ফুঁসে উঠেছে মিয়ানমারের সাধারণ জনতা, নিহত ১৪০

Published: 16 March 2021

পোস্ট ডেস্ক : ফুঁসে উঠেছে মিয়ানমারের সাধারণ জনতা। সামরিক জান্তার বন্দুকের নল ঘরে ফেরাতে পারছে না তাদের।

একের পর এক লাশ পড়ছে সেখানে। তাদের গুলিতে রোববার কমপক্ষে ৩৯ জন নিহত হওয়ার পর সোমবার আরো কমপক্ষে ৫ জনকে হত্যা করেছে তারা। এ নিয়ে অভ্যুত্থানের পরে সেখানে সামরিক জান্তার গুলিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় ১৪০। ওদিকে , রোববার চীনের অর্থায়নে পরিচালিত বিপুলসংখ্যক কারখানায় আগুন দেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে চীন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি চীন আহ্বান জানিয়েছে মানুষ ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জেনারেলদেরকে ব্যবস্থা নিতে। চীনের গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের বিনিয়োগ আছে এমন ৩২টি কারখানায় আগুন দেয়া হয়েছে।
ওদিকে, মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তারে চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রতিযোগিতা করে যাওয়া জাপান বলছে, তারা পরিস্থিতির ওপর নজরদারি করছে। এরইমধ্যে হলাইংথায়া, ইয়াঙ্গুনের মতো বড় বড় শহর এবং মান্দালয়ের অংশবিশেষে মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ওদিকে, ঘটনা জানেন এমন দু’টি সূত্র বলেছেন, টালমাটাল এই পরিস্থিতির খবরকে দমিয়ে রাখতে সামরিক জান্তা সারা দেশে মোবাইল ডাটা বন্ধ রাখার জন্য টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডারদের নির্দেশ দিয়েছে। টেলিকম টেলিনর এক বিবৃতিতে বলেছে, মোবাইল ইন্টারনেট ‘অ্যাভেইল্যাবল’ নয়।
ক্ষমতাচ্যুত গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচির সমর্থকরা দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয় এবং পশ্চিমের হাক্কা শহরে বিক্ষোভ করেছেন। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয়েছে মধ্যাঞ্চলীয় মিইঙ্গান, আংলানসহ বিভিন্ন শহরে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, এসব বিক্ষোভে সরাসরি গুলি করেছে পুলিশ। মিইঙ্গানের ১৮ বছর বয়সী একজন বিক্ষোভকারী রোববার বলেছেন, একজন বালিকার মাথায় এবং একটি বালকের মুখে গুলি করা হয়েছে। এখন আমি আত্মগোপনে যাচ্ছি। ওদিকে, মিডিয়া আউটলেট মিয়ানমার নাউ বলছে, ওই শহরে নিহত হয়েছেন ৩ জন। আংলান শহরে নিহত হয়েছেন দু’জন।
পুরো মিয়ানমারে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত সেনাবাহিনী এবং সাধারণ জনতা। রোববার অবহেলিত ও শিল্প এলাকা হলাইংথায়াতে অভ্যুত্থান বিরোধীদের ওপর সরাসরি গুলি করেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। সেখানে চীনা অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন কারখানায় আগুন দেয়ার পর এমন অ্যাকশনে যায় নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এখানেই হত্যা করা হয়েছে ২২ জনকে। অ্যাসিসট্যান্স এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) বলছে, অন্যান্য স্থানে হত্যা করা হয়েছে আরো কমপক্ষে ১৬ বিক্ষোভকারীকে। এর ফলে নির্বাচিত নেত্রী অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সবচেয়ে বেশি রক্তাক্ত দিনের রেকর্ড গড়েছে মিয়ানমার। চীনের দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে, হলাইংথায়াতে গার্মেন্ট কারখানায় যখন আগুন দেয়া হয় তখন চীনা অনেক স্টাফ আহত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে আটকা পড়েন অনেকে। তাই সম্পত্তি এবং নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য মিয়ানমারের জেনারেলদের প্রতি আহ্বান জানায় চীন। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সমর্থক বলে দেখা হয় চীনকে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস বলেছে, চীনের বিনিয়োগ আছে এমন ৩২টি কারখানায় ভাঙচুর ও সহিংস হামলা চালানো হয়েছে। এতে ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ক্ষতি হয়েছে। আহত হয়েছে চীনা দু’জন কর্মচারী।
রোববার কারখানায় হামলার ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজন সাংবাদিক বলেছেন, সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। আমার চোখের সামনে মানুষজনকে গুলি করা হচ্ছে। এই দৃশ্য আমি কখনোই ভুলবো না। উল্লেখ্য, হলাইংথায়া এবং ইয়াঙ্গুনের অন্যান্য স্থানে জারি করা হয়েছে সামরিক শাসন। সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়াদ্দি টেলিভিশন বলেছে, ৪টি গার্মেন্ট এবং একটি সার কারখানায় আগুন দেয়ার পর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা গুলি করেছে। ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া অগ্নিনির্বাপণ ইঞ্জিনকে বাধা দিয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ। হলাইংথায়ার মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে পার্লামেন্টে নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের প্রতিনিধিত্বকারী ডক্টর সাসা।
এ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ভয়ানক বলে বর্ণনা করেছে চীনা দূতাবাস। তবে তারা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছু বলেনি। একইসঙ্গে সহিংস সব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীন। একইসঙ্গে অপরাধীদের আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনতে বলা হয়েছে। মিয়ানমারে অবস্থানরত চীনা জনগণ ও কোম্পানির জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে কারখানায় আগুন দেয়ার দায় স্বীকার করেনি কোনো গ্রুপই। ওদিকে, চীনা দূতাবাসের ফেসবুক পেইজে নেতিবাচক মন্তব্য সয়লাব। এতে ব্যবহার করা হয়েছে মিয়ানমারের ভাষা। ২৯ হাজারের উপরে মন্তব্যে ব্যবহার করা হয়েছে হাসিমুখের ইমোজি।
সামরিক জান্তা ১লা ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসনে বসে। সুচিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। তাকে কোথায়, কি পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছে, এখনো তা পরিষ্কার নয়। ওই অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে সেনারা। গতকাল সোমবার আরেকবার শুনানিতে ভার্চ্যুয়ালি আদালতে হাজির করার কথা ছিল সুচিকে। কিন্তু তার আইনজীবী খিন মুয়াং জাওয়া বলেছেন, দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে ভিডিও ম্যাসেজভিত্তিক ওই শুনানি করা যায়নি। সুচির মামলার পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ২৪শে মার্চ। তার বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বেআইনিভাবে ওয়াকিটকি আমদানি করা, করোনাভাইরাস প্রোটকল ভঙ্গ করা। গত সপ্তাহে তার বিরুদ্ধে বেআইনি লেনদেনের অভিযোগ যুক্ত হয়েছে এই তালিকায়। সুচির আইনজীবী খিন মুয়াং জাওয়া বলেছেন, আটক সুচির প্রতিনিধিত্ব করতে অনুমতি দেয়া হয়েছে জুনিয়র মাত্র দু’জন আইনজীবীকে।
অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। তারা সুচির মুক্তি দাবি জানিয়েছে। নিন্দা প্রকাশ করেছে সহিংসতার। এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো সহিংসতার অবসানে- সমাধানে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু বাইরের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের দীর্ঘ রেকর্ড আছে মিয়ানমারের। মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারী টম অ্যানড্রু জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, মিয়ানমারকে অর্থ ও সামরিক অস্ত্রের যোগান না দিতে। তিনি এক টুইটে বলেছেন, জান্তা নেতারা ক্ষমতার অধিকারী নন। তারা জেলখানার অধিকারী। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে মিয়ানমার সেনবানাহিনীর সঙ্গে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে মিয়ানমারের সবচেয়ে প্রাচীন জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহী গ্রুপ কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। তারাও রোববারের সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ সমর্থন প্রকাশ করেছে তারা।