নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার

Published: 17 May 2021

খন্দকার আব্দুল আউয়াল (রিজভী)

বিশ্বজুড়েই উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত। সাধারণ মানুষ উচ্চ রক্তচাপকে হাইপারটেনশন বা হাই ব্লাড প্রেসার নামেই জানে। এটি একটি জটিল শারীরিক অবস্থা। ধমনিতে রক্ত প্রবাহের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার অব মার্কারি। কিন্তু কারো রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিলিমিটার অব মার্কারি বা এর চেয়ে বেশি হলে তার উচ্চ রক্তচাপ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। আর এই রোগে প্রতিবছর প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশেও ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এই রোগে ভুগছেন। অসংক্রামক রোগ বিষয়ক এসটিইপিএস সার্ভে ২০১৮ অনুসারে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের শতকরা ২১ ভাগ উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন। আরো ভীতিকর বিষয় হলো, এই রোগে আক্রান্তদের মাত্র শতকরা ১১ ভাগ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন। আর আক্রান্তদের অর্ধেকই জানেন না, তাঁর উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এই না জানার ফলে দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ও চিকিত্সাবিহীন উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ জন্যই এটাকে নীরব ঘাতক বলা হয়।
বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের পরিণতিতে হূদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি বিকলতায় মানুষের মৃত্যু ও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা দিন দিন বেড়ে চলছে। এর প্রধান কারণ অল্প কয়েক দশকেই আমাদের সমাজের জীবনাচরণের দ্রুত পরিবর্তন। আমাদের দেশে আমরা মূলত কৃষিজীবী ছিলাম এবং গ্রামে বসবাস করতাম। আমাদের দৈনন্দিন খাবার ছিল ভাত, ডাল ও শাক-সবজি। আমরা অভ্যস্ত ছিলাম পায়ে হেঁটে। ছেলে-মেয়েরা অবারিত মাঠে খেলাধুলা করত ও নদীতে বা পুকুরে সাঁতার কাটত। আমরা দিন শেষে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন আমরা অনেকেই শহরে থাকি, আরামদায়ক অফিসে কাজ করি, গাড়ি ব্যবহার করি এবং শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম থেকে দূরে থাকি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা মাঠের অভাবে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত। তাদের অবসর কাটে ভিডিও গেম খেলে ও রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করে। আমরা কেউ কেউ ধূমপান ও মদ্যপান করি। শহুরে জীবনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপে অনেকেই দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত। এ ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন খাবারে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত চর্বি, লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার। আমরা অনেকেই জানি না এ সবই আমাদের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এদিক বিবেচনায় নিলে উচ্চ রক্তচাপের মতো নীরব ঘাতক রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ব্যাপক ভিত্তিতে কার্যক্রম হাতে নেওয়া দরকার।
একটা স্বাস্থ্যবান জাতি হতে হলে আমাদের প্রথমেই জীবনাচরণের পরিবর্তন আনতে হবে। রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে ব্যক্তিগতভাবে করণীয়ের মধ্যে রয়েছে জীবনধারার পরিবর্তন করা, যেমন—লবণ কম খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রচুর পরিমাণে ফলমূল ও শাক-সবজি খাওয়া, চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়া, দুশ্চিন্তা না করা, ধূমপান না করা ইত্যাদি। অন্যদিকে রাষ্ট্রের উচিত শহরাঞ্চলে নাগরিকদের জন্য খোলা মাঠ নিশ্চিত করা, ভেজালমুক্ত খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান, ধূমপানের হার কমাতে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করা ইত্যাদি।
কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে পাঁচ দিন নিয়মিত আধাঘণ্টা হাঁটলে বা ব্যায়াম করলে তিন মাসের মধ্যে সুফল পাওয়া যাবে; উচ্চ রক্তচাপ রোগীর প্রতি এক কেজি ওজন কমানোর মাধ্যমে এক পয়েন্ট রক্তচাপ কমে এবং কেউ যদি ধূমপান বন্ধ করে দেন, তাহলে এক বছরের মধ্যে হূদরোগের ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে।
তবে যদি কারো রক্তচাপ বেশি হয়েই থাকে তাহলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিত্সকের কাছে গিয়ে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করতে হবে এবং তাঁর নির্দেশমতো নিয়মিত ওষুধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একজন রোগী এবং চিকিত্সকের মধ্যকার সুসম্পর্ক রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তবে অনেকেই ওষুধ খেয়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়েছে ভেবে ওষুধ বন্ধ করে দেন কিংবা ওষুধের মাত্রা নিজে নিজে পরিবর্তন করেন। অনেকে ওষুধ খেতে ভুলে যান বা অর্থের অভাবে কিনতে ব্যর্থ হন।
যেহেতু বেশির ভাগ সময়ই উচ্চ রক্তচাপের কোনো উপসর্গ থাকে না; তাই রোগ নির্ণয় দেরি হয়ে যেতে পারে। এর থেকে বাঁচতে চাইলে আমাদের জাতীয়ভাবে দুটি কাজ করতে হবে। একটি হলো স্ক্রিনিং এবং অন্যটি সব সুযোগেই নিজের রক্তচাপ মেপে নেওয়া।
উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ, নির্ণয়, প্রতিকার ও চিকিত্সা একটা অতিব জরুরি ও কঠিন কাজ। জনবহুল, অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জাতিকে সুস্থ করতে চাইলে চাই সমন্বিত উদ্যোগ; সরকার, বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টা। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও পরিমাপে সরকারের বিভিন্ন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। প্রথমে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার। এরপর প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগের; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা। সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সক্রিয় এনসিডি কর্নার চালু রাখা, কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের মাধ্যমে গ্রামভিত্তিক ও বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় ফলোআপ করা। এনজিওগুলোকে এনসিডি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।
সবার সমন্বিত উদ্যোগে হাইপারটেনশন ক্যাম্পের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক জনগণের স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে রক্তচাপ পরিমাপ করা প্রয়োজন। উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক গণমুখী সেমিনার, লিফলেট এবং পোস্টার বিতরণ, গণমাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দেশে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণের হার বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা রিজলভ টু সেইভ লাইভসের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডি কন্ট্রোল প্রগ্রাম এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ; ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলার ৫৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়, চিকিত্সা ও ফলোআপ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সের সবার রক্তচাপ পরিমাপ করা হবে; এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হবে এবং তাদের ফলোআপও করা হবে। ধীরে ধীরে দেশের সব উপজেলায় এই কার্যক্রম পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ এটি বেশ ফলপ্রসূ। এর আগে সিলেটের চারটি উপজেলায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে দু্ই বছর মেয়াদি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। সেখানে নিবন্ধিত রোগীর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ছিল শতকরা ৪৮ ভাগ, যা দেশে সামগ্রিকভাবে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণের হার শতকরা ১১ ভাগের চেয়ে অনেক বেশি।
এতে প্রতীয়মান হয় যে রোগীদের নিয়মিত স্ক্রিনিং, ফলোআপ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হলে অধিক মাত্রায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আগেই বলা হয়েছে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের অর্ধেকই জানেন না, তাঁর রোগটি রয়েছে। কারণ দেখা যায়, সাধারণত লোকজন অসুস্থ না হলে রক্তচাপ পরিমাপ করেন না। তা ছাড়া বেশির ভাগ রোগীর প্রবণতা হলো—রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চলে এলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। এই পরিস্থিতি দূর করতে সারা দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ স্ক্রিনিং, ফলোআপ ও বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদানের প্রকল্পটি বিস্তৃত করা যেতে পারে। এটা করা গেলে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ রাখা যাবে।
তবে মনে রাখতে হবে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি জেনে সেগুলো এড়িয়ে চলেন, তাহলে নিজে যেমন ঝুঁকিমুক্ত থাকা যাবে তেমনি পরিবার, সমাজ এবং দেশ সুস্থ জাতি পাবে। পরিশেষে বলা যায়, ‘আপনার রক্তচাপ জানুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং সুস্থ জীবন উপভোগ করুন।’

লেখক : অধ্যাপক ও মহাসচিব, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ