ইসলাম যেভাবে মানুষের চিন্তার পরিবর্তন এনেছে
আতাউর রহমান খসরু
একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে মানুষের মানসিক ও চিন্তাগত পরিবর্তন অপরিহার্য। কেবল আইন ও কাঠামোগত পরিবর্তন কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্য ইসলাম মানুষের চিন্তাগত পরিবর্তনকে প্রাধান্য দেয়। মহানবী (সা.)-এর নববী জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি নবুয়তের প্রথম ১৩ বছর দ্বিনি দাওয়াতের মাধ্যমের মানুষের মানসিক ও চিন্তাগত পরিবর্তনে কাজ করেছেন।
চিন্তার পরিবর্তন দ্বারা উদ্দেশ্য
ইসলাম মানুষের চিন্তার জগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে বলে। যে পরিবর্তনের মূলভিত্তি হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান ও আনুগত্য। আহমদ আনোয়ার সাঈদ আহমদ জিন্দি লেখেন, মুসলমানের জন্য চিন্তার পরিবর্তনের অর্থ হলো তাদের ভেতর আল্লাহর আনুগত্য, ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামের মানবিক শিক্ষা ও সাম্যের বাণী গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করা। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব ও আঞ্চলিক অনৈসলামিক প্রভাবগুলো পরিহার করা।
দ্বিন ইসলামকে গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সম্মত করা। (তাসহিহুল মাফাহিম, পৃষ্ঠা-২০-২১)
চিন্তার পরিবর্তন কেন প্রয়োজন
কোরআন ও হাদিসে মানুষের চিন্তাগত পরিবর্তনের ব্যাপারে নানাভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যেমন—
১. আল্লাহ মনের অবস্থা দেখেন : আল্লাহ মানুষের মনের অবস্থা দেখেন এবং সে হিসেবেই তার আমলের প্রতিদান দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের অবয়ব ও সম্পদ দেখেন না, কিন্তু তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।
’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)
২. ঈমান পূর্ণ হয় না : ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন না হলে তার ঈমান পূর্ণ হয় না। এ জন্য পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বেদুইনরা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। বলো, তোমরা ঈমান আনোনি, বরং তোমরা বলো, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। কেননা ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৪)
৩. আনুগত্য পাওয়া যায় না : মানসিক পরিবর্তন ছাড়া ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় না।
তারা আইন মান্য করতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৬৫)
৪. কপটতা থেকে যায় : মানসিক পরিবর্তন না এলে মানুষের ভেতরে কপটতা থেকে যায়, যা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধক। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনেছি, কিন্তু তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহ ও মুমিনদের প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদের ছাড়া কাউকে প্রতারিত করে না, তা তারা বুঝতে পারে না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৮-৯)
৫. বিশৃঙ্খলার ভয় থাকে : মানুষের চিন্তাগত পরিবর্তন না এলে ইতিবাচক কাজেও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থেকে যায়। এ জন্য নবীজি (সা.)-এর ইচ্ছা থাকার পরও তিনি ইবরাহিম (আ.)-এর অবকাঠামো অনুসারে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণ করেননি। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমার কি জানা নেই যে তোমার সম্প্রদায় কুরাইশ কাবা তৈরি করেছে এবং ইবরাহিম (আ.)-এর ভিত্তির থেকে ছোট নির্মাণ করেছে? আমি [আয়েশা (রা.)] তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি ইবরাহিম (আ.)-এর ভিত্তির ওপর কাবাকে আবার নির্মাণ করবেন না? তিনি বলেন, যদি তোমার গোত্রের কুফরির যুগ নিকট অতীতে না হতো (তবে আমি করতাম)। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৪৮৪)
চিন্তার পরিবর্তনে নবীজি (সা.)
মহানবী (সা.) ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। মানুষের মনমানসিকতা, চিন্তা-ভাবনা ও কর্মধারায় তিনি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন আনেন। বিখ্যাত সাহাবি জাফর বিন আবি তালিব (রা.)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে যে পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি হাবশার বাদশাহর দরবারে বলেন, হে বাদশাহ! আমরা ছিলাম এক মূর্খ জাতি, আমরা মূর্তি পূজা করতাম, মৃত জীব ভক্ষণ করতাম, সর্বপ্রকার নির্লজ্জতা ও পাপে লিপ্ত ছিলাম, আমাদের মধ্যে যারা সবল ও শক্তিশালী তারা দুর্বলদের ছিঁড়ে খেতাম। তিনি আমাদের দাওয়াত দিলেন এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে এবং কেবল তাঁর ইবাদত করতে। তিনি আমাদের সত্য কথা বলতে, আমানত আদায় করতে, আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখতে, প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে, হারাম কথাবার্তা ও রক্তপাত ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-১৪২)
চিন্তার পরিবর্তনে মহানবী (সা.)-এর কর্মসূচি
মানুষের মানসিক ও চিন্তার পরিবর্তন এবং সামাজিক পরিবর্তন সাধনে মহানবী (সা.) চারটি ঐশী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তাহলো— ১. কোরআনের পাঠ দান, ২. আত্মিক পরিশুদ্ধি, ৩. ধর্মীয় জ্ঞানের প্রসার, ৪. প্রয়োজনীয় জাগতিক জ্ঞানের চর্চা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই উম্মিদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতগুলো, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; যদিও ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ২)
ইসলাম যেভাবে চিন্তার পরিবর্তন এনেছে
ইসলাম আগমনের আগে সমগ্র পৃথিবীর চিন্তাগত নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল। ইসলাম এই মানসিক ও চিন্তাগত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে একটি আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ইসলাম যে পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো—
১. নারীদের জন্য সুসংবাদ : ইসলামপূর্ব জাহেলি সমাজে নারীর প্রতি মানুষের মনোভাব ছিল নিম্নরূপ : ‘তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৫৮)
আল্লাহ তাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন সাধনে ঘোষণা করেন, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা; তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৪৯-৫০)
২. বর্ণবাদের অবসান : বর্ণবাদ বহু প্রাচীন মানসিক সমস্যা। আরব সমাজে এই সমস্যা ছিল প্রকট, এমনকি তারা অনারবদের আজমি তথা বোবা বলত। এর বিরুদ্ধে ইসলামের ঘোষণা হলো, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
৩. সম্পদ মর্যাদার মাপকাঠি নয় : প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সম্পদই সামাজিক মর্যাদা ও আধিপত্যের মাপকাঠি বিবেচিত, যা মানবিক মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। ইসলাম সম্পদের ক্ষণস্থায়িত্ব বর্ণনা করে এই ভ্রান্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়েছে এবং আল্লাহভীতিকে মর্যাদার মাপকাঠি ঘোষণা করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা; এবং স্থায়ী সত্কর্ম তোমার প্রতিপালকের কাছে পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং কাঙ্ক্ষিত হিসেবেও উত্কৃষ্ট।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৪৬)
৪. মানসিক সংকীর্ণতা অগ্রহণযোগ্য : সম্পদের মোহ-মায়া বহু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকটের কারণ। ইসলাম মানুষের মানসিক সংকীর্ণতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই অন্তরের ধনাঢ্যতাই প্রকৃত ধনাঢ্যতা এবং অন্তরের দারিদ্র্যই প্রকৃত দারিদ্র্য। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৬৮৫)
৫. কুসংস্কার পরিহার করা : ইসলামপূর্ব আরব সমাজ নানা কুসংস্কারে ন্যুব্জ ছিল। ইসলাম ধর্মে কুসংস্কারের কোনো জায়গা নেই। মহানবী (সা.) বলেছেন, রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই এবং পাখি ওড়াতে কোনো শুভ-অশুভ নেই আর আমার নিকট ‘ফাল’ পছন্দনীয়। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন ‘ফাল’ কী? তিনি বললেন, ভালো কথা। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৭৬)
৬. কৌলিন্যের জায়গা নেই : ইসলামে কৌলিন্যের কোনো জায়গা নেই। ইসলামী সমাজে সবাই ভাই ভাই। সবাই সবার প্রতি অকৃপণ সৌজন্য প্রদর্শন করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সালাম প্রদানে যে কৃপণতা করে সে সবচেয়ে বড় কৃপণ। আর যে সালামের উত্তর দেয় না সে প্রতারিত; যদিও তোমার ও তোমার ভাইয়ের মধ্যে কোনো গাছ প্রতিবন্ধক হয়। যদি তুমি অন্যের আগে প্রথম সালাম দিতে পারো, তবে তাই করো।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১০১৫)
৭. দুর্বলরা বোঝা নয় : সমাজের দুর্বল ও অসহায় মানুষের অধিকার নিশ্চিত না হলে সামাজিক ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি নিশ্চিত করা যাবে না। ফলে ইসলাম দুর্বলদের প্রতি মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে এবং তাদের দায় গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের সাহায্য করা হয় এবং জীবিকা দেওয়া হয় তোমাদের দুর্বলদের জন্য।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৯৬)
আল্লাহ সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।