বিশ্বায়ন ও ভবিষ্যৎ

Published: 28 January 2021

।। আবুল কাসেম ফজলুল হক ।।

ইতিহাসে দেখা যায়, বিজ্ঞানের আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও অগ্রগতির সঙ্গে সংগতি রেখে মানুষের নৈতিক চেতনা উন্নত হয় না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়ে গেলেও নৈতিক চেতনা-রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও সামাজিক রীতিনীতি পিছিয়ে থাকে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়ে নতুন প্রযুক্তি যখন ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অঙ্গীভূত হয়, তখন নৈতিক উন্নতির অভাবে আইন-কানুন ও বিধিব্যবস্থা পিছিয়ে থাকার কারণে রাষ্ট্রে, সমাজে মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালীতে বড় রকমের অসংগতি দেখা দেয়। তথ্য-প্রযুক্তি ও জীব-প্রযুক্তির বিপ্লব আর অন্যান্য প্রযুক্তির বিপুল সম্ভার নিয়ে মানবজাতি আজ তেমনি এক অসংগতিতে নিপতিত। এর ফলে সৃষ্ট সংকটের অবসান এবং সুস্থ স্বাভাবিক প্রগতিশীল জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবন প্রণালীতে আজ বড় রকমের পরিবর্তন দরকার। এটা খুবই কল্যাণকর ব্যাপার হবে যদি পৃথিবীর সব জাতির মধ্যে এ নিয়ে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তা-ভাবনা দেখা দেয়।

ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের বিকাশের একপর্যায়ে যাতায়াত ও যোগাযোগ আঞ্চলিক গণ্ডি অতিক্রম করে দেশব্যাপী বিস্তৃত হলে জাতীয়তাবোধ, জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সেটা ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) সমসাময়িক কালের ঘটনা। শিল্প বিপ্লবের ফলেই দেখা দেয় জাতীয়তাবোধ, যা কালক্রমে উন্নীত হয় জাতীয়তাবাদে ও জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। শিল্প বিপ্লবের পটভূমিতে আছে রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, এনলাইটেনমেন্ট ইত্যাদি। ক্রমে দেখা দেয় মিত্রতামূলক কিংবা শত্রুতামূলক আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিকতাবোধ। কার্ল মার্ক্স উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। তবে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে তিনি তাঁর ধারণা যথেষ্ট স্পষ্ট করেননি। এর মধ্যে দেখা দেয়, জাতীয়তাবাদের বিকৃত বিকাশ-উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ। সম্প্রতি তথ্য-প্রযুক্তি ও জীব-প্রযুক্তির বিপ্লব পৃথিবীতে ঘটিয়েছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এর ফলে উদ্ভাবিত হয়েছে বিশ্বায়নের মতবাদ। বিশ্বায়নের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বর্তমান সময়ের নতুন প্রযুক্তি। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জি-সেভেন ইত্যাদি হলো বিশ্বায়নের রূপকার ও কর্তৃপক্ষ।

উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের প্রসার দেখে মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন ও আরো কোনো কোনো দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক ও শিল্পী জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছেন এবং বিশ্বমানবতার ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলেছেন। আমার মনে হয, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদকেই তাঁরা জাতীয়তাবাদ কিংবা জাতীয়তাবাদের অনিবার্য পরিণত মনে করেছেন। জাতীয়তাবাদের উদ্ভব, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁরা ভাবেননি। এর বস্তুগত, আইনগত ও সাংগঠনিক ভিত্তির কথাও তাঁরা ভাবেননি। জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদের স্বাভাবিক বিকাশ ও বিকারের পার্থক্য তাঁরা বুঝতে চাননি। তাঁরা বুঝতে পারেননি যে সভ্যতার ধারা থেকে জাতি ও রাষ্ট্র স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার নয়। রাষ্ট্র ব্যাপারটিকে তাঁরা যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেননি। রাষ্ট্রের মধ্যে তাঁরা শুধু অকল্যাণই দেখেছেন, রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা ও কল্যাণকর ভূমিকা বিবেচনা করেননি। রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে যে উন্নত করা সম্ভব—এটাও তাঁরা ভেবে দেখেননি। রাষ্ট্রের বিকল্প না ভেবেই তাঁরা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন। কখনো কখনো শুধু সরকারকেই মনে করেছেন রাষ্ট্র। এই ধারার চিন্তায় মৌলিক ত্রুটি আছে। জাতীয়তাবাদের সুষ্ঠু বিকাশ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রয়োজন তখনো ছিল, এখনো আছে।

জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে বৃহৎ শক্তিবর্গের বর্তমান বিশ্বায়নের মতবাদের তুলনা করলেই এটা বোঝা যায়। বিশ্বায়নের মতবাদের মাত্র কিছু কথাই ঘোষিত ও প্রকাশ্য, অনেক কথাই অঘোষিত ও গোপন। বৃহৎ শক্তিবর্গ তাদের অনেক অভিসন্ধিই (দুরভিসন্ধি?) বিশ্ববাসীকে জানতে দেয় না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রবল রাষ্ট্রগুলোর আচরণে কার্যকর কূটনীতি আছে। কূটনীতিকে সরলভাবে গ্রহণ করলে প্রতারিত হতে হয়।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির এই কালে বিশ্বব্যবস্থায় ন্যায়, ইনসাফ, জাস্টিস বাড়ালে আর প্রত্যেক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সর্বজনীন কল্যাণে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থায়ও তা করা হলে এবং সামঞ্জস্য বিধান করা হলে পৃথিবীর সর্বত্র প্রত্যেক মানুষ খেয়ে-পরে ভালোভাবে বাঁচতে পারবে। ন্যায় বাড়ালে এবং অন্যায় কমালে পৃথিবীতে এখন একজন মানুষেরও ভাত-কাপড়ের অভাব থাকবে না। কিন্তু অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত বর্তমান বিশ্বায়নের বাস্তবতায় এ ধারার চিন্তা ও কাজ দেখা যাচ্ছে না। আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায়, ফিলিস্তিনে, কাশ্মীরে ও আরো কোনো কোনো ভূভাগে প্রবল শক্তিগুলো পাশবিক উপায়ে যে সশস্ত্র হিংস্রতার প্রকাশ ঘটিয়ে চলছে, তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকতাহীন অকার্যকর প্রতিবাদ জানিয়ে অন্যায়কে মেনে নিয়ে মানবজাতি নৈতিক পতনশীলতার নিশ্চিত প্রমাণ দিয়ে চলছে। বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বড় রকমের অন্যায় ও অসামঞ্জস্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন ভূভাগে নানাভাবে ক্রমাগত সহিংসতা দেখা দিচ্ছে। সামাজিক ও আন্তঃরাষ্ট্রিক অন্যায়ই সহিংসতার ও সন্ত্রাসের মূল কারণ। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শক্তিমান-দুর্বল সব মানুষেরই চিন্তা-ভাবনা ও মানসিকতা আজ বিকারপ্রাপ্ত। বিকৃতবুদ্ধির লোকদের কর্তৃত্ব সর্বত্র। তথ্য-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি। অপব্যবস্থা, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, প্রতারণা, বঞ্চনা ও স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচারে পূর্ণ এই পৃথিবীতে সহিংসতাকে সন্ত্রাস নামে অভিহিত করে, যুদ্ধ ও জুলুম-জবরদস্তি দিয়ে সব কিছু দমন করে রাখার যে কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে, তা দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র আজ সভ্যতা-সংস্কৃতিকে বিশৃঙ্খল ও বিধ্বস্ত করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষের সুস্থ, স্বাভাবিক, সুখী, সুন্দর জীবনযাত্রা আর শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের প্রতিকূল আজকের এই বিশ্বব্যবস্থা। সর্বত্র বর্বরতাকে ভীষণভাবে সক্রিয় ও মনুষ্যত্বকে দারুণভাবে নিষ্ক্রিয় দেখা যাচ্ছে।

দুর্বল রাষ্ট্রগুলো নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে বিকশিত করতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যাপারেই দুর্বল রাষ্ট্রগুলো নিজেরা নিজেদের কল্যাণে নীতিনির্ধারণ করতে পারছে না। বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল নানা কৌশলে দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এনজিওপতিরা এবং সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোর বুদ্ধিজীবীরা সম্পূর্ণ রূপে সক্রিয় আছেন এ ধারায়।

নৈতিক উন্নতির প্রয়োজন সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলেন। কিন্তু সেগুলোর কোনো কার্যকারিতা নেই। ধর্ম সম্পর্কে দুই হাজার বছর আগের রোমান দার্শনিক সেনেকার উক্তি স্মরণযোগ্য : Religion is regarded by the common people as true, by the wise as false, and by the rulers as useful. নৈতিক বিবেচনা সম্পর্কেও এই উক্তি সম্পূর্ণ প্রযোজ্য। নৈতিক বিষয়ে ভালো ভালো কথা বলাকে শাসকরা খুব useful মনে করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারকার্যে তাঁরা সক্রিয় থাকেন; কিন্তু নৈতিক উন্নতির জন্য কিছু করেন না। উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে মানবজাতি বিশ্বায়নের নামে এক সভ্যতার সংকটে নিপতিত। এ সম্পর্কে দুনিয়াব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। ফ্যাসিবাদের গ্রাস থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য রোমা রোঁলা, ম্যাক্সিম গোর্কি ও অঁরি বারবুসের আহ্বানে ১৯৩৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রগতিবাদী লেখকদের সম্মেলনে গড়ে তোলা হয়েছিল International Association of Writers for the Defense of Culture Against Fascism. ওই সংগঠনের ধারাবাহিকতায় সেদিন কলকাতায় গড়ে উঠেছিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ—যার শাখা ঢাকা শহরেও অত্যন্ত সক্রিয় ও কার্যকর ছিল। বর্তমানে বিশ্বায়নের নামে বৃহৎ শক্তিবর্গ সভ্যতার বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিকার ও জনগণের প্রগতির পথ উন্মুক্ত করার জন্য পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আজ গড়ে তোলা দরকার তেমনি একটি সংগঠন। দরকার ওই মনীষীদের বৌদ্ধিক চরিত্রবলের মতো চরিত্রবল। মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখা, শক্তিশালী করার জন্য এবং নৈতিক শক্তিকে পুনর্গঠিত করার জন্য এই ধরনের সংগঠনের প্রয়োজন আজ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে উচ্চশ্রেণির লোকরা মনমানসিকতার দিক দিয়ে পাশবিক হয়ে উঠছে আর অবশিষ্ট শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ বহুমুখী চাপে পিষ্ট হতে হতে প্রাণহীন যন্ত্রের মতো হয়ে যাচ্ছে।

মানুষের মধ্যে দুঃখ-বঞ্চনা, ভয়-ঘৃণা ও অশান্তি সৃষ্টির শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে সম্প্রীতিময়, সুখকর, আশাপ্রদ সমৃদ্ধ সুন্দর অবস্থা সৃষ্টির শক্তিও। মানুষ প্রেমময় ও প্রেমের ভিখারি। মানুষের অন্তর্গত শুভকর শক্তিটিকে আরো ভালো করে কাজে লাগানো হয়নি। তবু যেটুকু হয়েছে তা থেকেই বোঝা যায়, এক উন্নত পৃথিবীতে মানুষের জীবন ও পরিবেশ কত সুন্দর হতে পারে। মানুষ যদি সম্মিলিতভাবে সামাজিক গুণাবলিকে পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত করতে, সেই সঙ্গে পরিবেশকে উন্নত করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে মানুষ এমন এক উচ্চতায় পৌঁছাবে যা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারি না। দারিদ্র্য, ভয়, রোগ-শোক, অন্যায়, অপ্রেম ও নিষ্ঠুরতা লোপ পাবে এবং আশা, সাহস, সম্প্রীতি, সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতিশীলতা অবসান ঘটাবে অন্ধকার রাত্রির। মানুষের জীবন হয়ে উঠবে সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধ-সুন্দর।

বিশ্বব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবনযাপন প্রণালীতে মৌলিক পরিবর্তন সাধন করতে হবে। তার জন্য চিন্তা ও কাজ করতে হবে। যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে উন্নত অবস্থা সৃষ্টির কোনো সংক্ষিপ্ত কিংবা সহজ উপায় নেই। শুধু ছোট কিছুতে মনোযোগী হলে সুফল হবে না, বৃহত্তর বৃহত্তম পরিমণ্ডলের দিকেও দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। গতানুগতিকতা পরিহার করে নতুনভাবে চিন্তা ও কাজ শুরু করতে হবে। শুরুটা আমাদের এই ঢাকা শহর থেকেও হতে পারে।