কপোত কপোতীর সংসার
হাবীবাহ্ নাসরীন :
সুস্মিতা আর অনিক। বিয়ের আগে পরিচয় ছিল সামান্যই। একরকম প্রস্তাবের মাধ্যমেই বিয়ে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দু’জন মিলে ঘর পাতলেন ঢাকা শহরের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে। সুস্মিতা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। অনিক অফিসে চলে গেলে সারা দিন ঘর গোছানো, টুকিটাকি রান্না করা, একটু পড়াশোনা, একটু ফেসবুকিং আর অনিকের ফেরার জন্য পথ চেয়ে কেটে যায় সুস্মিতার সময়। সন্ধ্যায় অনিক ফিরলে দু’জন মিলে চা কিংবা কফির কাপ হাতে ছোট্ট ব্যালকোনিতে আড্ডা দেয়া। ছুটির বিকেলগুলোয় কাছে কোথাও বেড়িয়ে আসা। একটু-আধটু মনোমালিন্যও হয় কখনও-সখনও। অভিযুক্ত পক্ষ তখন অপরজনের মান ভাঙাতে মরিয়া। সব ভুলে আবার ভালোবাসায় ডুব। যারা বিয়ে করেই নিজের একটি সংসার পেয়েছেন, স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে স্বপ্নের ঘরটিকে সাজিয়ে নিয়েছেন- তাদের ক্ষেত্রে এমন চিত্রই পরিচিত।
বিয়ের পরে একান্ত নিজের একটি সংসার প্রায় সব মেয়েরই প্রত্যাশা। দু’জন মানুষ এক হয়ে অজানাকে জানা বা অচেনাকে চেনা। কপোত-কপোতীর মতো স্বপ্নের সারথী হয়ে পাশাপাশি হেঁটে চলা- এর নামই তো দাম্পত্য! অনেকের ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারে থাকতে হয়, অনেকে আবার নিজের মতো করে সংসার পাততে পারেন। যৌথ পরিবার ভালো নাকি একক পরিবার- সেই তর্কে যাব না। তবে সব জিনিসেরই সুবিধা-অসুবিধা দুটো দিক থাকে। একক পরিবারের সুবিধাগুলো কী?
ধরুন, আপনার আজ রাঁধতে ইচ্ছা করছে না। আপনি চাইলে রান্না না করেও থাকতে পারেন। দু’জন মানুষই তো! অনলাইনে কিছু অর্ডার করে খেয়ে নিলেন বা বাইরে গিয়ে খেয়ে এলেন। এটি তখন খুব স্বাভাবিক মনে হবে। যৌথ পরিবারে আপনি সেই সুবিধা না-ও পেতে পারেন। অনেকজন মানুষ থাকেন বলে রান্নাটা আপনি না হয় না-ই করলেন কিন্তু চাইলেই শুধু দু’জন মিলে খেতে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার। আবার সবার জন্য খাবার কিনে আনাটাও ব্যয়বহুল, অতটা সামর্থ্য বা সুযোগ না-ও থাকতে পারে।
পরিবারগুলোয় বাড়ির ছেলের চেয়ে বউকেই বেশি জবাবদিহি করতে হয়। এমনকি বাড়ির ছেলের কোনো ভুল হলে তার জবাবদিহিও অনেক সময় ছেলের বউকেই করতে হয়। আবার বাইরে যাওয়ার আগে হয়তো বাড়ির বয়স্কদের অনুমতি নিয়ে বের হতে হয়। কিন্তু একক পরিবারে শুধু স্বামীর অনুমতি নিলেই যথেষ্ট।
যৌথ পরিবারে নানাজন, নানা মত। বাড়ির নতুন সদস্যটিকে নিজেদের মতো করে নেয়ার চেষ্টা করেন অনেকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবার ও পরিবেশ থেকে এসে একটি মেয়ে দ্রুত মানিয়ে নিতে হিমশিম খায়। যাদের শ্বশুরবাড়ির মানুষ সমর্থন জোগায়, তারা ভাগ্যবতী সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সৌভাগ্য সবার ক্ষেত্রে না-ও হতে পারে। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে শুধু পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য বউটিকে অনেক সময় অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। যখন নিজের সংসার, একক পরিবার- নানাজনও নেই, নানা মতও নেই। দু’জন দু’জনকে বুঝে চললেই সমস্যা অনেকটা এড়িয়ে চলা যায়।
পরিবার যদি যৌথ হয়, সবার জন্য একটু করে সময় বরাদ্দ করতে গিয়ে বেচারা স্বামীর ভাগ্যে বউয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগও মেলে কম। যখন দু’জনের দেখা হয় তখন হয়তো দু’জনই ক্লান্ত ও শ্রান্ত। গল্প করার ও সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার সুযোগটা মেলে কই! একক পরিবার হলে দু’জন দু’জনকে বোঝাপড়ার যথেষ্ট সময় মেলে, একটু বেশিই মেলে! এ সময়টুকু কাজে লাগাতে পারলে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে কম।
এতসব শুনে একক পরিবারের দিকে ভোট দেয়ার আগে জেনে নিন এর কিছু অসুবিধার কথাও। ধরুন, আপনি একক পরিবারে আছেন। আপনার খুব শরীর খারাপ করল। আপনার সঙ্গী একা সবদিক সামাল দিতে পারছেন না। একদিক দৌড়াচ্ছেন তো, আরেকদিক শূন্য পড়ে থাকছে। এমনটি তো হতেই পারে, তাই না? এমন পরিস্থিতিতে যৌথ পরিবারে হলে অনেকটা চিন্তামুক্ত থাকা যায়। আপনার অসুখ করলেও আরও অনেকজন থাকছেন দেখাশোনা করার বা বাকিটা সামলে নেয়ার।
একক পরিবারে বেশিরভাগ সময় একা থেকে থেকে আপনার একা থাকার স্বভাব গড়ে উঠতে পারে। তখন আপনি চাইলেও সবার সঙ্গে সহজে মিশতে বা হইচই করতে অস্বস্তিবোধ করবেন। কিন্তু যৌথ পরিবারে সারাক্ষণ হই-হুল্লোড়ের মধ্যে থাকলে আপনি আর একা হওয়ার কথা চিন্তা করার সময় পাবেন না!
সংসার আপনাদের দু’জনের। তাই কীভাবে থাকলে আপনারা ভালো থাকবেন, সেই সিদ্ধান্তও আপনাদের। একান্ত নিজের ছোট্ট ঘরে থাকুন কিংবা যৌথ পরিবারে সবার সঙ্গে- সুখে থাকাটিই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে, কপোত-কপোতীর মতো দু’জনকে ভালো রাখার প্রচেষ্টাই তো বিয়ে আর সংসার জীবনের উদ্দেশ্য!