে। এ বাংলাদেশ ধন ধান্যে ভরছে। পুষ্পে ভরছে কিনা জানি না। এখন সর্বত্র শুধুু জিডিপি, বিনিয়োগ ইত্যাদির কথা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী কে এসব কথা।

শিল্প-সাহিত্য, খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, লোকগীতি ইত্যাদি এখন পেছনে। এখন মানুষকে পেয়ে বসেছে ভোগবাদিতায়। টাকাই সব। টাকা উড়ছে সর্বত্র।

অফিসের কেরানি, ড্রাইভারের অ্যাকাউন্টেও পাওয়া যায় শত কোটি টাকা! অসম্ভব ব্যাপার। বিস্ময়ের ব্যাপার। যেমন বিস্ময়কর উন্নতি, তেমনি বিস্ময়কর বৈষম্য, কিছু মানুষের বিস্ময়কর সম্পদ। ভালো ও মন্দ মিলিয়েই এখন আমাদের এ বাংলাদেশ।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক