ইফতার ও সেহরিতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার: কিছু পরামর্শ

Published: 25 April 2021

।। ডা. ইসমাইল আজহারি ।।


রোজায় আমাদের সুস্থতা থাকার জন্য সুষম খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যেই পরিমাণ খাবার প্রয়োজন হয় তাকে ব্যালেন্স ডায়েট বলে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রায় ২০০০-২৫০০ ক্যালরি সমপরিমাণ খাবার গ্রহণ করতে হয়। তবে রোজার সময় ১০০০ থেকে ১৫০০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ যথেষ্ট।

কারণ রোজায় অল্প খাবার গ্রহণ করলেই অটোফ্যাজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের ক্ষতিকর কোষসমূহ পরিষ্কার হয়। তাই অন্যান্য সময় যেই পরিমাণ খাবার খাওয়া যায় রোজায় তার চেয়ে এক তৃতীয়াংশ কম খেতে হবে।

আমাদের ক্যালরিজেনিক খাবারগুলি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত ।
১. কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার যথা, চাল, আটা, ময়দা, আলু, ছোলা বুট, খেজুর, ফলমুল ইত্যাদি এক গ্রাম শর্করা থেকে ৪ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়।

২. প্রোটিন তথা আমিষজাত খাবার। যথা-মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, ইত্যাদি।এক গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়।

৩. ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার, বা তৈলাক্ত খাবার। এক গ্রাম ফ্যাট থেকে ৯ ক্যালরি পাওয়া যায়।

নরমাল ব্যালেন্স ডায়েটের মধ্যে খাবারবে অনুপাত হচ্ছে,
কার্বোহাইড্রেট : প্রোটিন : ফ্যাট= ৪ঃ১ঃ১

আরো সহজে দৈনিক খাবারের
৬৫% হবে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা (ভাত, মুরি, রুটি, আলু, খেজুর, কলা, ছোলা ভুট, অন্যান্য ফলমুল )

২৫% হবে প্রোটিন বা আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম)

১০% ফ্যাট (তৈল)

রোজার সময় ১৫০০ ক্যালরি পেতে হলে

৬৫% শর্করা , তথা ৯৭৫ ক্যালরি গ্রহণ করা উচিত।
২৫০ গ্রাম শর্করা জাতীয় খাবার। ৬০ গ্রাম প্রোটিন জাতীয় খাবার
৩০ গ্রাম স্নেহদ্রাব্য খাবার।

ইফতারী আর ডিনার মিলিয়ে ৬০০-৭০০ ক্যালরি খেতে হবে আর সেহরিতে ৬০০-৭০০ ক্যালরি। আর যারা ওজন কমাতে চান তারা ইফতারিতে ৩০০ ক্যালরি খাবেন, সেহরিতে ৩০০ ক্যালরি পরিমান , সঙ্গে ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার ও পর্যাপ্ত ফাইবার জাতীয় খাবার যেনো খাওয়া যায়৷
এবার আসুন জেনে নিই ইফতারি ও সেহরিতে কি কি খেতে হবে আর কি কি পরিহার কর‍তে হবে:

ইফতারিতে খাবার তালিকা-
ইফতারিতে ৬০০ ক্যালরি পেতে হলে যা খেতে হবে.
১. খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। খেজুর শর্করা জাতীয় খাবারের মধ্যে অন্যতম। খেজুরের মধ্যে শর্করা ছাড়াও প্রায় সব ধরনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদান রয়েছে, ৪টা মাঝারি (৩৫ গ্রাম) খেজুরের মধ্যে প্রায় ১০০ ক্যালরি রয়েছে। তাই ইফতারিতে ৪-৫ টা খেজুর খাওয়া যেতে পারে।

২. ফলমূলের মধ্যে ইফতারিতে কলা অন্যতম একটা কলায় প্রায় ১০৫ ক্যালরি রয়েছে তাই ইফতারির তালিকায় ১ টা করে কলা খাওয়া যেতে পারে।

৩. ছোলা বুট খাওয়া যেতে পারে। ৫০ গ্রাম ছোলা বুটের মধ্যে প্রায় ১৮০ ক্যালরি রয়েছে। ছোলাবুট অল্প পরিমান খাবে ২০-২৫ গ্রাম এর চেয়ে বেশি না খাওয়াই ভালো। কারণ এটা পরিপাক হতে দীর্ঘ সময় লাগে।

৪. একটা ডিম খাওয়া যেতে পারে, একটা ডিমের মধ্যে ৮০ ক্যালরি রয়েছে।

৫। অন্যান্য ফলমূল খাওয়া যেতে পারে যথা তরমুজ, আপেল, কমলা এইসব পানিশূন্যতা রোধে অনেক উপকারী।

৬. ডাবের পানি, ইসুপগুলের ভুসি, লেবুর শরবত ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এইগুলি পানিশূন্যতা রোধে অনেক উপকারী।

ইফতারিতে যা পরিহার করা উচিত

১. ইফতারিতে অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার কিংবা তেলে ডুবিয়ে যেইসব খাবার তৈরি করা হয় যেমন: পেঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, চিকেন ফ্রাই, জিলাপি ইত্যাদি যতটুকু সম্ভব পরিহার করতে হবে।কারণ এই খাবারগুলি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তৈরি করে।

২.একসঙ্গে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলা যাবে না। অনেকে ইফতারিতে বসেই খেতে খেতে ইসোফেগাস তথা গলবিল পর্যন্ত খেয়ে ফেলে তা কখনোই করা যাবে না।

৩। টক জাতীয় ফলে যদিও প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে তথাপি টক জাতীয় ফলে সাইট্রিক এসিডও থাকে। তাই রোজার সময় টক ফল সাবধানতার সঙ্গে খেতে হবে। ভাল হয় রাতের খাবার শেষ করে খেলে। কারণ সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ খাবারগুলি এসিডিটির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। তাই সতর্কতা অবলম্বন দরকার।

৪। টমেটো ইফতারির সময় অনেকের প্রিয় খাবার তবে টমেটোতে প্রচুর পরিমাণ সাইট্রিক এসিড ও ম্যালিক এসিড থাকে এবং এটা পাকস্থলীতে ইরিটেশন করে তাই টমেটো বেশী পরিমাণ না খাওয়াই উত্তম।

৫। ঝাল খাবার পাকস্থলীতে এসিডিটির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তাই কাঁচামরিচ কিংবা অতিরিক্ত ঝাল খাবার পরিহার করে চলতে হবে।

৬। গরম খাবার যথা চা, কফি ইত্যাদি পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ক্ষরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় তাই রোজার সময় চা, কফি ইত্যাদি পরিহার করে চলা উচিত।

রাতের খাবারে যা খাবেন

প্রথমত ইফতারিতে যেই খাবারগুলির কথা বলা হয়েছে, সেইগুলি খেলে পরে ডিনার করা প্রয়োজন হয়না তারপরেও যদি কারো বেশি ক্ষিধে লাগে তবে সে এক কাপ পরিমাণ ভাত সঙ্গে মাছ-ডিম আর ডাল সবজি খেতে পারে। অবশ্যই একটা লাইট মিল হতে হবে। অতিরিক্ত খাবার বর্জনীয়। ইফতার করলে পরবর্তীতে তারাবির নামাজের পরে একটু ক্ষিধে লাগা স্বাভাবিক। তখন অনেক বেশি খেতে মন চায় কিন্ত তখন হালকা ২-৩ টা খেজুর খেলেই ক্ষিধে চলে যাবে। তাই তখন অনেক ভারি খাবারের কোনো দরকার নাই। কারণ এই ক্ষুধা বেশিক্ষণ থাকবে না। ৩০ মিনিট সহ্য করলে এমনিতেই এই ক্ষুধা চলে যাবে।

সেহরির সময় যা করণীয়

ফজর নামাজের সময় হবার আগ পর্যন্ত সেহরি করা যায়।রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেরিতে সেহরি করার কথা বলেছেন। এটা সুন্নাত, এই সুন্নাত পালনের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে। দেরিতে সেহরি করার জন্য এই কারণে বলা হয়েছে যেনো সেহরি করে ফজর নামাজ এর প্রস্তুতি নেওয়া যায় আর ফজর নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে যে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগবে তা খাবার পরিপাকে সহায়তা করে।

যদি কেউ ফজরের সময় হবার ১-২ ঘন্টা আগে সেহরি করে তাহলে সে তো আর সেহরি শেষ করে ২ ঘন্টা বসে থাকবেনা বরং শুয়ে পরবে আর খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে যাওয়া এসিডিটির অন্যতম কারণ। তাই দেরিতে সেহরি করা সুন্নাত আর সেহরি করে নামাজ পড়ে তারপর ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্যও উত্তম।

সেহরির খাবার হবে:
ভাত, মাছ/মুরগী, ডাল সবজি ইত্যাদি, খুব বেশিও না আবার খুব কম ও না।২ কাপ পরিমান (১০০গ্রাম) ভাত, সঙ্গে ১ পিস মাছ/মুরগী, ডাল সবজি হলেই যথেষ্ট। সম্ভব হলে এক দুইটা খেজুর।

অতিরিক্ত ঝাল খাবার, চর্বি জাতীয় খাবার, কিংবা তেলে ভাজা খাবার সেহরিতে খাবে না।

সেহরি শেষ করে সম্ভব হলে ৩-৪ চামচ ইসবগুলের ভুষি দিয়ে এক গ্লাস শরবত গুলে খেতে পারেন।
কারণ ফাইবার জাতীয় খাবারের মধ্যে ইসবগুলের ভূষি অন্যতম। এটা শরীরের মধ্যে পানি ধরে রাখে এবং দিনের বেলায় পানির পিপাসার পরিমাণ কমায়। তাই সেহরির পরে ইসবগুলের ভূষি খাওয়ার অভ্যাস অনেক ভালো। এইটা একদিক দিয়ে দিনের বেলায় পানি শূন্যতা কমাবে অন্যদিকে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্যও এইটা উপকারি।

যাদের পূর্ব থেকেই এসিডিটি কিংবা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা রয়েছে, তাদের করণীয় কি?

মূলত যাদের এসিডিটির সমস্যা কিংবা গ্যাস্ট্রিক রোগ রয়েছে তারা গ্যাস্ট্রিক এর ঔষধ খেতে পারেন এবং চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে রোযা রাখতে পারবেন আর সঙ্গে সঙ্গে উপরের নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে।

সতর্কতা: বিভিন্ন রোগী ও তার অসুস্থতার অবস্থা ভেদে খাবারের জন্য ডায়েট চার্ট করা জরুরি এবং বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করার প্রয়োজন হতে পারে সেক্ষেত্রে সরাসরি চিকিৎসক কিংবা পুষ্টিবিদ ও ডায়েট বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

 

লেখক: ডা. ইসমাইল আজহারি

চিকিৎসক, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল