সিলেটের মেয়ের হাতে কমনওয়েলথের মশাল!

Published: 9 August 2022

পোস্ট ডেস্ক :


লন্ডনে জন্ম হলেও মননে-মগজে বাংলাদেশ, বাঙালি সত্তার ধারক। কুশল বিনিময়ের পর বাংলায় কথা বলার আগ্রহ জানালে রাজি হলেন। তবে আগেই বলে দিলেন, প্রশ্ন যা হোক, তিনি উত্তর দেবেন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায়।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের সাদিপুরের মেয়ে হিসেবে ভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইয়াসমিন হুসেনের এই চেষ্টা স্বাভাবিক বটে। তার জন্ম লন্ডনের ইলফোর্ডে। বাবা সৈয়দ নজরুল হুসেন, মা কামরুন্নেছা হুসেন এখন লন্ডনেই থাকেন।

তিন সন্তানের (দুই মেয়ে, এক ছেলে) মা ইয়াসমিন। বড় মেয়েকে নিয়ে তার স্বামী নাসিম চৌধুরী এখন সিলেটে রয়েছেন। নিজের বাড়ি বিয়ানীবাজার ঘুরে চলতি সপ্তাহেই লন্ডনে ফেরার কথা নাসিম চৌধুরীর। আগামী ডিসেম্বরে সিলেটে আসবেন ইয়াসমিনও।

এতক্ষণ যার জীবনবৃত্তান্ত পড়লেন, মূলত বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসের কল্যাণে বাংলাদেশে, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটি এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। কারণ গেমসের মশাল উঠেছিল ইয়াসমিনের হাতে।

২০২১ সালের অক্টোবরে মশাল রিলে শুরু হয়। ৭২ দেশে, ২৯৪ দিন ঘুরে মশাল এসেছে যুক্তরাজ্যে। গত ৫ জুন লন্ডনের অলিম্পিক পার্কে ইয়াসমিন মশাল হাতে ছুটেছেন পাঁচ মিনিট। অভিনন্দন বৃষ্টিতে সিক্ত হয়েছেন তিনি।

একাধারে ফুটবল কোচ, রোল মডেল এবং গেমসের মশালবাহক ইয়াসমিনকে নিয়ে যুক্তরাজ্যের দৈনিক গার্ডিয়ানে ফিচার প্রকাশিত হয়েছে।

মশালবাহকদের আট জনকে আলাদাভাবে গণমাধ্যমের সামনে এনেছিল আয়োজক কমিটি। সেখানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া জানাতে গিয়ে ইয়াসমিন বলেছেন, ‘আমাকে নমিনেশন দেওয়া লাগছে, আমার ম্যানেজার দিয়েছে। আমার ম্যানেজারের নাম ইয়াসমিন হারুণ। মুসলিমা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের (এমএসএ) প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ৮ হাজার নমিনেশন ছিল। ২ হাজার জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়। তা থেকে মাত্র ৮ জনকে মিডিয়া সেশনের জন্য নির্বাচন করা হয়।’

মশাল হাতে অলিম্পিক পার্কের হকি স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করেছেন ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘মোট হয়তো পাঁচ মিনিট আমার হাতে ছিল মশাল। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হয়তো ১০ মিনিট লেগেছিল। অলিম্পিক পার্কের হকি একটা স্টেডিয়ামে আছে। ওটার ভেতরে ঘুরে গেছিলাম।’

এমন অর্জনের গৌরব ছুঁয়ে গেছে ৩৮ বছর বয়সি এই নারীকে, ‘এটা খুবই সম্মানের। ৮ হাজার থেকে আট জনের মধ্যে নির্বাচিত হওয়া অনেক সম্মানের, গৌরবের। এবং এটা বহন করতে পারাটা বিশেষ অনুভূতির। আমার কাজের খবর, ব্যাটন রিলের খবর যখন ছড়িয়েছে কমিউনিটির সবাই ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। এটা খুবই প্রেরণাদায়ক।’

অথচ এই কমিউনিটিতেই বেড়ে ওঠার বয়সে ফুটবল খেলার কারণে বাঁকা কথা শুনতে হতো ইয়াসমিনকে। তিনি বলেন, ‘আমার যখন বয়স কম ছিল তখন মানুষ আমাকে দেখে বলত, আমি নাকি ছেলের মতোই, কারণ আমি ফুটবল খেলতাম। আমার বাবাকে টিপ্পনী কেটে বলত, তোমার তিনটা ছেলে। সেই লোকগুলোই এখন বলে, ওয়েলডান, তাদের মন্তব্য বদলে গেছে। তাদের মানসিকতা বদলেছে এখন।’

ফুটবল খেলা ছাড়লেও ২০১৮ সাল থেকে মেয়েদের কোচিং করাচ্ছেন ইয়াসমিন। বলেছেন, ‘আমি লেভেল ওয়ান ফুটবল কোচ। প্রতি সপ্তাহে আমি ৮০ জন মেয়েকে কোচিং করাই ফ্রেনফোর্ডর্ ক্লাবে। সপ্তাহে ২ দিন।’

মুসলিম মেয়েদের ফুটবল খেলায় অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাতেই কোচিংয়ে আসা ইয়াসমিনের। তিনি বলেন, ‘মুসলিম মেয়েদের নিয়ে কাজ করছি। আমি আরো কোচ তৈরির চেষ্টা করছি। ক্লাবকে সহযোগিতা করতে চেষ্টা করছি। স্কুলশিক্ষকদের কোচিং শেখাচ্ছি। যাতে আরো বেশি মেয়েরা এখানে আসতে পারে।’

অভিবাবকদের কাছ থেকেও ভালো সাড়া পাচ্ছেন তিনি। মুসলিম মেয়েদের সামনে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরির চেষ্টা করছেন ইয়াসমিন, ‘তাদের সামনে আরো রোল মডেল দরকার, যাদের দেখে এগিয়ে আসবে। আমি কোচিং না করালে তাদেরকে পুরুষদের অধীনে কোচিং করতে হতো। মুসলিমরা পুরুষদের কাছে মেয়েদের পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। তাই আমার কোচিংয়ে অনেক অনেক মেয়ে যোগ দিচ্ছে।’

এতকিছুর মধ্যেও বাংলাদেশকে সবসময় অন্তরে লালন করেন ইয়াসমিন। বিয়ের পর নিয়মিতই সিলেটে যাচ্ছেন তিনি। বলেছেন, ‘আমার মেয়ে এখনো বাংলাদেশে তার বাবার সঙ্গে। আমার ছোট মেয়ে নায়লা, বাংলা কবিতা লিখছে অনলাইনে। আমার সন্তানরা বাংলাদেশকে ভালোবাসে। লন্ডনে থাকলেও আমি সবসময় আমার অন্তরে বাংলাদেশকে লালন করি।’

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের সাফল্য নজরকাড়া। সেই খবর অজানা নয় ইয়াসমিনের। ডিসেম্বরে দেশে ফিরে নারী ফুটবলারদের সঙ্গে দেখা করতে চান এই ফুটবল কোচ।