জুলুমের পরিণাম শুধুই অনুশোচণা

Published: 26 July 2021

।। জাফর আহমাদ ।।


‘জুলুম’ অর্থ অত্যাচার; উৎপীড়ন; উপদ্রব; নির্যাতন; দূর্ব্যবহার। ‘জালিম’ মানে অত্যাচারী; উৎপীড়ক। আর মাজলুম বলা হয় অত্যাচারিত; উৎপীড়িত; নির্যাতিতকে। জলুম, জালিম ও মজলুম বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। কিতাবুল কাবায়েরে বলা হয়েছে সবচেয়ে পরিচিত ধরণটি হলো, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ হরণ করা, বিনাপরাধে মানুষকে নির্যাতন করা, অকথ্যভাষায় গালি-গালাজ করা, বিনা দোষে কারো ওপর হামলা করা এবং আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন এবং দূর্বলদের ওপর নৃশংসতা চালানো ইত্যাদি। জুলুমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, কারো অধিকার হরণ করা এবং ইনসাফ বিরোধী কাজ করা। জুলুম শুধুমাত্র এমনটি নয় যে, স্বার্থের কারণে একজনকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন, উৎপীড়ন ও যন্ত্রনা দেয়া। বরং এটি একদিকে যেমন ব্যক্তি কর্তৃক ব্যক্তির প্রাপ্য হরণ করাকে বুঝায় তেমনি ব্যক্তি নিজেই নিজের ওপর জুলুম করে থাকে। কারণ নিজের বিবেক, নিজের সুস্থ জ্ঞান যেটিকে সায় দেয়নি তথাপি সেটি নিজের বিবেকের বিরুদ্ধাচরণ করে কাজটি সংগঠিত করা মানে নিজের ওপর জুলুম করা। অথবা নিজের জন্য ক্ষতিকর জেনে তা অব্যাহত রাখাও নিজের উপর জুলুম করা।
সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে নিজের স্রষ্টার সাথে তাঁরই কোন সৃষ্টিকে অংশীদার করা। এ ধরণের জুলুমের গুনাহ আল্ল¬াহ কখনো মাফ করবেন না। শিরক সমস্ত নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়। এ শিরক বর্তমানে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবেশ করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় এ শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে। শিরক মুক্ত জীবন ও সমাজ গঠণ করার জন্যই হযরত মুহাম্মদসহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ সকল আম্বীয়ায়ে কেরাম আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ওপর আল্লাহর হক হচ্ছে ‘তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা’। কারণ তিনি এক ও একক, তাঁর সাথে কোনই অংশীদার নাই। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করাকে আল-কুরআনে ‘মস্তবড় জুলুম’ বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“নিশ্চয় শিরক হচ্ছে বড় জুলুম।”(সুরা লুকমান:১৩) এ জুলুমটি বৃহৎ হওয়ার কারণ এ জন্য যে, মানুষ এমন সব সত্তাকে নিজের স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও নিয়ামতদানকারী হিসেবে বরণ করে নেয়, তাঁর সৃষ্টিতে যাদের কোন অংশ নেই তাদের রিযিক দান করার ক্ষেত্রে যাদের কোন দখল নেই এবং মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব নিয়ামত লাভে ধন্য হচ্ছে সেগুলো প্রদান করার ব্যাপারে যাদের কোন ভূমিকাই নেই। এটা এত বড় অন্যায়, যার চেয়ে বড় কোন অন্যায়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। তারপর মানুষ একমাত্র তার স্রষ্টারই বন্দেগী করবে, এটা মানুষের ওপর তার স্রষ্টার অধিকার। কিন্তু সে অন্যের বন্দেগী করে তাঁর অধিকার হরণ করে।
বড় জালেম দুই প্রকার। প্রথম প্রকার বড় জালেম হলো. সে সমস্ত ব্যক্তি যারা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করে না অর্থাৎ যাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য পৌঁছেছে, সেটি মানুষের কাছে না পৌঁছিয়ে, নিজের মধ্যে গোপন করে রাখাকে আল কুরআনে বড় জালেম হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্ল¬াহ তা’আলা বলেছেন,“তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে যার কাছে আল্ল¬াহর পক্ষ থেকে একটি সাক্ষ্য বা সত্য রয়েছে সে তা প্রকাশ না করে গোপন করেছে।”(সুরা বাকারা ঃ ১৪০) দ্বিতীয় প্রকার বড় জালেম হলো, যারা আল্ল¬াহর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্ল¬াহ তায়ালা বলেন,“তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেয়ার পর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সেই খারাপ পারণতির কথা ভুলে যায় যার সাজ-সরঞ্জাম সে নিজের জন্য নিজের হাতে তৈরী করেছে। তাদের অন্তরে আবরণ টেনে দিয়েছি, যা তাদেরকে কুরআন বুঝতে দেয় না, তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছি, তুমি যতই তাদেরকে হেদায়াতের পথে ডাক তারা এ অবস্থায় কখনো হেদায়াতের পথে আসবে না।”(সুরা আল-ক্বাহফ ঃ ৫৭) আল্লাহ আরো বলেন,“তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আল্লাহ সস্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তাঁর আয়াতসমুহকে প্রত্যাখ্যান করে। জালিমরা আদৌ সফলকাম হয় না।”(সুরা আন’আম:২১)
যারা আল্ল¬াহর দিকে মানুষকে ডাকে না পক্ষান্তরে যারা আল্ল¬াহর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে, আল-কুরআন এ উভয় প্রকার ব্যক্তিদেরকে একই কাতারে শামিল করে বড় জালেম হিসাবে অবহিত করেছে। পুর্বেই বলা হয়েছে যার যা প্রাপ্য বা অধিকার তাকে সেই প্রাপ্য ও হক থেকে বঞ্চিত করাই জুলুম। যিনি মুসলমান তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো বা তার প্রতি দুনিয়াবাসীর হক হলো, তাদেরকে সত্য ও সৎপথের সন্ধান দেয়া এবং তাদের সামনে নিজেকে সত্যের বাস্তব সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপিত করা। যাতে তাকে দেখে পৃথিবীর পথহারা মানুষ সত্য পথের সন্ধান পায়। কিন্তু যারা মানুষকে এ হক থেকে বঞ্চিত করবে তারাই বড় জালেমের অর্ন্তভুক্ত হবে। বড় জালেম বলা হয়েছে এ জন্য যে, প্রকৃতপক্ষে সত্যের স্বাক্ষ্যকে গোপন করার দরুন লোক আলোর পথের দিশা থেকে বঞ্চিত হলো। পক্ষান্তরে দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে নিজের বিবেক, শরীর, পরিবার ও সমাজের হককে নষ্ট করলো। নিজের বিবেক, শরীর, পরিবার ও সমাজের হক হলো, এদের কল্যাণের নিমিত্তে কাজ করা। আল্ল¬াহর দাওয়াত কবুল করা মানেই কল্যাণের পথ অবলম্ভন করা। কিন্তু আল্ল¬াহর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে অশান্তি ও অকল্যাণের পথকে বাঁচাই করে নেয়া হলো। এ অকল্যাণ যেহেতু নিজের হাতে উপার্জন তাই এর মাধ্যমে নিজের বিবেক, শরীর, পরিবার ও সমাজের হককে নষ্ট করা হলো।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু কাজ এমন রয়েছে যার মাধ্যমে বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় যে, একজনের প্রতি রহম করা হয়েছে কিন্তু এর মাধ্যমে মুলত: অন্য একজনকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং এটি একটি জুলুম। কারণ যাকে দিলাম যাকে দিলাম না উভয়ের অধিকার কার কতটুকু ছিল তা যদি আমার জানা থাকে তবে এটি ইচ্ছাকৃত জুলুম ও অন্যায় তেমনিভাবে যদি জানা না থাকে সেটিও জুলুম ও অন্যায় হিসাবে গণ্য হবে। কারণ না জানাটা একটি জুলুম। কারণ অজ্ঞতার দরুন নিজের বিবেক দূর্বল থাকে। অন্যায় কাজ করে দূর্বল বিবেকের ওপর জুলুম করা হয়। উল্লেখিত বড় জুলুম ছাড়াও ইসলামের দৃষ্টিতে যেগুলো ন্যায় ও ভালো তা পালন না করা যেমন জুলুম তেমনি যেগুলো নিষিদ্ধ সেগুলো পালন করাও জুলুম।
জুলুমের পরিণতি পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। পৃথিবীর প্রাচীন জাতি-গোষ্ঠীগুলো ধ্বংসের প্রধান কারণ ছিল জুলুম। এই জুলুমের ফলে তাদের উপর নেমে এসেছিল বিভিন্ন ধরণের আযাব তথা: অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পাথরবৃষ্টি, ঝড়-তুফান, বন্যা, পঙ্গপাল, প্লেগ ও কোভিট-১৯ এর মতো বিভিন্ন ধরণের মহামারী।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,“জালেমদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না। আল্লাহ তাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন, যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফারিত হবে,তারা মাথা নিচু করে উঠিপড়ি করে দেঁৗঁড়াতে থাকবে, তাদের নিজেদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের হৃদয়সমূহ দিশেহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আযাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও। সেদিন জুলুমবাজরা বলবেঃ হে আমাদের প্রভু! অল্প কিছুদিন আমাদেরকে সময় দিন, তাহলে আমরা আপনার দাওয়াত কবুল করবো এবং রাসূলদের অনূসরণ করবো। তোমরা কি ইতিপূর্বে কসম খেয়ে খেয়ে বলতে না যে তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বসবাস করছো এবং সেই সব জালিমদের সাথে আমি কি আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি।” (সুরা ইবরাহিমঃ ৪১-৪৫) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন,“শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে থাকে। জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।”(সুরা শুরাঃ ২২৭)
“কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আযাব অকস্মাত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আযাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোন কথাই ছিল না যে, ‘সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম’।”(সুরা আল আরাফ ৪-৫) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেনঃ “পুর্ববর্তী ইবরাহিমের জাতি এবং আদ, সামুদ ও নুহের জাতি সমুহ এবং মাদায়েনবাসী ও মুতাফিকাত ধারীদের ইতিহাস কি তারা জানে না ? তাদের কাছে নবীরা সুস্পষ্ট নির্দেশমালা নিয়ে এসেছিলেন। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেননি বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। পক্ষান্তরে ঈমানদার নারী-পুরুষেরা পরস্পরের মিত্র ও সহযোগী। তারা ভাল কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে।”(তাওবা ঃ ৭০-৭১)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেননা। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেনঃ তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদ সমুহকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক অপ্রতিরোধ্য।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,“কেউ যদি তার কোন ভাই-এর সম্মান হানি কিংবা কোন জিনিসের ক্ষতি করে থাকে, তবে আজই তার কাছ থেকে তা বৈধ করে নেয়া উচিত এবং সেই ভয়াবহ দিন আসার আগেই এটা করা উচিত, যেদিন টাকা কড়ি দিয়ে কোন প্রতিকার করা যাবে না, বরং তার কাছে কোন নেক আমল থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ হিসাবে মজলুমকে সেই নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে এবং অসৎ কাজ না থাকলেও উক্ত মজলুমের অসৎ কাজ তার ওপর বর্তাবে।” (বুখারী তিরমিযি) একটি হাদিসে কুদসীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আল্লাহ বলেছেন,“হে আমার বান্দারা! আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরের ওপর জুলুম করো না।”(মুসলিম, তিরমিযি)
জনৈক আরব কবি বলেছেন,‘ক্ষমতা থাকলেই জুলুম করো না, জুলুমের পরিণাম অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। জুলুম করার পর তুমি তো সুখে নিদ্রা যাও,কিন্তু মযলুমের চোখে ঘুম আসেনা। সে সারারাত তোমার জন্য বদ দু’আ করে, এবং আল্লাহ তা শোনেন। কেননা তিনিও ঘুমান না।” কথিত আছে, ‘ক্ষমতা হারানোর পর রাজা খালেদ বিন বারমাক ও তার ছেলে কারাবন্দী হলে তার ছেলে বললো: আব্বা, এত সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকার পর এখন আমরা কারাগারে? খালেদ বললেন: হ্যাঁ,বাবা! প্রজাদের ওপর জুলুম চালিয়ে আমরা যে রজনীতে তৃপ্তির সাথে নিদ্রা গিয়েছিলাম, আল্লাহ তখন জাগ্রত ছিলেন এবং মজলুমদের দু’আ কবুল করেছিলেন।, এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিত্যদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জুলুম ও মাজলুম উভয় থেকে তোমার কাছে আশ্রয় দাও।
# ম্যানেজার, আইবিবিএল, জিন্দাবাজার শাখা,সিলেট।