গৃহশিক্ষিকার প্রতিহিংসার বলি সিলেটের শিশু মুনতাহা
সিলেট অফিস :
নিখোঁজের ৭ দিন পর বাড়ীর পাশের খালে মিলেছে শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের (৬) লাশ। ফুটফুটে শিশু মুনতাহার সন্ধানের আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন পরিবারসহ দেশের মানুষ। কিন্তু‘ শেষ পর্যন্ত বাড়ির পাশ থেকেই তার অর্ধগলিত লাশ হয়েছে। এমন নৃশংস ঘটনায় বাকরুদ্ধ এলাকার মানুষ। মা-বাবাসহ আত্মীয় স্বজনের কান্নায় ভারী হচ্ছে কানাইঘাটের বাতাস। কতটা পাষাণ হলেও একটা নিষ্পাপ শিশুর সাথে এমন ঘৃণ্য আচরণ করতে পারে এমনটা ভেবে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শঙ্কিত বিবেকবাণ মানুষ।
যেভাবে উদ্ধার হয় লাশ:
রোববার রাত সাড়ে ৩টার দিকে নিজ বাড়ির পার্শ্ববর্তী খালে পুতে রাখা মুনতাহার লাশ উঠিয়ে প্রতিবেশীর পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে গলায় রশি পেঁচানো মুনতাহার লাশসহ আলিফজান বিবিকে আটক করেন স্থানীয়রা। মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে কানাইঘাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে একই বাড়ির মৃত ময়না মিয়ার স্ত্রী আলিফজান বেগম (৫৪), বৃদ্ধ কুতুবজান বেগম (৭০) কে পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন মুনতাহার লাশ পাওয়ার পর হত্যাকারী আলিফজান বিবি’র বসত ঘরটি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে সবকিছু পুড়িয়ে দেয়।
এর আগে মুনতাহার পরিবারের সন্দেহের আলোকে কানাইঘাট থানা পুলিশ শনিবার গভীর রাতে প্রতিবেশী আলিফজান বিবি’র মেয়ে নিখোঁজ মুনতাহার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়াকে আটক করে পুলিশ। মার্জিয়াকে থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের ভয়ে আলিফজান বিবি তাদের বসতঘরের পাশে একটি নর্দমায় পুতে রাখা নিখোঁজ মুনতাহার লাশ তুলে রাত সাড়ে ৩টার দিকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের পুকুরে ফেলার চেষ্টার সময় আব্দুল ওয়াহিদসহ আরো কয়েকজন হাতেনাতে আলিফজান তাকে আটক করেন।
শিশু মুনতাহার হত্যার ঘটনায় কানাইঘাট থানা পুলিশ রোববার বিকেল পর্যন্ত বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫), তার মা আলিফজান বিবি (৫৫), প্রতিবেশী মৃত ছইদুর রহমানের পুত্র ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুনুর রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৫) কে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছেন কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আওয়াল।
জানা যায়, গত ৩ নভেম্বর দুপুরবেলা শিশু মুনতাহা জেরিন তার বাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের বাড়ির শিশুদের সাথে খেলতে যায়। ঐদিন বিকেল পর্যন্ত শিশু মুনতাহা বাড়িতে ফিরে না আসায় তার সন্ধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় পরিবার। খোঁজাখুজি করে না পেয়ে পরদিন ৪ নভেম্বর মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় মেয়ে নিখোঁজের একটি জিডি করেন।
এদিকে মুনতাহা নিখোঁজের পর থেকে র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তার আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার সবাই সম্ভাব্য সব জায়গায় তার খোঁজ করতে থাকেন। ফুটফুটে সুন্দর শিশু মুনতাহা নিখোঁজের সংবাদ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশের মানুষ নিখোঁজ মুনতাহাকে ফিরে পেতে ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দেন এবং অনেকে স্বেচ্ছায় খোঁজাখুজি করতে থাকেন। এমনকি কেউ কেউ সন্ধানদাতাকে নগদ টাকা স্বর্ণালংকার উপহার দেয়ার ঘোষণা দেন। সকলের প্রত্যাশা ছিলো নিখোঁজ মুনতাহার সন্ধান পাওয়া যাবে, সে জীবিত অবস্থায় তার বাবা-মা’র কোলে ফিরে আসবে। সেই সূত্র ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ফিরে পেতে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ডাটাবেজ ধরে প্রযুক্তির আশ্রয় নেন। শেষ সময়ে এক মার্জিয়াকে আটকের পর মুনতাহা নিখোঁজের রহস্য উন্মোচিত হলো। শেষ পর্যন্ত নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর নিজ বসতবাড়ির আলিফজান বিবি’র বসতঘরের পাশে নর্দমায় পুতে রাখা মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
যেভাবে খুন করা হয় মুনতাহাকে :
শিশু মুনতাহার এক সময়ের গৃহ শিক্ষিকা ছিল আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা আক্তার মার্জিয়া। কিন্তু মার্জিয়ার খারাপ আচরণের কারণে শামীম আহমদ তার মেয়েকে পড়াতে নিষেধ করেন। এতে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠে মার্জিয়া। মুনতাহার বাবা-মা’র উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গত ৩ নভেম্বর নিখোঁজের দিন মুনতাহাকে কৌশলে মার্জিয়া ও তার মা আলিফজান বিবি তাদের বসতঘরে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পর মুনতাহার মুখের মধ্যে ওড়না ঢুকিয়ে ও গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে প্রথমে লাশ বস্তাবন্দী করে ঘরের মধ্যে রাখেন তারা। এরপর গভীর রাতে হত্যাকারীরা মুনতাহার লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে বসতঘরের পাশে খালের নর্দমায় পুতে রাখেন। একাধিকবার মুনতাহার পরিবারের লোকজন মার্জিয়াসহ তার পরিবারের কাছে মুনতাহা নিখোঁজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা একেক সময় একেক ধরণের কথা বলতে থাকে। মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে শনিবার রাতে থানা পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। মার্জিয়াকে থানায় নেয়ার পর তার মা আলিফজান বিবি নিহত মুনতাহার পুতে রাখা লাশ তুলে নিয়ে পার্শ্ববতী বাড়ির পুকরে ফেলার চেষ্টাকালে তাকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয়রা। তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলিফজান বিবি ও তার মা কুতুবজান বিবিকে আটক করে থানায় নিয়ে যান।
এদিকে আটক আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে শামিমা বেগম মার্জিয়ার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত স্থানীয় বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের মৃত ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুন রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩০) কে রোববার গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত ৪ জনকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল জানিয়েছেন- শিশু মুনতাহাকে পৈচাশিক কায়দায় হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আলিফজান, মার্জিয়া, ইসলাম উদ্দিন ও নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পরিদর্শনে সিলেট পুলিশ সুপার:
এদিকে রোববার বিকেল ২টার দিকে সিলেটের পুলিশ সুপার মোঃ মাহবুবুর রহমান নিহত মুনতাহার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনকে শান্তনা প্রদান। তিনি হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেন। এসময় স্থানীয় লোকজন হত্যাকারীদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবী জানান।
পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান জানান, শিশু মুনতাহাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। মুনতাহার হত্যাকারী ৪ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ হত্যাকান্ডের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের প্রত্যেককে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এসময় পুলিশ সুপারের সাথে ছিলেন- সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, কানাইঘাট সার্কেলের এএসপি অলক কান্তি শর্মা ও থানার ওসি আব্দুল আউয়াল।
জানাযা ও দাফন :
উদ্ধারের পর শিশু মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে পুলিশ। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে মুনতাহার বাড়িতে নেয়ার পর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এসময় উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। রোববার বাদ আসর বীরদল পুরানফৌদ জামে মসজিদে জানাজা শেষে গ্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে মুনতাহার লাশ দাফন করা হয়েছে।