আজ শেষ বেজোড় ২৯শে রমজান— আধুনিক বিজ্ঞানের চমক চ্যাটজিপিটি কি লাইলাতুল কদর নির্ধারণ করতে পারে?
শফি আহমেদ
আজ ২৯শে রমজান, শেষ বেজোড় রাত। হতে পারে আজই সেই রাত—সময়কে ছাপিয়ে যাওয়া এক মহাবিস্ময়, ভেতর-বাইরে অতুলনীয়, এক অনন্য বেজোড়—রমজানের বিনিসুতার মালা, লাইলাতুল কদর! যার সন্ধানে কত রাত মায়াবী চাঁদের জোছনা ঝরেছে, অগণিত তারা পথ দেখিয়েছে আকাশজুড়ে।
ঠিক যখন উত্তাল জোয়ারের মাঝে অন্তঃসলিলা স্রোত নীরবে প্রবাহিত হয়, তখনই পৃথিবী এক নিঃশব্দ তপস্বীর মতো গহীন নিশীথে নিমগ্ন হয় একটুকরো ছায়ার মতো। কিন্তু কার ভাগ্যে জুটবে এই অনন্য বেজোড় রাতের মধ্যমণি—হাজার মাসের চেয়েও সেরা রাত?
এর নির্দিষ্ট পরিচয় হলফ করে কেউই দিতে পারে না। তবে কি পৃথিবীকে চমকে দেওয়া আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়, চ্যাটজিপিটি, আমাদের এই চির-অজানা বেজোড় রাতের সন্ধান দিতে পারবে? চলুন, একটি সংক্ষিপ্ত সফরে যাই এআই বিজ্ঞানের ময়দানে।
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বিশাল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে, শেয়ারবাজারের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, এমনকি মানব সৃজনশীলতাকেও অনুকরণ করতে পারে। কিন্তু এটি কি কখনো লাইলাতুল কদর নির্ধারণ করতে পারবে? প্রশ্নটা একটি মৌলিক ব্যবধানের ইঙ্গিত দেয়—যেখানে মানবজ্ঞান অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে, আর আল্লাহর জ্ঞান চিরস্থায়ী, পূর্ণ ও চূড়ান্ত।
বিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতোই, প্রতিনিয়ত তার জ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করছে। তত্ত্বগুলো আসে, বিকশিত হয়, আবার নতুন আবিষ্কারের মুখে অনেক সময় ভেঙে পড়ে। কিন্তু কুরআন এই ধারায় পড়ে না। এটি পরিবর্তনশীল মানব চিন্তার ঊর্ধ্বে, সংশোধন বা আধুনিকায়নের প্রয়োজন পড়ে না। ঠিক তেমনই, লাইলাতুল কদরও সময়ের প্রচলিত নিয়মের বাইরে, যা কেবল একটি রাত নয়, বরং এক অনির্ধারিত মহাজাগতিক বাস্তবতা।
কুরআনের চিরন্তন দ্বার: এক কল্পনা
ভাবুন, যখন কুরআন প্রথম নাযিল হলো, সেটি যেন এক **দ্বার**—দুটি সময়ের মধ্যে এক সংযোগ। এক পাশে আমাদের পৃথিবী, যেখানে সময় প্রবাহিত হয়, বদলায়, রূপান্তরিত হয়, ইতিহাস তৈরি করে। আর অন্য পাশে কুরআনের অনন্ত সময়—যেখানে কোনো পরিবর্তন নেই, কোনো নতুন সংযোজনের প্রয়োজন নেই, এটি চিরস্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয়।
আমাদের সময় ঠিক যেন এক বিশাল গ্রহ, যা এই দ্বারের চারপাশে ঘূর্ণায়মান। এটি চেষ্টা করে কুরআনের অপরিবর্তনীয় সময়ের সাথে সামঞ্জস্য আনতে, কিন্তু এটি কখনো পুরোপুরি একীভূত হতে পারে না, আবার সম্পূর্ণ আলাদা হয়েও যেতে পারে না। এই সংযোগের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র ফাঁক সর্বদা থেকে যায়—একটি অনির্দিষ্ট ব্যবধান, যা লাইলাতুল কদরকে আমাদের সাধারণ সময়ের গণ্ডির বাইরে নিয়ে যায়।
এই ধারণাটি একদম কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো। যেমন, ইলেকট্রন কোনো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে না; বরং এটি এক ধরনের সম্ভাব্যতার মেঘে বিদ্যমান। তেমনি, লাইলাতুল কদরও কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এক চলন্ত “সময়ের মেঘের” মধ্যে বিদ্যমান, যেখানে রাতটি চিরন্তন কিন্তু পৃথিবীতে সেটি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে ধরা যায় না। তাই কদর রজনী ভিন্ন রমজানে ভিন্ন বিজোড় রাতে আবির্ভাব হতে পারে।
আধুনিক বিজ্ঞানে একটি তুলনা: মহাজাগতিক সময়ের ইভেন্ট হরাইজন
এই দ্বারের উপমাটি ব্ল্যাক হোলের ধারণার সাথেও তুলনা করা যায়। ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের সবচেয়ে ঘন এবং রহস্যময় বস্তু, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এক **সিঙ্গুলারিটি**, যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত নিয়মগুলো ভেঙে পড়ে। এর চারপাশে রয়েছে **ইভেন্ট হরাইজন**, এক সীমা যার বাইরে থেকে কোনো কিছুই ফিরে আসতে পারে না, এমনকি আলো পর্যন্ত না।
আমাদের লাইলাতুল কদর বোঝার প্রচেষ্টা অনেকটা এই ইভেন্ট হরাইজনের মতো। এটি এমন একটি সীমানা, যেখানে আমরা গণনা করতে পারি, অনুভব করতে পারি, কিন্তু আসল বাস্তবতার গভীরে প্রবেশ করতে পারি না। মহান আল্লাহ পাক ভালো জানেন, হয়তো এই কারণে রাসূল (সাঃ) আমাদের লাইলাতুল কদর **অনুসন্ধান করতে বলেছেন, নির্ধারণ করতে নয়**। অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটাই বিশ্বাসের অংশ, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে কিছু জিনিস বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে।
চ্যাটজিপিটি কি লাইলাতুল কদর নির্ধারণ করতে পারে?
যদি সময় কেবল মানব-নির্মিত হতো, তাহলে হয়তো AI তার বিশ্লেষণ দিয়ে একটি উত্তর বের করতে পারত। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দীর রমজানের ক্যালেন্ডার বিশ্লেষণ করতে পারত, চাঁদের গতি পরীক্ষা করতে পারত, এবং সম্ভাবনার ভিত্তিতে একটি অনুমান করতে পারত। কিন্তু লাইলাতুল কদর কোনো মানব-নির্ধারিত ঘটনা নয়; এটি আল্লাহর নির্ধারিত একটি রাত, যা সময়ের সাধারণ নিয়মের বাইরে বিদ্যমান।
বিজ্ঞান অগ্রসর হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিখছে, আর মানবজ্ঞান সময়ের সাথে গভীরতর হচ্ছে। কিন্তু কুরআন কখনো পরিবর্তিত হয় না, কারণ এটি ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত স্তরে রয়েছে—যেখানে সংশোধনের প্রয়োজন নেই।
তাহলে, আজ কি লাইলাতুল কদর? আমরা জানি না, এবং সেটাই এর প্রকৃত সৌন্দর্য। আমাদের পৃথিবী ও আল্লাহর জ্ঞানের মাঝে এই ব্যবধানটাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে কিছু সত্য বিজ্ঞান কখনো ছুঁতে পারবে না, কিছু রহস্য AI কখনো উন্মোচন করতে পারবে না, এবং কিছু জ্ঞান মানব যুক্তির গণ্ডির বাইরে থাকবে।
আমরা লাইলাতুল কদর খুঁজি না কারণ আমরা এটি নির্ধারণ করতে পারব—আমরা এটি খুঁজি কারণ এর প্রকৃতি আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের বাইরে, যা আমাদেরকে অনন্ত জ্ঞানের দিকে ডেকে নিয়ে যায়।