নারীর অন্তর্ভুক্তীকরণ: শুধুই কি ‘টিক দ্যা বক্স’?
Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA
নারীবাদ প্রসঙ্গটির ওপর খুব ঝাপসা ধারণা রাখা মানুষদের নিয়ে বার বার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বিশ শতকের শুরুর দিকে বিখ্যাত নারীবাদী ভার্জিনিয়া ওলফের ‘এ রুম অফ ওয়ানস অওন’ বইটির সমালোচনা ক’রে আমার এক বন্ধু বল্লেন, কোনো নারীর যদি সত্যিকারের প্রতিভা থাকে তাহলে সমাজ ব্যবস্থা যাই হোক না কেন তার প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই — আসল কথা হল নাচতে না জানলে ওঠোন বাঁকা। নাচতে না জানলে ওঠোন বাঁকার অজুহাত কেউ দিতেই পারেন, তবে ওঠোন যে কখনো বাঁকা থাকে না — সেটাও তো ঠিক না।
গত দু’দশকের কত সফল নারীর নাম শোনা যায়, অথচ গত দু’হাজার বছরের ইতিহাসে খুব কম নারীর নামই শোনা যায়। এর দুটো ব্যাখ্যা আছে, আপনি কোনটি গ্রহণ করবেন? (এক) জেনেটিক্যালি এখনকার নারীরা বেশী প্রতিভাবান (দুই) প্রাতিষ্ঠানিক নানান বদল নারীদের কিছুটা সমসুযোগ ক’রে দিয়েছে।
মেয়েরা কেন সেক্সপীআর হতে পারে না এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নারী যে জন্ম—মাত্রই প্রতিভাহীন নন, বরং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থেকে সকহুভ, আর্থিক সংগতি থেকে সকহুভ, এমন কি নিজের একটি কামরা থেকে সকহুভ দশাই যে নারীর প্রতিভা আর যোগ্যতার বিচ্ছুরণ ঘটাতে বাধা দেয়, সেটা ভার্জিনিয়া ওলফ খুব পরিস্কারভাবে দেখিয়েছিলেন তাঁর ‘এ রুম অফ ওয়ানস অওন’ বইটিতে। তবে নারীমুক্তির ব্যাপারে ওলফের প্রথম—দিককার চিন্তা ভাবনা নির্দিষ্ট একটি বলয়ের বাইরে যেতে পারেনি। তাই ১৯১৩ সালে শ্রমজীবী নারীদের মুখে মজুরী বৃদ্ধি এবং কর্মঘন্টা কমাবার দাবীতে বক্তৃতা শুনতে শুনতে অনেকটা সহানুভূতি নিয়ে ভার্জিনিয়া ওলফ ভেবেছিলেন — “যন্ত্রের চাকা চালু রাখা, সন্তানের জন্ম দেওয়া আর একই সঙ্গে সংসারের ঘানি টানা এই অন্য শ্রেণীর নারীদের দাবী—দাওয়া আর সংগ্রামের সাথে তাঁর জীবনের কত পার্থক্য!
পরবর্তীতে আরেকজন নারীবাদী সিমন দ্য ব্যুভুয়া আবিষ্কার করেন যে একজন নিম্নশ্রেণীর কেরাণী মহিলা সম্পত্তির অধিকারী হন না, পছন্দমত জায়গায় বেড়াতে যেতে পারেন না, পড়াশোনা করার অবসর তার নেই, আর এই ব্যবস্থায় শোষিত নারীটির নারীমুক্তি সংগ্রামে নামার সম্ভাবনা থাকে সবার শেষে। তাই নারীর প্রশ্নের তুলনায় বহুক্ষেত্রে শ্রেণীগত প্রশ্নটিই শ্রমজীবী নারীর কাছে অগ্রাধিকার পায়। ঠিক এ কারণেই ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটি লিখতে গিয়ে ব্যুভুয়া সচেতন হন এই শ্রেণী প্রশ্নটিতে। তিনি খেয়াল কোরে দেখেন এই শ্রেণীব্যবস্থায় তিনিও একজন সুবিধাভোগী। তাঁর জীবনে শিক্ষার সুযোগ, তাঁর নিরাপত্তা আর তাঁর শৈল্পিক ভাবনার অবসর তাঁকে দিয়েছে পুরুষের মত দর্শন, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিষয়ে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে আলাপের ক্ষমতা। তাঁর মর্যাদার অনুভূতি তাঁকে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই আটকে রেখেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর নিজের জীবনের সাফল্য আর অর্জন তাঁকে এই বিরাট ভ্রান্ত বিশ্বাসটি দিয়েছিল যে, যে কোনো নারী চাইলেই যে কোনও কিছু কোরতে পারে।
নারীমুক্তির বাস্তব কোনো অগ্রগতি কি হয় নি তাহলে? নিশ্চয়ই হয়েছে। তার একটি জ্বলজ্বলে প্রমাণ হচ্ছে বৃটেনে নারী ভোটাধিকারের বর্ষপূর্তি উদযাপন। তবে ইতিহাসের এক অদ্ভুত দায়! আজ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজ যে অধিকারগুলো ভোগ কোরছে, তার অধিকাংশই এসেছে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের ফসল হিসেবে। নারীদের বেলায় কথাটি আরও সত্য। ইউরোপে নারীদের ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার এবং নিজ দেহের উপর অধিকারের সংগ্রামের দাবীর নায্যতা প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সামাজিক ভূমিকাই তারা শুধু রাখেন নি, শক্তি সমাবেশের বড় অংশটিও তাদের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে।
সিমন দ্য ব্যুভুয়া বলেছিলেন, ‘নারীবাদ একই সঙ্গে শ্রেণীসংগ্রামকে ধারণ করে কিন্তু শ্রেণীসংগ্রাম নারীবাদকে নিজে থেকে ধারণ করে না। তাই নারীবাদের মধ্যেও শ্রেণী—বৈষম্যের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ‘নারীবাদ’ এবং’ নারীর অধিকার’ — এ দু’টি ধারণা নিয়ে জনপ্রিয় চিন্তায় একটি পার্থক্য এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আসছে। বিলেতের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে,’ ফেমিনিজম হ্যাজ ফেইলড দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস। ‘ এই ব্যর্থতার কারণ হল’ নারীবাদ’ নারী—পুরুষ সমতা বিষয়ে ডিসপ্রপোরশনেটলি গুরুত্ব দিচ্ছে সমাজের উঁচু তলার নারীদের ভুমিকা রাখার ব্যাপারে। ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক পলিসি রিসার্চ (আই পি পি আর) এক সমীক্ষায় বলছে, বৃটেনে গত পন্চাশ বছরে নারী ও পুরুষের বেতনের বৈষম্য ধীরে ধীরে কমে আসছে, তবে দক্ষ ও অদক্ষ পুরুষ কর্মীদের বেতনের মধ্যে যে বৈষম্য, দক্ষ ও অদক্ষ নারী কর্মীদের বেতনের ব্যবধান তার চাইতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশী।
নারীবাদের সঙ্গে শ্রেণীর সম্পর্কটা ব্যুভুয়া যেভাবে বলেছেন তা কিন্তু বাংলাদেশেও দিনে দিনে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে আমরা দুই ধরণের নারীবাদের বৈপরিত্য একই সাথে দেখি। তৈরী পোষাক শিল্পে বাংলাদেশের নারীদের সব চাইতে বড় অংশটি যুক্ত, কিন্তু সেই নারী শ্রমিকরা মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনে তাদের পাশে কতটুকু পেয়েছিলেন মুখচেনা নারী নেত্রীদের? তাইতো আমরা দেখি বাংলাদেশে ক্ষণে ক্ষণে শ্রমজীবী নারীদের তাৎক্ষণিক আলোড়ন দেখা গেলেও সেভাবে শ্রমজীবী নারীদের শঙ্খধ্বণী বেজে ওঠেনি এখনও।
খুব বিরল ক্ষেত্রে হলেও কখনো কখনো নারীবাদ আত্মীকৃত পুরুষতান্ত্রিক ছদ্মবেশ হতে পারে। ক্ষমতাহীন নারীরাই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের ঘরকন্যা সামলে দিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি, শিল্পকলা আর বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ করে দেন এবং এদেরই স্কন্ধে ভর করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের সফলতা ও ক্ষমতাবান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত। বহু মধ্যবিত্ত শিক্ষিতা ও উচ্চবিত্ত নারীরা তৈরী পোষাক কারখানাগুলোর উপর বিরক্ত, কারণ সেগুলো গার্হস্থ্য কর্মীদের আগের চাইতে স্বাধীন ও ক্ষমতাবান করেছে। এখানেই আমরা পাব নারীবাদের মাঝে নিখাদ শ্রেণীসংগ্রাম।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে সড়ক, হাটে বাজারে, গণ পরিবহণে শুধু নিম্নবিত্ত নন মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত নারীরাও দরিদ্র পুরুষদের দ্বারা লাঞ্ছিতা হচ্ছেন কেন? এঁরা তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকার কথা ছিল। আসলে কোনো সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের আচরণ অনেকটাই নির্ভর করে সে সমাজে নারীদের প্রতি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী বা পার্সেপশন কি তার উপর। আর এই পার্সেপশনটি তৈরী হয় সেই সমাজে অধিকাংশ নারীর দশা থেকে। বেশীরভাগ নারীই যেখানে সার্বিকভাবে বন্চিত, মর্যাদার দিক থেকে হীনতর — এই বিপুল সংখ্যক নিপীড়িত নারীর উপস্থিতিই সমাজে পুরুষদের ভাব মানস তৈরী করে। কাজেই সুযোগ পেলে একজন দরিদ্র পুরুষও যে কোনো নারীকে উৎপীড়ন করার সামাজিক সুযোগের অধিকারী মনে করে। আর যে পুরুষ একটি সূতি কাপড় ছিঁড়তে পারেন ঠিক সেভাবেই তিনি দামী রেশমী কাপড়ও ছিঁড়তে পারেন।
কাজেই এই চরম সত্যটা যদি ভুলে যাওয়া হয় যে, আপমর নারীদের অবস্থাই সাধারণভাবে নারীর ভাবমূর্তি ও অবস্থান তৈরী করে তাহলে অধিকাংশ নারীর জীবন সম্পর্কে উদাসীন থেকে নিজের মুক্তির চেষ্টার নারীবাদ শুধু যে খন্ডিত তাই নয়, এর একটি ভয়াবহ পরিণতি হল, এতে বিভাজিত অংশটিরও প্রকৃত অর্থে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। পঁচা আবর্জনা রেখে দিয়ে পাশে অট্টালিকাতে বাস করলেও দুর্গন্ধ আর রোগজীবাণু কোনো না কোনো ভাবে আক্রান্ত করবেই।
সমস্যাটা হচ্ছে আমরা পুরুষদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি — পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ব আর পুরুষতান্ত্রিক অবকাঠামোর বিরূদ্ধে সংগ্রাম করি না। বরং কখনও কখনও নারীর একটি অংশ পুরুষতন্ত্রে আত্মীকৃত হয়ে পুরুষদের সুযোগ সুবিধা ভোগ কোরে সম্ভবতঃ নিজের অজান্তেই নারীমুক্তি আন্দোলনকে পিছিয়ে দেয়। এই সত্যটা যদি আমরা বুঝতে না পারি তাহলে অর্থনৈতিক সুযোগ সহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ —সব কিছুতেই নারীর অন্তর্ভুক্তীকরণ ব’লে ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য বিষয়টি কেবলই ‘টিক দ্যা বক্স’ হয়েই থাকবে, সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি থাকবে বহু দূরে।
লেখক একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সিনিয়র সংবাদ পাঠক ও সংবাদ বিশ্লেষক।