গণপিটুনিতে ২০২৩ সালের চেয়ে বিদায়ী বছরে দ্বিগুণ নিহত
পোস্ট ডেস্ক :
২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ‘মব জাস্টিস’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে হওয়া বিচার)-এর নামে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাগুলো ছিল উদ্বেগজনক। মঙ্গলবার ২০২৪ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে আসক এমনটি জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই নিহত হয়েছেন ৫৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ জন, খুলনা বিভাগে ১৪ জন, বরিশাল বিভাগে ৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫ জন, রংপুর বিভাগে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ৪ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন। ‘মব জাস্টিসের’ প্রসঙ্গ তুলে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি সমালোচনার ঝড় তোলে। চলমান পরিস্থিতিতে পিটিয়ে হত্যা বা মব জাস্টিজের মতো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা ও কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। ৭ই সেপ্টেম্বর রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে। বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে তার ওপর হামলা হয়। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর হাসপাতালে নেয়া হলে মধ্যরাতে তিনি মারা যান। মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হয়ে তিনি ডান পা হারিয়েছিলেন। বাঁ পা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তখন। তিনি কৃত্রিম পা নিয়ে চলাফেরা করতেন।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমে এলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। এমনকি এ ক্ষেত্রে অভিযোগগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২১ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে পুলিশ হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে ৬ জন, পুলিশের গুলিতে ৩ জন, পুলিশ হেফাজতে ১ জন আত্মহত্যা করেছে, র্যাবের হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে ১ জন, বিজিবির ক্রসফায়ারে ১ জন, যৌথ বাহিনীর হেফাজতে গ্রেপ্তারের ও পরে শারীরিক নির্যাতনে ৭ জন, নৌবাহিনীর নির্যাতনে ১ জন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হেফাজতে ১ জনের মৃত্যু ঘটে। এই ২১ জনের মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনে নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা সাজা নিষিদ্ধ হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এমন চর্চায় বা আচরণে জড়িত ছিলেন। নির্যাতনের অনেক ঘটনা সংঘটিত হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে। থানাগুলোতে আটক ব্যক্তিদের জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেয়ার জন্য ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মোট ৮৫৮ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১১ হাজার ৫৫১ জন। পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্রে আসক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন নারী এবং ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু-কিশোর রয়েছে ১২৯ জন। জুলাই অভ্যুত্থানে বিশেষত নিজ বাসায় গুলিতে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো অত্যন্ত মর্মান্তিক। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী রয়েছেন।
আসকের হিসাব অনুযায়ী ২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সমপ্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ১৪৭টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৪০৮টি বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে ৩৬টিতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে ১১৩টিতে, মন্দির ও আহমদিয়া সমপ্রদায়ের মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩২টি, হিন্দু সমপ্রদায়ের মন্দিরে ৯২টি প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এসব ঘটনায় হিন্দু সমপ্রদায়ের ৩ জন এবং আহমদিয়া সমপ্রদায়ের ১ জন নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে; আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৮২ জন।
আসক বলেছে, বিগত বছরগুলোর মতো ২০২৪ সালেও সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই তংগোঝিরি এলাকায় ২৪শে ডিসেম্বর গভীর রাতে পূর্ব-বেতছড়াপাড়ার ১৭টি ত্রিপুরা পরিবারের ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে। গ্রামবাসীর অভিযোগ, এর আগে তাদের কাছে দুর্বৃত্তরা চাঁদা দাবি করেছিল। এরপর বসতবাড়িতে আগুনের ঘটনা ঘটে।