হাশরের ময়দানে কেউ কারো দায়িত্ব নেবে না

Published: 2 August 2021

।। জাফর আহমাদ।।


আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর যখন সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে,“সত্যি বলতে কি আল্লাহ তোমাদের সাথে যে ওয়াদা করে ছিলেন তা সব সত্যি ছিল এবং আমি যেসব ওয়াদা করেছিলাম তার মধ্যে থেকে একটিও পুরা করিনি। তোমাদের ওপর আমার তো কোন জোর ছিল না, আমি তোমাদের আমার পথের দিকে আহবান জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি এবং তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। এখন আমার নিন্দাবাদ করো না, নিজেরাই নিজেদের নিন্দাবাদ করো। এখানে না আমি তোমাদের অভিযোগের প্রতিকার করতে পারি আর না তোমরা আমার। ইতিপূর্বে তোমরা যে আমাকে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কতৃত্বের শরীক করেছিলে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, এ ধরনের জালেমদের জন্য তো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবধারিত।”(সুরা ইবরাহিম:২২)

শুধু শয়তান নয়, বরং শয়তানের এজেন্টদারীদের যারা আজ অনুসরারী, তারা কিয়ামতের দিন এদের কাছ থেকে কোন সাহায্য-সহযোগীতা পাবে না এবং তারা ঠিক শয়তানের মতই সকল দায় এড়িয়ে যাবে এবং তাদের আচরণও হবে শয়তানের মতো। প্রকৃতপক্ষে তাদেরও কিছু করার শক্তি থাকবে না। আল্লাহ বলেন, “এটি সেই দিন যখন কারোর জন্য কোন কিছু করার সাধ্য কারোর থাকবে না। ফয়সালা সেদিন একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারে থাকবে।”(ইনফিতার:১৯) আল্ল¬াহ আরো বলেন, “এরা যখন সবাই একত্রে আল্লাহর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে, সে সময় এদের মধ্য থেকে যারা দুনিয়ায় দুর্বল ছিল তারা যারা নিজেদেরকে বড় বলে জাহির করতো তাদেরকে বলবে,“দুনিয়ায় আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম, এখন কি তোমরা আল্লাহর আযাব থেকে আমাদের বাঁচাবার জন্যও কিছু করতে পার? তারা জবাব দেবে,“আল্লাহ যদি আমাদের মুক্তি লাভের কোন পথ দেখাতেন তাহলে আমরা নিশ্চই তোমাদেরও দেখিয়ে দিতাম। এখন তো সব সমান, কান্নাকাটি করো বা সবর করো-সর্বাবস্থায় আমাদের বাঁচার কোন পথ নেই।”(সুরা ইব্রাহিম:২১)

দুনিয়াতে যারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে ভুলে গিয়ে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাচ্ছে, রোজ হাশরে আহকামুল হাকিমিন মহান আল্লাহর বিচারালয়ে যখন রায় শুনানো হবে, তখন এ সকল অপরাধীরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে শয়তানকে দোষারূপ করতে থাকবে। তখন শয়তান তার সকল দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করবে। উল্লে-খিত আয়াতে শয়তানের বক্তব্য কি হবে তা আল্লাহ সুষ্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন।

যাদের আশা আকাংখা ও লোভ-লালসা আজ শয়তানের রঙিন পৃথিবীর মায়াজালে জড়িয়ে জীবনের সুখ খুঁজে ফিরছে, প্রকৃতপক্ষে তারা এক গোলক ধাঁ ধাঁর ক্ষপ্পরে পড়েছে। এ ধাঁ ধাঁ থেকে একমাত্র সেদিন তাদের হুশ ফিরে আসবে, যেদিনকার কথা উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে। সেদিন তারা জানতে পারবে যে, আল কুরআনে বিবৃত আল্লাহর ওয়াদাসমূহ। শয়তান সেদিন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে জানিয়ে দিবে যে, সত্যি সত্যিই ছিল আল্লাহর ওয়াদা। সে বলবে আল্লাহ সত্যবাদী, আমি মিথ্যাবাদী। এ সমস্ত অপরাধী যারা আজ তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে, তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে শয়তান বলে দিবে যে, তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না, আল্লাহর প্রতিটি প্রতিশ্রুতি ও হুমকী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে আমি তোমাদের যে যেসব আশ্বাস দিয়েছিলাম, যে সব লাভের লোভ দেখিয়েছিলাম, যেসব সুদৃশ্য আশা-আকাংখার জালে তোমাদের ফাঁসিয়েছিলাম এবং সর্বাগ্রে তোমাদের মনে যে বিশ্বাস স্থাপন করিয়েছিলাম যে, ওসব আখেরাত টাখিরাত বলতে কিছুই নেই। এগুলো নিছক প্রতারণা ও গাল-গল্প, আর যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তাহলে অমুক বুযুর্গের বদৌলতে তোমরা সোজা উদ্ধার পেয়ে যাবে, কাজেই তাদের খেদমতে নযরানা ও অর্থ-উপাচারের উৎকোচ প্রদান করতে থাকো এবং তারপর যা মন চায় তাই করে যেতে থাকো আমি তোমাদের এই যেসব কথা নিজে এবং আমার এজেন্টদের মাধ্যমে বলেছিলাম, এগুলো সবই ছিল নিছক প্রতারণা।
এখানে আমার প্রতারণা ছিল অনেকটা জাল বিছানোর মতই। সেখানে আটকে যাওয়ার জন্য আমি তোমাদের বাধ্য করিনি। বরং তোমরা নিজে নিজে এসেই আমার মেকি রঙিন জালে এসে ধরা দিয়েছো। তোমরা এ মর্মে কোন প্রমাণ দেখাতে পারবে না যে, তোমরা সত্য পথে চলতে চাচ্ছিলে এবং আমি জবরদস্তি করে হাত ধরে তোমাদের ভূল পথে টেনে নিয়েছিলাম। এর যা শাস্তি হয় আমি তা মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তোমরাও স্বীকার করে নেবে যে, আসল ঘটনা তা নয়। আমি হকের আহবানের মোকাবেলায় বাতিলের আহবান তোমাদের সামনে পেশ করেছি মাত্র। সত্যের মোকাবেলায় মিথ্যার দিকে তোমাদের ডেকেছি মাত্র। আমার কথা মানা না মানার পূর্ণ স্বাধীনতা তোমাদের ছিল। তোমাদের বাধ্য করার কোন ক্ষমতা আমার ছিল না।

 

এখন আমার এ দাওয়াতের জন্য নি:সন্দেহে আমি নিজে দায়ী ছিলাম এবং শাস্তিও আমি পাচ্ছি। কিন্তু তোমরা যে আমার দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিলে, এর দায়ভার কেমন করে আমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছো। নিজেদের ভূল নির্বাচন এবং নিজেদের ক্ষমতার অসৎ ব্যবহারের দায়ভার পুরোপুরি তোমাদের বহন করতে হবে।

 

আপাদমস্তক মিথ্যার ওপর চালিত শয়তানের জীবনাচারের কোথাও সত্যের লেশমাত্র না থাকলেও সেদিন সে বাস্তব সত্যটুকু ঠিকই প্রকাশ করবে। দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর ওয়াদাসমূহকে ভুলে গিয়ে শয়তানের আহবানে হরহামেশা সাড়া দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সমীপে আল্ল¬াহর ওয়াদাসমূহ তুলে ধরা হলো।

আল্লাহ বলেন,“হে মানব সমাজ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং নিজেদের রবকে বাদ দিয়ে অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। কিন্তু তোমরা খুব কমই উপদেশ মেনে থাকো।” সুরা আরাফ:৩)

 

দুনিয়ার মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা। এ নির্দেশনায় আসল দাওয়াত দেয়া হয়েছে, সেটি হচ্ছে: দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের জন্যে যে হেদায়াত ও পথ-প্রদর্শনের প্রয়োজন, নিজের ও বিশ্বজাহানের স্বরূপ এবং নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুধাবন করার জন্য তার যে জ্ঞানের প্রয়োজন এবং নিজের আচার-আচরণ, চরিত্র, নৈতিকতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারাকে সঠিক ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সে যেসব মূলনীতির মুখাপেক্ষী সেগুলোর জন্যে তাকে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকেই নিজের পথপদর্শক হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে যে হেদায়াত ও পথ-পদর্শননা দিয়েছেন একমাত্র তারই অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তান ও তার সহচরদের কারো দিকে পথ-পদর্শনা লাভ করার জন্য মুখ ফিরানো এবং তার নেতৃত্বের আওতায় নিজেকে সমর্পন করা মানুষের একটি মৌলিক ভ্রান্ত কর্মপদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর পরিণামে মানুষকে সব সময় ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তাকে সবসময় এই একই পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে। শয়তান তাকে সে দিকেই নিয়ে যাবে। এ জন্য আল্লাহ তা’আলা বলেদিয়েছেন, “হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যে সমস্ত হালাল ও পাক জিনিস রয়েছে সেগুলো খাও এবং শয়তানের দেখানো পথে চলো না। সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তোমাদের অসৎকাজ ও অনাচারের নির্দেশ দেয় আর একথাও শেখায় যে, তোমরা আল্লাহর নামে এমন সব কথা বলো যেগুলো আল্লাহ বলেছেন বলে তোমাদের জানা নেই।”(সুরা বাকারা:১৬৮-১৬৯)

আল্লাহ আরো বলেন,“হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনিভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার জন্যে তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল। সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। এ শয়তাদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি। তারা যখন কোন অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, আমাদের বাপ-দাদারদেরকে আমরা এভাবেই করতে দেখেছি এবং আল্লাহই আমাদের এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন। তাদেরকে বলে দাও আল্লাহ কখনো নিলর্জ্জতা ও বেহায়াপনার হুকুম দেন না। তোমরা কি আল্লাহর নাম নিয়ে এমন কথা বলো যাকে তোমরা আল্লাহর কথা বলে জানো না?”(সুরা আরাফ:২৭-২৮)

আল্লাহর এই সতর্ক বার্তা প্রদানের পরও যারা শয়তানের পথে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ আল্লাহর প্রদর্শিত পথে চলতে যারা অস্বীকার করেছে তাদের অবস্থা ঠিক তেমন যেমন রাখাল তার পশুদের ডাকতে থাকে কিন্তু হাঁক ডাকের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই তাদের কানে পৌঁছে না। তারা কানা, বোবা ও অন্ধ, তাই কিছুই বুঝতে পারে না।” (সুরা বাকারা: ১৭১) তাদের অবস্থা সেই নির্বোধ প্রাণীদের মতো হয়ে যায় যারা একটি পালে বিভক্ত হয়ে নিজেদের রাখালদের পিছনে চলতে থাকে এবং না জেনে বুঝেই তাদের হাঁক-ডাকের ওপর চলতে ফিরতে থাকে। শয়তানের অনুসরাীদের অবস্থাও তদ্রুপ, তাদেরকে আহবান করার ও তাদের কাছে দীনের দাওয়াত প্রচারের সময় মনে হতে থাকে যেন নির্বোধ জন্তু-জানোয়ারদেরকে আহবান জানানো হচ্ছে, তারা কেবল আওয়াজ শুনতে পাবে কিন্তু কি বলা হচ্ছে তা কিছুই বুঝতে পারে না। তাদের অবস্থা এমনই চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যে, আল্লাহ বলেন,“এরাই হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা কিনে নিয়েছে এবং ক্ষমার বিনিময়ে কিনেছে শাস্তি। এদের কি অদ্ভূত সাহস দেখো। জাহান্নামের আযাব বরদাস্ত করার জন্য এরা প্রস্তুত হয়ে গেছে।”(সুরা বাকারা:১৭৫)