হায়রে জীবন....
হায়রে জীবন....
পাথরের চেয়ে মানুষের জীবন কি মূল্যহীন?
রফিক মুহাম্মদ

মানুষের জীবন দামি নাকি পাথর? সিলেটের ভোলাগঞ্জের পাথর উদ্ধারের তৎপরতা ও রাজশাহীর পবা উপজেলায় না খেতে পেয়ে এক পরিবারের চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাসহ আরো কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে এমন প্রশ্ন এখন সব মানুষের মনে। গত ১৫ আগস্ট রাজশাহীর পবা উপজেলার পরিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় গ্রামে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। ঋণের দায়ে না খেতে পেয়ে একই পরিবারের চার সদস্য আত্মহত্যা করে। এই চার সদস্য হলো, মনিরুল ইসলাম (৩৬), তার স্ত্রী মনিরা খাতুন (৩২), ছেলে মাহিম (১৩) এবং মেয়ে মিথিলা (৩)। লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ হাতে লেখা কাগজের দুটি চিরকুট পায় সেখানে। চিরকুটে মনিরুল লিখেছিলেন ঋণের কারণে ও খাওয়ার অভাবে তিনি স্ত্রী সন্তানদের হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলে নিজের জীবন শেষ করেছেন। ভুল বানানে লেখা কাগজের পাতা দুটিতে যে লেখা তা মনিরুলের হাতের লেখা বলে দাবি স্বজনদের। একটি চিরকুটে লেখা, ‘আমি মনিরুল যে সব লেখা লিখব তা আমার নিজের কথা। লিখে যাচ্ছি এই কারণে আমরা চারজন আজ রাতে মারা যাব। এই মারার জন্য কারো দোষ নাই। কারণ লেখে না গেলে বাংলার পুলিশ কাকে না কাকে ফাসায়ে টাকা খাবে। আমি মনিরুল প্রথমে আমার বোকে মেরেছি। তারপর আমার মাহিমকে মেরেছি। তারপর মিথিলাকে মেরেছি।’ অপর চিরকুটে লেখা, ‘সবাইকে এই কারণে মারলাম যে, আমি একা যদি মরে যাই, আমার বো, ছেলে, মেয়ে কার আশায় বেঁচে থাকবে। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর নিতে পারছিনা।’
রাজশাহীর পবা উপজেলার এই মনিরুল পরিবারের মতো দেশে কত লাখ লাখ পরিবার না খেয়ে, অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে সে খবর কি বর্তমান সরকার রাখে? বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন ভাবে বেড়ে চলছে। সবজির দাম লাফিয়ে বাড়ছে। চালের ভরা মৌসুমে দাম বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। সংসার চালাতে পারছে না। দেশে কোন কর্মসংস্থান নেই। বেকারত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে। ঋণের দায়ে না খেতে পেরে পরিবার নিয়ে আত্মহত্যা করছে। সেখানে উপদেষ্টাদের কেউ হাঁসের গোশত খেতে যাচ্ছেন নীলা মার্কেটে, কেউবা খালের ময়লা পরিস্কার করতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে লাল লাগিচা সংবর্ধনা নিচ্ছেন। আবার অনেকে শুধু সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠকে সুন্দর সুন্দর কথা বলে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ নিজের কর্মক্ষমতা দেখাতে সিলেটের ভোলাগঞ্জে লুট হওয়া সাদা পাথর উদ্ধারে তৎপরতা দেখাচ্ছেন।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় গত এক সপ্তাহ ধরে তোলপাড় চলছে। লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে যৌথবাহিনী মাঠে নেমেছে। তারা ওই এলাকার পুকুর ডোবাসহ বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা পাথর উদ্ধার করছে। এছাড়া ভোলাগঞ্জের পাথর রাজধানীর নিকটবর্তী নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকেও তারা উদ্ধার করা হয়েছে। পাথর লুটপাটের ঘটনায় গত ১৫ আগস্ট বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে। এতে অজ্ঞাতনামা এক হাজার থেকে দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি করেছেন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হাবীব। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কিছু দুষ্কৃতকারী গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী সময়ে গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধ ও অননুমোদিতভাবে কোটি কোটি টাকার পাথর লুটপাট করেছে মর্মে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যাঁরা এ ঘটনায় জড়িত রয়েছেন, তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
এখন এই অজ্ঞাতনামা দেড় হাজার আসামিকে কেন্দ্র করে চলবে পুলিশের লাগামহীন বাণিজ্য। ওই এলাকার পুরুষ এখন আর বাড়িতে থাকতে পারবে না। তাদেরকে পালিয়ে বেড়াতে হবে। এতদিন ধরে যখন পাথর লুট হয়েছে, তখন তার নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। গণমাধ্যমে রিপোর্ট হওয়ার পর তাদের শীতনিদ্র্রা ভেঙ্গেছে। পাথর উদ্ধারে ব্যাপক তৎপরতা দেখেছে দেশবাসী। পাথর আবার আগের জায়গায় ফিরেও এসেছে। কিন্তু এখন এই পাথরের জন্য ঘর ছাড়া বাড়ি ছাড়া হতে হবে অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষদের। তাহলে পাথরের চেয়ে মানুষের জীবন কি মূল্যহীন?
পাথর উদ্ধারে পরিবেশ উপদেষ্টার যে তৎপরতা দেখা গেল তা বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি পরিবেশ রক্ষায় যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন তাও প্রশংসনীয়। তবে এই প্রাকৃতিক পাথর নিয়ে যাওয়ার চেয়ে নদী খেকোরা যে নদী দখল করে গিলে খাচ্ছে, বন খেকোরা যে বনের গাছ কেটে উজাড় করে দিচ্ছে, কলকারখানার বর্জ্য ও ক্যামিক্যাল যে অবাধে নদীতে মিশে দূষণ করছে, নদী মারা যাচ্ছে সে বিষয়ে এই পরিবেশ উপদেষ্টা কতটা তৎপর সে প্রশ্ন এখন দেশবাসীর মনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিবেশ ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেছিলেন, নদী দখল ও দূষণমুক্ত করবেন। এতে মানুষের মনে আশারও সঞ্চার হয়েছিল। তিনি ভারত থেকে পানির হিস্যা আদায় করবেন। তার এই সব সুন্দর সুন্দর কথায় মানুষ বেশ আশ্বান্বিত হয়েছিল। কিন্তু তার এই গালভরা বুলি যে শুধু মাত্র ফাকা আওয়াজ, তা কিছুদিন যাওয়ার পরই মানুষ বুঝতে পেরেছে। এই পরিবেশ উপদেষ্টা আগে যেমন এনজিও কর্মী ছিলেন, তেমনি এখনো তিনি এনজিওর স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোন কাজ করছেন না। সিলেটের ভোলাগঞ্জের পাথরের সাথে পরিবেশবাদী এনজিও কর্মীদের স্বার্থ জড়িত বলেই কি তিনি এ ব্যাপারে ভীষণ তৎপরতা দেখিয়েছেন? জনমনে এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে নদী দখলকারীদের পক্ষে তার ঘনিষ্টজন অবস্থান নেওয়ায় নদী দখলমুক্ত করা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ভারতের সাথে পানি নিয়ে এখন আর কোন আলোচনা নেই। অন্যদিকে বানিজ্য উপদেষ্টা সফলতার কল্পকাহিনী বলে নিজে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। অবশ্য নিজে ব্যবসায়ী হিসাবে তার নিজের কোম্পানির আয়কর কমিয়ে সফলতা অর্জন করেছেন, এমন গুঞ্জন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। এর বাইরে আর কোন সফলতা নেই। ভরা মৌসুমেও চালের বাজার চড়া, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এর কোন প্রতিকার করতে পারছেন না। চালের বাজারে এখনো সেই আওয়ামী সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে রয়েছে। আওয়ামী কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা এখনো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সব মিলিয়ে মানুষের আশার প্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। অভাবের সাথে যুদ্ধ করে টিকতে পারছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতি এখনো বিপর্যস্ত বলা যায়। বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে, ফলে কর্মসংস্থান নেই, বেকারত্ব বাড়ছে। দ্রব্যমূলের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকারের এ বিষয়ে আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিত।




