গাজায় ইসরাইলের তাণ্ডবের লোহমর্ষক বর্ণনা দিলেন প্রত্যক্ষদর্শী
পোস্ট ডেস্ক :
ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলছে হামাস ও ইসরাইল বাহিনীর মধ্যে সংঘাত। এতে প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। শুরুর পর থেকে প্রতিনিয়ত বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে হাজার হাজার গাজাবাসী। গাজায় ঘটে যাওয়া ইসরাইলি বাহিনীর তাণ্ডবের বর্ণনা দিয়েছেন মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসা এক ফিলিস্তিনি। গত ৫ এপ্রিল ঢাকায় ফেরেন বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত কামেল আবু আমশা। তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তার জীবনে ঘটে যাওয়া লোহমর্ষক কাহিনি।
বাংলাদেশের ফরিদপুরে থেকেও প্রতিরাতে ঘুমাতে গেলে পর ৩০ মিনিট পর পর ঘুম ভেঙে যায় কামেল আবু আমশার। ঘুমের মধ্যেই তিনি যেন শুনতে পান বিমানহামলা, ট্যাংক ও বোমার শব্দ।
গাজায় ইসরাইলি হামলা শুরু হওয়ার পর উত্তর গাজায় নিজ জন্মভূমিতে তিনি থেকেছেন। সেখানে ঘুমাতেন জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরের ঠান্ডা, ময়লা ও রক্তাক্ত মেঝেতে, আবার কখনো থাকতেন আহত রোগীদের রক্তে ভেজা হাসপাতালের শয্যায়। সেখানকার চেয়ে ফরিদপুরের এই বিছানা অনেক বেশি আরামদায়ক হলেও বারবার তার ঘুম ভেঙে যায়। কারণ, ওটাই তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
তিনি জানেন না বাংলাদেশের এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তার কী করা উচিত। তিনি কৃতজ্ঞ যে বাংলাদেশের মানুষ গাজার পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং তারা ফিলিস্তিনিদের মুক্তি চায়। কিন্তু তিনি জানেন না এটা দিয়ে কী করবেন।
তিনি বলেন, সেখানে প্রতিদিন কী হচ্ছে, বিশেষত উত্তর গাজায়, সেটা আসলে কেউই ভালো করে বুঝতে পারছে না। এমনকি মোবাইলে দেখলেও বুঝবেন না। আমরা প্রতিদিন অসংখ্যবার জীবন ফিরে পেয়েছি, আর প্রতিদিনই আমাদের একটি অংশের মৃত্যু হয়েছে।
কামেলের কাছে তার বাবা আকরামই (৫৫) সবকিছু। আকরাম গাজার একটি ছোট দোকানে মুরগি বিক্রি করতেন। ইসরাইল-গাজার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সীমান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে উত্তর গাজার বেইত হানৌনে তাদের বাড়ির কাছেই ছিল দোকানটি। আকরাম সব সময় কামেলকে অনুপ্রাণিত করতেন, যাতে সে নিজেকে গড়ে তোলে, ‘মানুষের উপকার’ করে।
ছোটবেলা থেকেই গাজার আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে চাইতেন কামেল। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটানো তার বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দুর্দশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত বৃত্তি পেতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করেন কামেল।
২০১৯ সালে গাজা থেকে বাংলাদেশে আসেন কামেল। বিষয়টি তার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। ছয় ভাই ও এক বোনের পরিবারে তারা সবাই খুব ঘনিষ্ঠ। তারা তাদের তিনতলা বাড়ির একই কক্ষে থাকতেন এবং প্রতিরাতে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন। ফিলিস্তিনি ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদের দিন তাদের খাবার হিসেবে থাকত ফাসেখ—যা সমুদ্র থেকে ধরে আনা তাজা খোড়ল (ফ্ল্যাটহেড গ্রে মালেট) মাছ ১৪ দিন ম্যারিনেট করার পর রান্না করে ভাজা টমেটোর সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
কামেল তার চাচাতো-মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। মামাতো ভাই হাসান তার সমবয়সী—তার সবচেয়ে ভালো ও আস্থাভাজন বন্ধু। গাজায় নিজের সাদামাটা জীবনটাই উপভোগ করতেন কামেল। যদিও এই ‘উন্মুক্ত কারাগার’ থেকে কোনো একদিন মুক্তির স্বপ্নটি রয়ে গেছে সুদূর পরাহত।
কামেলের ভাষ্য, পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে ‘অনেক বেশি গর্বিত’, যা তার কাছে বিব্রতকর লাগে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ঘুমিয়ে থাকার সময় হঠাৎ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শব্দ পান কামেল। ‘প্লিজ এখন না’—মনে মনে ভাবেন তিনি। ২০০৬, ২০০৮, ২০১১ ও ২০১৪ সালেও গাজায় এমন আরও অনেক হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি। এমনকি তিনি ফরিদপুরে থাকাকালীন ২০২১ সালেও ইসরাইলি বাহিনী গাজায় হামলা চালিয়েছিল। তিনি শুধু দোয়া করছিলেন যাতে এই মাসে, এই সময়ে আবার হামলা না হয়।
শিগগির তিনি খবর পান ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছে হামাস এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইল যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। সামনে কী হবে তা ভেবে শরীর হিম হয়ে আসে তার। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতেই থাকলেন তারা। ভেবেছিলেন, আগের সময়গুলোর মতো এবারও হয়তো তাড়াতাড়িই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কিন্তু এবারের বোমাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী; প্রতিটি বিস্ফোরণের শব্দ তাদের কাছে বজ্রপাতের মতো শোনাচ্ছিল। সবাই ভেবেছিলেন এই বুঝি তাদের মৃত্যু হবে।
বড় ভাই এমাদের (২৮) কোনো খবর পাচ্ছিলেন না তারা। অথচ একদিন আগেও তার সঙ্গে কামেলের দেখা হয়। আজ অবধি তারা জানেন না এমাদ বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী উত্তর গাজার বাসিন্দাদের নিজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। যুদ্ধের পঞ্চম রাতে যখন আতশবাজির মতো বোমা হামলা চলছিল, তখন তার পরিবার বুঝতে পারে যে তাদের হাতে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
কামেলের মা দ্রুত তার মেডিকেলের বইগুলো গোছাতে শুরু করলেন। ‘কোথায় পড়ব মা? চল আগে বের হই’, বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় মাকে বলেছিলেন কামেল। ৩৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা জীবনটা ছেড়ে, নিজেদের বাড়িটা ছেড়ে বের হয়ে যান তারা।
কাছাকাছি নিরাপদ জায়গা খুঁজতে খুঁজতে তারা আল-ফালুজাহ এলাকার একটি স্কুলে পৌঁছান। স্কুলটিকে শরণার্থী শিবির করা হয়েছিল। সেখানে হাজারো বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হচ্ছিলেন।
কামেলদের সঙ্গে ছিলেন তাদের অন্তঃসত্ত্বা ভাবি। কৌটাজাত শিম ও লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা গরুর মাংস ছিল তাদের খাদ্য, গোসল করতে পারতেন প্রতি ১৫ দিনে একবার। বড়দের মতো শিশুদেরকেও টয়লেটে যাওয়ার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হতো। অনেক শিশু এত সময় অপেক্ষা করতে পারতো না। কামেল জানান, শিশুদের মল-মূত্র ও কাদার মিশ্রণে তৈরি সেই ভয়াবহ পরিবেশের দৃশ্য ও দুর্গন্ধ তিনি আর মনেও করতে চান না, কিন্তু ভুলতে পারেন না।
প্রতিদিনই তাদের চারপাশে বোমা হামলা হতো। দিনে দিনে তাদের দেওয়া খাবারের পরিমাণ কমতে থাকল। তার চারপাশের মানুষগুলো অর্ধাহারে-অনাহারে শুকিয়ে যেতে লাগলেন। গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় গাছ কেটে লাকড়ি জোগাড় করতে হতো। একসময় কাঠও শেষ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে কামেলের মেডিকেল বইগুলো পুড়িয়ে রান্না করতে বাধ্য হয় তার পরিবার। বাঁচার জন্য খাবার তৈরি করতে মায়ের হাতে করে বয়ে নিয়ে আসা বইগুলোই পুড়িয়ে রান্না করা হলো।
মাঝে মাঝেই বোমার শ্র্যাপনেল, শেল বা পাথরের টুকরো এসে আঘাত করে তাদের শিবিরে। অনেকে আহত হন। অনেকে স্কুল প্রাঙ্গণেই নিহত হন। এক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের চারপাশে থাকা মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক হয়ে যায় কামেলের কাছে। তিনি তাদেরকে সম্মান করে ‘শহীদ’ হিসেবে অভিহিত করেন।
কামেলের পরিবারের কাছে তখন একমাত্র প্রাধান্যের বিষয় ছিল অনাগত শিশুটি। বাবার নামে শিশুটির নাম ঠিক করা হয়েছিল আকরাম। যুদ্ধ যখন প্রায় ১৫তম দিনে, তার ভাবির সন্তান প্রসবের দিনটি ঘনিয়ে এলো। ছোট্ট শিশুর জন্য কাপড়, ডায়পারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র আনতে বাড়ি যান কামেল। সে সময় তাদের বাড়ির আশেপাশে বোমা হামলা চলছিল। দ্রুত সব গুছিয়ে স্কুলের পথে রওনা দেন কামেল। ভুলে যাননি বাংলাদেশ থেকে অনাগত শিশুটির জন্য নেওয়া পাঞ্জাবিটির কথা।
শরণার্থী শিবিরে ফিরে দুই মামাতো ভাইকে কবর দেন কামেল। ইসরাইলি বিমানহামলায় নিহত হয়েছেন তারা।
২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর ভোরে তার ভাবির প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। উত্তর গাজায় তখন তুমুল বোমাবর্ষণ চলছে। এমন রোমহর্ষক পরিস্থিতির মধ্যেই তারা সৌভাগ্যবশত কামাল আদওয়ান হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভাবিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। ভোর ৪টায় তারা সেখানে পৌঁছান। ভূমিষ্ঠ হয় শিশু আকরাম।
শিশুটির শরীরে সংক্রমণ থাকলেও জন্মের মাত্র দুঘণ্টা পরই তাকে নিয়ে ফিরতে হয় আশ্রয়শিবিরে। কারণ হাসপাতালে জায়গা নেই। উত্তর গাজার চারদিকে যখন কেবল মৃত্যু আর মৃত্যু, তখন কামেলের পরিবার নতুন অতিথির আগমনী উৎসবে মাতোয়ারা।
কামেল ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি ২৪ বছর বয়সী একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী, যে কিনা ক্লাস-পরীক্ষা থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে নিজ দেশে, নিজ পরিবারের কাছে এসেছিলেন।
বিমান হামলায় গুরুতর আহত এক রোগীর চিকিৎসা করছেন কামেল। তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ইন্দোনেশীয় হাসপাতালে নিউরোসার্জন না থাকায় সেদিন রাত সাড়ে ১২টায় রোগীকে আল-শিফা হাসপাতালে নিয়ে যান কামেল। যদিও তিনি জানেন না ওই রোগী শেষ পর্যন্ত বেঁচে আছেন কি না।
ইন্দোনেশীয় হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় প্রতি ঘণ্টায় ১০০ জনের বেশি আহত রোগী আসতো। প্রত্যেকেই ব্যথায় চিৎকার করতে করতে হাসপাতালে ঢুকতো। ২০১৬ সালে চালু হওয়ার পর এই ১৪০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জন রোগীর চিকিৎসা করা হতো। কামেল দেখলেন, তার মতো অনেক পরিবার বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এবং কোনো কোনো পরিবারের সবাই মারা গেছেন।
যুদ্ধের ৪০তম দিনে তিনি ফোন কলে জানতে পারেন যে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আহমেদ শাবাথ বেকারি থেকে রুটি কিনতে গিয়ে বিমানহামলায় নিহত হয়েছেন। বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশের সময়টুকুও পাননি কামেল। নিকটজনের মৃত্যু ততদিনে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হাসপাতালের একটি ঘটনা তার মনে পড়ে যায়। তিনি তখন হাসপাতালের আইসিইউতে কর্মরত। একজন দৌড়ে হাসপাতালে ঢুকলেন, হাতে নয় মাস বয়সী একটি ভ্রূণ, যার নাড়ী (আমবিলিকাল কর্ড) তখনো অক্ষত। পুরুষ ভ্রণটি থেকে রক্ত ঝরছিল, এর খুলিতে বড় আকারে ফাটল এবং দুর্বল হাড়ের কিছু অংশ বের হয়ে এসেছে।
মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, সন্তানের মা মারা গেছেন। কামেল জানেন না কীভাবে সেই মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তিনি ধারণা করেন, ট্যাংকের গোলার আঘাতে হয়তো ওই মায়ের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তখনই ভ্রূণটি বের হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, অথবা শ্র্যাপনেলের আঘাত পায়। মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘দয়া করে ওকে বাঁচান। আমি ওকে হারাতে চাই না।’
কিন্তু কামেল জানতেন, ইতোমধ্যে ভ্রূণটির মৃত্যু হয়েছে। তিনি ওই বাবাকে এই মৃত্যুর কথা বলতে পারলেন না। বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’
পরবর্তীতে কামেল সেই ভ্রূণটিকে একটি বড় সাদা কাপড়ে জড়িয়ে ওই বাবাকে বললেন, তিনি তাকে বাঁচাতে পারেননি। বাবার মন, কোনোভাবেই এটা মানতে পারছিল না। বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন কিছু একটা করতে। কামেলের কিছুই বলার ছিল না। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সময়ও কামেলের হাতে ছিল না। ততক্ষণে বিমানহামলায় আহত আরও অনেক মানুষের ঢল নেমেছে হাসপাতালে, যাদের বেশিরভাগই শিশু। ফসফরাস বোমা হামলার শিকার ১০ শিশুকে পেলেন কামেল, যাদের শরীরের চামড়া ছিলে মাংস পর্যন্ত পুড়ে গেছে।
হাসপাতালের বাইরের রোমহর্ষক পরিস্থিতিরও সাক্ষী হয়েছে কামেল। প্রতিদিন যে পথে হাসপাতালে যান, সেই পথ ধরেই তিনি একদিন যাচ্ছিলেন। রাস্তা পার হয়ে আসার ২-৩ মিনিট পরই সেখানে বেশকিছু রকেটের আঘাত ও বিস্ফোরণের শব্দ পেলেন। দৌড়ে একটি বাড়ির কাছে আশ্রয় নিলেন। রাস্তাটি নিমিষেই জ্বলন্ত ছাই আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া রক্তে ভরে গেল। তার পেছনে হাঁটতে থাকা অগণিত মানুষের প্রাণহীন দেহ পড়ে রইলো গ্রানাইটের ওপর।
যুদ্ধের ৪৫তম দিনে কামেলকে নিয়ে তার পরিবারের আশঙ্কা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। রাত ২টার দিকে কামেল ইন্দোনেশীয় হাসপাতালে কাজ করছিলেন। সে সময় তিনি গুলির শব্দ পান। হাসপাতালের কর্মীরা ঘটনা বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে পড়েন। হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। হাসপাতালের একদল কর্মীকে নিয়ে চারতলায় ছুটে যান কামেল।
ইসরায়েলি সেনারা মাইক্রোফোনে হাসপাতালের ভেতরে থাকা মানুষদের বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করার কথা জানায়।
কামেল জানান, অন্যান্যবারের মতো এবারের যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে শুধু ইসরায়েলি নাগরিকরাই ছিলেন না। ‘তাদের কয়েকজন খুব ভালো ইংরেজি বলেন এবং তাদের কথায় বিশেষ আঞ্চলিক টানও রয়েছে। তারা ডাচ, ফ্রেঞ্চ, আরবি ও অন্যান্য ভাষাতেও কথা বলছিলেন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত।’
কামেল দাবি করেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হাসপাতালে কুকুর ছেড়ে দেয়। সে সময় জানালাগুলোর সামনে দিয়ে ড্রোন ঘুরতে থাকে। ডাক্তার ও নার্সরা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ফেলে হাসপাতাল ছেড়ে যেতে পারবেন না বলে জানান। তারা জিম্মির মতো বেশ কয়েকদিন সেখানে আটক ছিলেন। এমনকি তাদেরকে কোনো খাবার বা পানিও দেওয়া হয়নি।
রেড ক্রিসেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির অ্যাম্বুলেন্স আসার পর এই ইসরায়েলি অভিযান শেষ হয়। হাসপাতালের রোগীদের এসব অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে দক্ষিণ গাজার আল-নাসের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসার সময় কামেল অনেক রোগীকে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। তাদের দেহে বুলেটের ক্ষত। তিনি দৌড়ে আল-ফালুজাহ শিবিরে ফিরে যান। সেখানে কামেলের ভীত-সন্ত্রস্ত পরিবার তার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল।
আশ্রয়শিবিরের নামমাত্র নিরাপত্তার মধ্যে বসে কামেলের পরিবার জানতে পারে যে ‘যুদ্ধবিরতি’ শুরু হয়েছে। কামেল, তার চাচা ও ভাইরা বেইত হানৌনে নিজেদের বাড়িতে ফিরলেন। তাদের আশা ছিল, বাড়িতে কোনো খাবার থাকলে সেগুলো নিয়ে আসবেন।
তারা দেখতে পান, তাদের বাড়িতে ইতোমধ্যে বোমাহামলা চালানো হয়েছে। তাদের রান্নাঘরে এক বাটি ময়দা ছিল। সেই বাটি বাড়ির ভেঙে পড়া পাথর আর ধুলায় নষ্ট হয়ে গেছে। তারা সেখানে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। অল্প সময়ের মধ্যেই পতঙ্গের ঝাঁকের মতো ড্রোন উড়তে শুরু করে। আশ্রয়শিবিরে ফেরার পথে রাস্তায় আরও অনেক আহত মানুষের দেখা পান তারা। কামেলের মনে পড়ে যায়, ইন্দোনেশীয় হাসপাতালে তিনি ব্যাগ ফেলে এসেছেন, যেখানে তার সব মেডিকেল সরঞ্জাম এবং ড্রেসিং, অ্যান্টিবায়োটিক ও পেইনকিলার রয়েছে।
হাসপাতালে ফিরে যান তিনি। ততদিনে হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে ঢোকার সময় তিনি মরদেহের স্তূপ দেখতে পান, যেগুলোতে পচন ধরেছে। এ ছাড়া, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে পড়ে আছে বেশকিছু কঙ্কাল, যেগুলোর কোনো কোনোটিতে তখনো লেগে আছে মাংস। বিমানহামলায় প্রচুর পশুপাখিও মরছিল। যেখানে মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, সেখানে এসব পশুপাখিও স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যবঞ্চিত। ক্ষুধার্ত এসব পশুপাখিকে মরদেহের মাংস খেতে দেখেছেন কামেল।
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হেঁটে যাওয়ার সময় বিমানহামলায় ধ্বসে পড়া বাড়ির নিচ থেকে আহত মানুষদের বের করতে সহায়তা করতেন কামেল। যারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন, তাদেরকে বহন করে হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন। অনেকের রক্তপাত বন্ধ করতে ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করে দিয়েছেন।
যুদ্ধবিরতির অবসান হলে কামেল আংশিকভাবে চালু হওয়া আল-মা’আমাদানি হাসপাতালে (আল-আহলি আরব হাসপাতাল নামেও পরিচিত) স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। ১৮ অক্টোবর এই হাসপাতালের সামনে বড় আকারে বোমা হামলায় প্রায় ৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত হন।
কামেল যোগ দেওয়ার এক মাসের মাথায় ইসরাইলি বাহিনী এই হাসপাতাল থেকে সবাইকে জোর করে বের করে দেয়। সে সময় কামেল নিজের চোখে দেখেন, ইসরাইলি বাহিনীর স্নাইপাররা হাসপাতাল থেকে বের হওয়া রোগীদের গুলি করে হত্যা করছে। রোগীদের অনেকে হুইলচেয়ারে থাকলেও রেহাই পাননি।
এই পুরো সময়ে কামেলের জন্য একমাত্র শান্তির মুহূর্তগুলো ছিল আল-ফালুজাহ ক্যাম্পে। ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তিনি ও তার পরিবার। এরপর ইসরাইলি সেনাবাহিনী ট্যাংক হামলা শুরু করে। তারা স্মোক বম্ব ছুঁড়ে মারে। কামেল জানতেন না সেসব বোমায় কী ধরনের রাসায়নিক রয়েছে। এসব বোমা বেসামরিক মানুষের দিকে ছুঁড়ে মারতো এবং গুলি চালিয়ে সবাইকে সরে যেতে বাধ্য করতো।
কামেল বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছিল, গাজায় মানুষ হওয়াই যেন এক অপরাধ।
কামেলের বাড়ি উত্তর গাজার বেইত হানৌন এলাকায়। মাসব্যাপী সেখানে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এই ছবিটি গত ফেব্রুয়ারিতে তোলা হয়।
তারা কয়েক কিলোমিটার হেঁটে উত্তর গাজার জাবালিয়া এবং গাজা শহরের মাঝামাঝি ‘জয়নব আলওয়াজির’ এলাকায় আরেকটি ক্যাম্প খুঁজে পান। ৭ ডিসেম্বর ঠিক রাত ৮টার দিকে আবারও শুরু হয় সেই দুঃস্বপ্ন। ইসরাইলি বাহিনী ওই এলাকার সব আশ্রয়কেন্দ্রে টহল দিতে শুরু করে এবং বেসামরিক মানুষদের ওপর ২০টিরও বেশি স্মোক বম্ব নিক্ষেপ করে।
নতুন এই আশ্রয়শিবিরের ছোট্ট একটি ঘরে প্রায় শতাধিক মানুষের সঙ্গে থাকতো কামেলের পরিবার। সেখানে কোনো জানালা ছিল না। স্মোক বম্বের প্রচণ্ড ধোঁয়ায় ঘরটিকে ভরে যায়। তারা বের হয়ে রাস্তায় চলে আসে। সেখানেও ধোঁয়ায় ভরা।
বোনকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র ১০০ মিটার হেঁটে যাওয়ার পরই ভয়ানক অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন কামেল। তিনি আর শ্বাস নিতে পারছিল না। হাল ছেড়ে দেন কামেল। ১৭ বছর বয়সী ছোট বোন কাওশেরকে শুধু বলেন, বাবাকে খুঁজতে এবং তার সঙ্গে হাঁটতে। এর কয়েক সেকেন্ড পরই তিনি জ্ঞান হারান।
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে অন্য একটি ধুলোময় রাস্তার ফুটপাতে দেখতে পান কামেল। সামনে বসে তার বাবা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, কাওশের কাঁদছে চিৎকার করে।
নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত কাছাকাছি একটি স্কুল ভবনে চলে যান তারা। সেটিও বাস্তুচ্যুত মানুষের ভরে গেছে। অত্যন্ত দুর্বল কামেল পাঁচজন গুরুতর আহত মানুষকে দেখতে পান। তাদের মধ্যে একজনের বয়স ১৩ বা ১৪ হবে। তার পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। উরুর ফেমোরাল ধমনী কেটে যাওয়ায় ছেলেটির শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে। মরতে বসেছে সে।
কামেলের সঙ্গেই ছিল তার ব্যাগ। তিনি ছেলেটির ক্ষতস্থান সেলাই করে রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য একটি টর্নিকেট দিয়ে জায়গাটি মুড়িয়ে দেন। তিনি ছেলেটিকে স্যালাইন দেন এবং নিজের পরিবারের সঙ্গে রাখেন। সেই রাতটি বেশ ঠান্ডা ছিল। তাদের কাছে কোনো কম্বল ছিল না। গায়ে ছিল ছিঁড়ে যাওয়া টি-শার্ট। দীর্ঘ আটটি ঘণ্টা বাচ্চাদের মতো কাঁপতে কাঁপতে নিজেদের উষ্ণ রাখতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন।
পরদিন সকালে কামেল বুঝতে পারেন যে আল-ফালুজার প্রথম আশ্রয়শিবিরে ফেলে আসা তাদের কিছু জিনিসপত্র, খাবার বা কম্বল নিয়ে আসা জরুরি। সেখানে পৌঁছে দেখতে পান, বাইরে পড়ে আছে পচে যাওয়া মরদেহ। তাদের একজনকে চিনতেও পারেন তিনি। মৃত মানুষগুলোকে কবর দিতে চেয়েছিলেন কামেল। কিন্তু যদি তিনি একটি কবরও খুঁড়েন তাহলে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে সন্দেহ করবে এবং তাকে গুলি করবে। দ্রুত সে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
স্কুলে ঢুকলে একজন স্নাইপার কামেলকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলিটি ঠিক তার পাশ দিয়ে চলে যায়। কয়েক সেন্টিমিটারের জন্য তিনি বেঁচে যান। স্কুলের ভেতরে এক কোণে লুকিয়ে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকেন তিনি। মনে মনে ভাবছিলেন, ‘ইয়া আল্লাহ, কী হচ্ছে এসব’। রাত নেমে এলে স্কুল থেকে বের হন, চলে যান নতুন আশ্রয়শিবিরে পরিবারের কাছে।
পরের দিন পরিবার নিয়ে নিরাপদ জায়গা খুঁজতে আবারও বেরিয়ে পরেন কামেল। তারা গাজার পশ্চিমে ইউএনআরডাব্লিউএ কেন্দ্রে যান। এটি পরিচালিত হয় ৩০০ কর্মীর সহযোগিতায়। ফলে পরিস্থিতি অনেক ভালো। খাবার ও শ্বাস নেওয়ার মতো জায়গা পেয়ে তাদের কাছে মনে হচ্ছিল এ যেন স্বর্গ।
বাড়ির সামনের এই মসজিদে নামাজ পড়তেন কামেলরা। গত ফেব্রুয়ারিতে বিমান হামলায় মসজিদটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
কামেল আল-শিফা হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। এই হাসপাতালে অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ভিড় ছিল। হাসপাতালটি দুবার অবরোধ করে রাখা হলেও তখন পর্যন্ত সেটি চালু ছিল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানো আহত মানুষ বাথরুমের পাশের সিঁড়িতে পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন। করিডোর থেকে প্রস্রাবের গন্ধ ভেসে আসছে। কামেল দিনেরবেলায় রোগীদের চিকিত্সা করতেন এবং রাতে কনসালটেন্ট হিসেবে ইউএনআরডব্লিউএ মেডিকেল স্পটে রোগীদের ওষুধ লিখে দিতেন।
গত ৩১ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে যখন কামেলের মা ভাত রান্না করছিলেন, তখন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ট্যাংক থেকে ওই এলাকায় গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। ইউএনআরডব্লিউএ কেন্দ্রের পাশে স্কুল ছিল, যেখানে অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। জানালা দিয়ে কামেল ও তার পরিবার দেখতে পান, ইসরায়েলি বাহিনী পুরুষ ও নারীদের দুটি আলাদা লাইন করে দাঁড় করিয়েছে এবং তাদেরকে নগ্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এরপর তারা কয়েকজনকে আটক করে এবং বাকিদের ছেড়ে দেয়।
পরের কয়েক ঘণ্টায় তারা নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকেন। তারা জানতেন যে ইসরায়েলি বাহিনী ইউএনআরডব্লিউএ কেন্দ্রকেও রেহাই দেবে না, কারণ তারা কোনো কিছুকেই রেহাই দেয়নি। তাদের কাছে আরও বড় হুমকির বিষয় ছিল, তারা কেউই জানতেন না যে ইসরায়েলি বাহিনী কোথায় কোথায় আছে। কয়েকজন পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেখানেই তারা স্নাইপারের গুলির মুখে পড়েন এবং ঘটনাস্থলেই পাঁচ-ছয়জন নিহত হন।
সবাই চিৎকার করে বিভিন্ন দিকে ছুটতে থাকেন। কামেল ও তার পরিবার পূর্ব দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু তাদের সামনে হত্যাকাণ্ড চলছিল। কামেল বলেন, ‘ওই পরিস্থিতি আমার দেখা যেকোনো হরর মুভির চেয়েও খারাপ।’
তারা ইউএনআরডব্লিউএ সেন্টারের বাইরে এক লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং হঠাৎ স্নাইপাররা ব্রাশফায়ারের মতো সবাইকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে। কেউ স্নাইপারের সেই গুলিতে আহত বা নিহত হচ্ছেন, কেউবা বেঁচে যাচ্ছেন। এটা ছিল জীবন ও মৃত্যু নিয়ে খেলা এক জুয়া। কামেলের চোখের সামনে গুলির আঘাতে ছিটকে পড়া মানুষের মাথার টুকরো, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাতাসে ভাসছিল, ছিটকে পড়ছিল মাটিতে।
তিনি বলেন, ‘মনে মনে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। আমার কেবল মনে হচ্ছিল, আমি এভাবে দৌড় দিবো না। দৌড় দিলে মারা পড়বে। কিন্তু তারপরেই ভাবলাম, যদি এগিয়ে না যাই, তাহলে তারা এদিকেও আমাকে গুলি করবে।’
চোখ বন্ধ করে দৌড় দেন কামেল। পার হয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি তখনও জানতেন না তার পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাগ্যে কী হয়েছে। প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যেমন আছে, আবার প্রত্যেকেরই মরে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে, কামেল শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন যে সবাই মারা যাবে।
যখন তিনি দেখলেন যে তার বাবা জীবিত অবস্থায় পার হয়ে এসেছেন, তখন আনন্দে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁতে বলেন, ‘আমাকে বলুন, কতজন মারা গেছে।’
তার পরিবারের সবাই এ যাত্রায় বেঁচে যান। তারা জানতেন যে তারা ভাগ্যবান, খুবই ভাগ্যবান। যদিও এই সৌভাগ্য ক্ষণস্থায়ী। তাই তারা একসঙ্গেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার প্রত্যয় নিয়ে বেইত হনৌনে নিজ বাড়িতে ফিরে যান।
এর ফলে কোনো গুরুতর ক্ষতি হয়েছে কি না, সেটা তারা জানেন না। কারণ গাজায় এখন আর কোনো পরিপূর্ণ হাসপাতাল নেই। (ডানে) কামেলের ছোট ভাই তারেক (১০) গত ২৬ এপ্রিল দূরবর্তী একটি নলকূপ থেকে হুইলচেয়ারে করে খাবার পানি নিয়ে যাচ্ছে।
পশুখাদ্য খেতে পারাই যখন আনন্দের
১ ফেব্রুয়ারি। যে শহরে বড় হয়েছেন, সেটা বড় অচেনা লাগছে কামেলের কাছে। পুরো শহর ধূসর। তাদের বাড়িতে দ্বিতীয়বারের মতো বোমাহামলা করা হয়েছিল এবং শুধুমাত্র বাড়ির গেটটিই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
খাবারের খোঁজে তারা সেখানে রাত কাটান। বিকেল ৫টার পর কাউকে বের হতে দেওয়া হয় না। তাই সারাদিন তারা খাবারের সন্ধানে ঘুরেছেন। রাত নেমেছে, শুরু হয়েছে বিমান হামলা।
একদিন খাবারের খোঁজে বেরিয়ে কামেল তার দশম শ্রেণির আরবি শিক্ষক ইউসেফের বাড়ি খুঁজে পান। আগের রাতে এই বাড়িতে বোমাহামলা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে তখনও চিৎকার করছিলেন তার শিক্ষক। কামেল ও তার পরিবার কয়েকঘণ্টার প্রচেষ্টায় ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে তাকে বের করেন। কিন্তু ততক্ষণে তিনি মারা গেছেন।
তারা উত্তর গাজার বাইরে চলে যান, যেখানে তার খালা থাকতেন। তার বাড়ি বোমাহামলায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। পরিবারের ১০ সদস্য একটি কক্ষে থাকছিলেন। ওই একটি কক্ষই বসবাসযোগ্য ছিল। তারা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ইসরায়েলি সীমান্ত ইরেজ ক্রসিংয়ের কাছে যান। যে কেউ এই সীমান্তের এক কিলোমিটারের মধ্যে পা রাখলে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি প্রায় অবধারিত। মাকে নিয়ে কামেল যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন, সীমান্তের ওপারের ঝলমলে দৃশ্য তার ভেতরটা চুরমার করে দিচ্ছিল। সেখানে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন জীবন—সুউচ্চ দালান, কাচের জানালা, গাড়ি।
তাদের ১৫টি দিন পার হয়েছে কোনো খাবার ছাড়াই। কেবল সমুদ্র সৈকত বা নোংরা নলকূপের নোনা পানি খেয়েই বেঁচে ছিলেন তারা। মাটি থেকে ঘাস তুলে খেতে শুরু করেন। তার পরিবার হাইপোগ্লাইসেমিক শকে ছিল, তাদের হৃৎস্পন্দন ছিল দুর্বল। ক্ষুধার জ্বালায় তারা কাতরাচ্ছে। হাইপোগ্লাইসেমিক শকের চিকিত্সার জন্য যে ইনজেকশন প্রয়োজন ছিল তা কামেলের কাছে ছিল না।
প্রতিরাতে সবাই ঘুমাতে গেলে কামেল এই ভেবে ঘুমাতেন যে তাদের মৃত্যুর সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে। তিনি মেনেই নিয়েছিলেন যে হয়তো পরের দিন কিংবা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ঘুম থেকে উঠবেন এবং তার ভাই, মা কিংবা বাবাকে কবর দিতে হবে—যদি তারা আর ঘুম থেকে না জাগতে পারেন।
তারপর তার ভাই শুনতে পান যে কিছু মানুষ একটি গাড়ি নিয়ে কাছাকাছি কোথাও খাবার দিচ্ছে। সেগুলো ছিল পশুখাদ্য। কিন্তু তারপরও খাবারের কথা শুনে তারা আনন্দিত হয়ে যান। কামেল বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য যা যা করা সম্ভব তা তারা করেছেন।
২৪ মার্চ কামেলের চাচা এসে তাকে ঘুম থেকে জাগালেন। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘তালিকায় তোমার নাম এসেছে! উঠে পড়!’
তখনই কামেলের মনে পড়ে, যুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের কাছে নিবন্ধন করেছিলেন, যারা বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের গাজা থেকে পালাতে সাহায্য করছিল।
কামেল তার চাচাকে বলেন, ‘না’। তিনি গাজা থেকে পালিয়ে যেতে চাননি। তারা সবাই ক্ষুধার্ত। তিনি জানতেন যে তার পরিবার কীসের মুখোমুখি হয়ে আছে এবং সামনে কী হতে যাচ্ছে। তার পরিবারের মানুষগুলো শিক্ষার্থী না, তাই তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না।
তার বাবা তাকে বলেন, আমরা আমাদের ভাগ্য জানি। কিন্তু তোমার ভাগ্য আলাদা। যাও, তোমার যাত্রা শেষ কর। যাও, ডাক্তার হও।
একেবারেই ভেঙে পড়েন কামেল। কিন্তু তিনি জানতেন, তাকে যেতে হবে।
কামেল যখন গাজা থেকে বের হওয়ার জন্য রওনা দেন, তখন ইসরাইলি সেনাবাহিনী আল-শিফা হাসপাতালটি ধ্বংস করছিল। তাকে আল-রশিদ সড়ক অতিক্রম করতে হয়েছিল, যেখানে বড় শিপিং কনটেইনার দিয়ে একটি অস্থায়ী সীমান্ত স্থাপন করা হয়েছিল। তিনি সব দেখে স্তব্ধ হয়ে যান। সেখানে একটি মেয়ে ও দুটি ছেলেকে দেখতে পান, যারা আলজেরিয়ার শিক্ষার্থী ছিলেন।
মেয়েটির সঙ্গে একটি ভারি ব্যাগ ছিল। সেটা টানতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। কামেল সেটি বয়ে নিয়ে যান। ছেলেরা কামেলের আগে কনটেইনারে প্রবেশ করে। ভেতরে একটি ক্যামেরা ছিল। কনটেইনারের বাইরে ট্যাংক ও জিপসহ কয়েক ডজন সেনা ছিল।
ছেলেগুলো পার হয়ে যাওয়ার পর ইসরাইলি সেনারা তাদের ধরে ফেলে। সেনারা ওই দুই ছেলেকে তাদের কাপড় খুলতে বাধ্য করে, তাদের ব্যাগ নিয়ে যায় এবং তাদের আটক করেছে। এসব দেখে মেয়েটা কাঁদতে থাকে। কামেল তাকে ফিসফিস করে বলেন, ‘আমাদের ভান করতে হবে যে আমরা স্বামী-স্ত্রী, একটি পরিবার।’
তারা হাত ধরে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকেন। সেনা সদস্যরা তাদের ডাকেনি। রাত হওয়ার আগে তারা প্রায় ৯ কিলোমিটার হেঁটেছেন এবং নুসিরাতের দক্ষিণে পৌঁছান। এরপর মেয়েটি কোথায় গেছেন বা কী করছেন তা জানেন না কামেল।
কামেল তার চাচার বাড়িতে দুই রাত অবস্থান করেন। তারপরে রাফাহ যান। সেখানে কল্পনাতীত সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। কামেল বলেন, ইসরাইল যদি রাফাহ আক্রমণ করে এবং উত্তর গাজার মতো বোমা বর্ষণ করে, তাহলে একদিনেই সেটা গণহত্যা হবে।
তিনি মিশরের ‘সিক্সথ অব অক্টোবর সিটি’তে পৌঁছে তার চাচাকে জানান, যিনি ২৫ বছর আগে কায়রোতে চলে গিয়েছিলেন। চাচা তাকে নিজের বাসায় নিয়ে যান।
তিনি ফরিদপুরে তার কলেজকে জানান যে তিনি কায়রোতে পৌঁছেছেন এবং তারা গালফ এয়ারে তার জন্য একটি ফ্লাইট বুক করেন। ইন্টারনেট পরিষেবা সীমিত থাকলেও পরিবারকে কল করেও নিজের খবর দিতে পেরেছিলেন কামেল। তারাও সবাই তখনো বেঁচে আছেন।
চলমান হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অর্ধাহার-অনাহারে আকরামের ওজন কমেছে অন্তত ২৫ কেজি। এটা ২৬ এপ্রিল তোলা ছবি। একই দিন বাংলাদেশের ফরিদপুরে বসে নিজের রুমমেটের সঙ্গে খাওয়ার জন্য মাকলুভা রান্না করেছেন কামেল। কিন্তু সেই খাবার আর তার গলা দিয়ে নামেনি।
৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, কামেলের পরিবারের সবাই বেঁচে আছেন। তিনি চলে আসার পর থেকে তাদেরকে তিনবার জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে। কামেল তার ১৩ আত্মীয় ও আট বন্ধুকে হারিয়েছেন। একবার তিনি খবর পান যে বেইত হনৌনে বোমা হামলা হয়েছে। পরিবারের জন্য উদ্বিগ্ন কামেলের সারাটি রাত কাটে নির্ঘুম। রাতভর তিনি গাজায় বিভিন্ন সাংবাদিক ও পরিচিতদের কল করেন।
কামেল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, তাদেরকে যদি এখানে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারতাম।