দিলদার হোসেন সেলিম : এক মুকুটহীন সম্রাটের চিরবিদায়

Published: 7 May 2021

।। আবদুল কাদের তাপাদার ।।


সিলেটের রাজনীতি ও ক্রীড়াঙ্গনের এক বটবৃক্ষ, গোয়াইনঘাট জৈন্তাপুর এলাকার মুকুটহীন এক সম্রাট তিনি। দিলদার হোসেন সেলিম(৭১) এমসি কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথমে জিএস, তারপর ভিপি থেকে শুরু করে নানাভাবে, নানা মাত্রিকে সিলেটের রাজনীতি, সমাজ ও ক্রীড়াঙ্গন মাতিয়ে রেখেছিলেন গত ৫০ বছর।  তাঁর মৃত্যুর  মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক
বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। সিলেটে আর এমন
যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব কখনো সৃষ্টি হবে কি না জানিনা।

গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর এলাকার সাধারণ মানুষের
তিনি খুবই আপনজন ছিলেন। সময় হলেই ছুটে যেতেন নিজ এলাকায়।
গ্রাম থেকে উঠে আসা মাটি ও মানুষের জন্য রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন আজীবন।
স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে এমসি কলেজের জনপ্রিয় ছাত্র নেতা হিসেবে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। এমসি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হয়ে সাড়া ফেলে দেন। এর পরে তিনি ভিপি
নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেও
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম,সাইফুর রহমানের হাত ধরে যোগ দেন বিএনপিতে।
২০০১ সালে জৈন্তাপুর গোয়াইনঘাট আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এর আগে ১৯৯০ সালে তিনি গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
দিলদার হোসেন সেলিম
দীর্ঘদিন সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সিলেট রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও
দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।

সাংবাদিকতার পেশাগত জীবনের বাইরেও আমার সাথে একসময় অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিলো সেলিম ভাইয়ের।
নানা বিষয়ে মত বিনিময় করতেন। মান অভিমানের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
তৃণমূলের একজন রাজনীতিক হিসেবে তাঁর প্রশংসা মাঝে মধ্যেই আমাকে আপ্লূত করতো।গোয়াইনঘাটে বাড়ি না হয়ে আমি গোয়াইনঘাটের বিষয়ে এতো কিছু জানি কিভাবে – একদিন এমন প্রশ্ন করে বসলেন আমাকে।আমি বললাম, আপনি তৃণমূলের জনপ্রিয় রাজনীতিক আর আমি তৃণমূলের একজন সংবাদ কর্মী। এজন্য হয়তো এই মিল! আমাকে পিঠ চাপড়িয়ে তিনি তখন কেবলই হাসছিলেন। গোয়াইনঘাটে মালিক ভাইয়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে আজ থেকে ২৫ বছর আগে এমন আড্ডায় আমরা মেতেছিলাম।
পরবর্তীতে ২০০১ এর নির্বাচনি প্রচারণার সময়
ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটে।
একটি অনুষ্ঠানে গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি আবদুল মালিক ভাইকে দাওয়াত দেয়া হয়নি।মালিক ভাই খুব কষ্ট পেয়ে আমাকে ফোন দেন।আমি সেলিম ভাইকে রাগ করে ফোন দিই।সেলিম ভাই ঐদিনই বিকেলে ছুটে যান মালিক ভাইয়ের দোকানে । সেখানে গিয়ে আমাকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে মালিক ভাইয়ের গোস্বা ভাঙ্গানোর ব্যবস্হা করেন।জৈন্তাপুরের সাংবাদিক নুরুল ইসলামের সাথে একবার সামান্য মনোমালিন্য হয় সেলিম ভাইয়ের।তিনিই বিষয়টি আমাকে জানিয়ে জাফলং যাওয়ার দাওয়াত দেন।
তাঁর গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে নেন জাফলংয়ে।নুরুলের সাথে গলাগলি করে সমাধান করেন।
এ রকম কতো স্মৃতি বিস্মৃতির মধুর ইতিহাস আমাদের মধ্যে।
গোয়াইনঘাটের আমার বন্ধু ও সেলিম ভাইয়ের অতি ঘনিষ্ঠ আরিফ ইকবাল নেহাল কতো স্মৃতির সাক্ষী।
২০০১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বালাগঞ্জের শেরপুরে ইলিয়াস ভাইয়ের
নির্বাচনী প্রচারণায় যাবেন
এম,সাইফুর রহমান।
আমাকে ইলিয়াস ভাই দাওয়াত দিয়েছেন যেতে। নিউজ টা ভালো করে কাভার করতে। দিলদার হোসেন সেলিম ভাইও যাবেন এবং বক্তব্য দিয়েই ফিরে আসবেন। আমি সেলিম ভাইয়ের গাড়িতে সঙ্গী হলাম।
সেদিন পাশাপাশি বসে কতো গল্প।রাজনীতির, সিলেটের,ইলিয়াস আলীর আর এম সাইফুর রহমানের নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে তিনি আমাকে যাতায়াত পথে ব্যস্ত করে তুললেন। আমার যে কতো জানা হলো। আজ তা বুঝতে পারছি।
আজ এম,সাইফুর নেই।
ইলিয়াস ভাই গুম হয়েছেন।
শেষমেষ চলে গেলেন সেলিম ভাইও।

২০০১ সালের নির্বাচনের সময় সিলেটে বিএনপির অফিস ছিল সুবহানীঘাট
উপকন্ঠ আবাসিক এলাকায়।এখান থেকে মূলত: এম,সাইফুর রহমানের নির্বাচন পরিচালনা করা হতো। আর এই অফিসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন আহমেদ আরেফ ভাই।
আরেফ ভাইও তিনদিন আগে চিরবিদায় হয়ে গেলেন।দিলদার সেলিম ও আহমেদ আরেফ দুজনেই সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।তারা দুজনেই সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনের রাজার আসনে ছিলেন একসময়।

জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বন্ধু ফয়েজ আহমদ বাবর। কয়েক মাস আগে করোনায় মারা যান।বাবর ভাই সেলিম ভাইয়ের আপন ভাগ্নে।
ছাতকের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাজকুর পাবেল।বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। পাবেল ভাইও সেলিম ভাইয়ের আপন ভাগ্নে।
আমার বন্ধু পাবেল ভাই। আমার সহপাঠী বন্ধু বাবরও অকালে হারিয়ে গেলেন।

সেলিম ভাই ২০০৮ সালে শেষমেষ জৈন্তাপুর গোয়াইনঘাট আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে বিএনপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৯৮,৫৪৫ হাজার
ভোট পেয়ে পরাজিত হন।
বর্তমান প্রবাসী কল্যান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এ নির্বাচনে বিজয়ী হন।

বেশ কয়েক মাস আগে আমাকে ফোন দিয়ে বাসায় চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন।যাব যাব বলে আর যাওয়া হয়নি।
তবে ফোনে আলাপ হয়েছিল সেদিন অনেকক্ষণ।
আজ সেদিনের আলাপের কথা কানে বাজছে।

চিকিৎসা শেষে তিনি আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে এসেছেন জেনে ভালো লাগছিলো। কিন্তু গতকাল ৪ মে তাঁর অবস্হার অবনতির কথা
জানতে পারি।
আজ পাবেল ভাইয়ের পোস্ট দেখে শোকাভিভূত হয়ে পড়ি। তিনি লিখেছেন : ছোট মামা সাবেক এমপি দিলদার হোসেন সেলিম আর নেই।
রাত ৯টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান।

সেলিম ভাইয়ের সাথে নানাকারণে স্মৃতির পাহাড় জমে আছে।
আমাদের জীবনটা তো আসলে একেকটি স্মৃতির মিনার।

দিলদার হোসেন সেলিম
এ অঞ্চলের রাজনীতির এক পাদপ্রদীপ ছিলেন।
তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ বা নীতির সাথে হয়তো আমার মিল ছিল না।তবে
সিলেটের এক তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমি তাঁর গুন ও প্রজ্ঞার ভূঁয়সী প্রশংসা করি।
দিলদার হোসেন সেলিম একজনই।
তিনি এ অঞ্চলের এক বটবৃক্ষ ছিলেন।

দেশের সৌন্দর্যের রানী হিসেবে পরিচিত জাফলং এর রাধানগর গ্রামে ১৯৫০ সালে জন্ম নেয়া দিলদার হোসেন সেলিম তাঁর এলাকার রাজনীতির এক মুকুটবিহীন সম্রাট হিসেবে
বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।