পিএসজিকে হারিয়ে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব বায়ার্নের
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পিএসজিকে ১-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয় বায়ার্ন মিউনিখের। রোববার (২৩ আগস্ট) বাংলাদেশ সময় রাত একটায় উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ২০১৯/২০ মৌসুমের ফাইনালে মুখোমুখি হয় বায়ার্ন মিউনিখ ও প্যারিস সেইন্ট জার্মেই। খেলার ৫৯ মিনিটে সাবেক পিএসজি খেলোয়াড় কিংসলে কোম্যানের করা একমাত্র গোলে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিশ্চিত করে বায়ার্ন।
ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের ফাইনালে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই বধের হাতিয়ার তাদেরই ঘরের খেলোয়াড়। কিংসলে কোম্যানের করা একমাত্র গোলে নেইমার-এমবাপেদের হাতছাড়া হয়েছে ইউরোপের শেষ্ঠত্ব। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ফাইনাল খেলতে লিসবনে নেমেছিল পিএসজি। আর দুর্দান্ত বায়ার্নের সামনে কেবল সুযোগ মিসের মহড়া দিয়েছে নেইমার-এমবাপেরা।
টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত বায়ার্ন শিরোপা জিতল অপরাজিত থেকেই। বায়ার্ন যে রেকর্ড গড়ল তা নেই আর কারোরই। এবারের পুরো টুর্নামেন্টে মোট ১১টি ম্যাচ খেলেছে বায়ার্ন মিউনিখ আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সবগুলো ম্যাচেই শেষ হাসি বাভারিয়ানদের। আর ২০১৩ সালের পর আরও একবার ট্রেবল বাভারিয়ানদের ঘরে। হানসি ফ্লিকের বায়ার্ন লিসবন রাঙিয়েছে লাল রঙে, নেইমার-এমবাপেরা ধূসর হয়ে গেছেন তাদের কাছে।
আর নিজেদের ১১তম ফাইনালে এসে ষষ্ঠ জয় তুলে নিয়ে লিভারপুলের সঙ্গে তৃতীয় সর্বোচ্চ ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব ভাগাভাগি করেছে জার্মান চ্যাম্পিয়নরা। আর এর আগে জার্মান জায়ান্টরা জিতেছিল পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। যার সর্বশেষটি এসেছিল ২০১২/১৩ মৌসুমের ফাইনালে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে।
এবার তাই তো নিজেদের ষষ্ঠ শিরোপার লক্ষ্যেই মাঠে নামে লেভান্ডফস্কি-থমাস মুলাররা। ওদিকে ইউরোপিয়ান সফলতা পাওয়ার লক্ষ্যে কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করা পিএসজির দৌড় থামল ফাইনালে এসেই। নেইমার-এমবাপেদের ভুলের চরম মাশুল গুনল পার্সিয়ানরা। তাই তো ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে গলা মেলানোই যায়, ‘ইউ ক্যান্ট মিস চান্সেস এগেইনস্ট বায়ার্ন।’ অর্থাৎ ‘বায়ার্নের বিপক্ষে এভাবে সুযোগ হাতছাড়া করতে পারো না তোমরা।’
তবে কেবল দোষটা নেইমার কিংবা এমবাপের ওপর চাপালে বড্ড নিষ্ঠুরতা দেখানো হবে ম্যানুয়েল নয়্যারের সঙ্গে। ম্যাচে কিংসলে কোম্যানের গোলে বায়ার্ন জয় পেলেও শেষ পর্যন্ত বাভারিয়ানদের ম্যাচে ধরে রাখার নায়ক নিঃসন্দেহে অধিনায়ক এবং গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার। নেইমার জুনিয়রের সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ান মুহূর্তে জয়ী নয়্যারই। নেইমারের শট দুর্দান্তভাবে ফিরিয়ে দিলে ফিরতি বল আবারও গোলবরাবর শট নেন নেইমার তবে মুহূর্তের মধ্যেই দ্বিতীয় সেভে সাক্ষাৎ গোলের হাত থেকে দলকে রক্ষা করেন নয়্যার।
শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক বায়ার্ন, ম্যাচের আগেই হানসি ফ্লিক বলেছিলেন, ‘পিএসজির বিপক্ষে আমরা খেলার কোনো পরিবর্তন করব না।’ মাঠের খেলাতেও দেখা মিলল ফ্লিকের কথার প্রতিচ্ছবি। ঠিক যেভাবে টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলো খেলেছে বাভারিয়ানরা তার থেকে এক চুলও ব্যতিক্রম শুরু হয়নি ফাইনালেও।
ম্যাচের শুরু থেকেই বাভারিয়ানরা চেপে পিষ্ট করে ফেলতে থাকে পিএসজিকে। আর পিএসজির মধ্যমাঠকে যেন কাচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো ফেলে বায়ার্নের গতি। আর তাতেই পিএসজির আক্রমণভাগের কাছে বলই পৌঁছতে পারছিল না প্যারিসিয়ানরা। তবে এতকিছুর পরেও ম্যাচের ১৯তম মিনিটে কিলিয়ান এমবাপের অসাধারণ এক পাসে বায়ার্নের ডি বক্সে বল পেয়ে যান নেইমার। নেইমারের সামনে কেবল নয়্যার, তাকে হারাতে পারলেই গোল আর সেই সঙ্গে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ প্যারিসিয়ানদের হাতে। তবে নেইমার পারলেন না, অথবা নয়্যার হতে দিলেন না।
দুর্দান্ত সেভে দুই দুইবার নেইমারকে পরাস্থ করলেন আর বাভারিয়ানদের ধরে রাখলেন ম্যাচে। এরপর সুযোগ বায়ার্নের। গোলের কাছ থেকেও ফিরে আসতে হয়েছে লেভান্ডোফস্কিকে। ২২তম মিনিটে লেভার জোরালো শট কেইলর নাভাসকে কাটিয়ে গোল পোস্টের দিকেই যাচ্ছিল তবে সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গোল পোস্ট। পোস্টে লেগে গোল বঞ্চিত লেভা। আর পিএসজিকেও ম্যাচে রাখে ওই গোলপোস্টই।
এরপর ২৪ মিনিটে আবারও সুযোগ প্যারিসিয়ানদের সামনে। লিওনেল পারদেসের কাছ থেকে ডি বক্সের ভেতরে থ্রু পাস পান ডি মারিয়া। আর বল পেয়েই জোরালো শট মারিয়ার, তবে রাখতে পারেননি গোল বরাবর। বল চলে যায় গোল পোস্টের ওপর দিয়ে। ম্যাচের ২৬ মিনিটে পায়ের মাংসপেশিতে টান পড়ে বাভারিয়ান ডিফেন্ডার জেরোমে বোয়েটেংয়ের, আর সাথে সাথেই মাঠ ছাড়েন তিনি।
এরপর সুযোগ আসে বায়ার্নের কাছে, তবে এবার কোস্টারিকান বাজপাখি কেইলর নাভার রুখে দেন লেভান্ডোফস্কিকে। তবে ম্যাচের প্রথমার্ধের সবচেয়ে সহজ সুযোগ পান কিলিয়ান এমবাপে। ডি বক্সের ঠিক মাঝখানে অ্যান্ডের হেরেরার কাছ থেকে বল পান এমবাপে, সামনে কেবল ম্যানুয়েল নয়্যার শটটা একটু বাঁ-দিকে ঘুরিয়ে মারলেই বল জড়ায় জালে। তবে না এমবাপে বলটি যেন নয়্যারের হাতে তুলে দিলেন। আর এমন সহজ সুযোগ মিসের খেসারতও দিতে হলো। প্রথমার্ধ শেষ হলো গোলশূন্যতে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আরো আক্রমণাত্মক বায়ার্ন। বিরতি থেকে ফিরে খেলা তখন গড়িয়েছে মাত্র ১৪ মিনিটের। এর মধ্যেই পিএসজির ডি বক্সের ডান প্রান্ত থেকে জশুয়া কিমিচের দুর্দান্ত এক ক্রস, আর পিএসজির ডান প্রান্ত দিয়ে ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে ডি বক্সের ভেতরে ঢুকে পড়েন কিংসলে কোম্যান। আর লাফিয়ে উঠে কিমিচের ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে বল জালে জড়ান। আর সাবেক এই প্যারিসিয়ানই ভাঙেন প্যারিসের রক্ষণ। ম্যাচের ৫৯ মিনিটে ১-০ গোলের ব্যবধানে এগিয়ে যায় বায়ার্ন।
এরপর ম্যাচের ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে পিএসজি। ম্যাচের ৭১ মিনিটে আবারও বায়ার্নকে রক্ষা করেন নয়্যার। এর মিনিট তিনেক পর ২০ গজ দূর থেকে নেওয়া নেইমারের শট সহজেই রুখে দেন নয়্যার। শেষ দিকে এসে অলআউট এট্যাকে যায় পিএসজি, সুযোগ মিলেছিল কিন্তু সুযোগকে গোলে পরিণত করতে পারেননি চুপো মোটিং। ৮৮ মিনিটে এমবাপের দেওয়া থ্রু বলে পা লাগাতে পারলেই গোল করতে পারতেন চুপো মোটিং। তবে নয়্যার তা হতে দেননি। চুপো মোটিংয়ের বলে পা লাগানোর আগেই লুফে নেন তিনি। আর সেটাই ছিল ম্যাচে ফেরার পিএসজির শেষ সুযোগ।
তবে প্যারিসিয়ানরা পারেননি। অন্যদিকে নিজেদের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফাইনাল জিতে নেয় বাভারিয়ানরা। দুর্দান্ত ফুটবল খেলে ষষ্ঠবারের মতো ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে বায়ার্ন। আর নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ফাইনাল কেবল ফাইনাল হয়ে রইল পিএসজি। আর নেইমার-এমবাপেদের স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল।