বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা
।।কাসেম শরীফ।।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দানকালে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা করা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না।’ (মওলানা আবদুল আউয়াল, বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ, আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০০১, পৃষ্ঠা. ২৭)
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে সৌদি আরবের তত্কালীন বাদশাহ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনারা যে মুসলমানের দেশটাকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করে ফেললেন!’
অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বর্ণনা মতে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কথাটার ব্যাখ্যায় শেখ মুজিব বলেছেন, ‘জনগণের প্রতিনিধিরাই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এর মানে রাষ্ট্রের ধর্মবিরোধিতা নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের মুসলমানরা দারুণ ধর্মপরায়ণ ও পরহেজগার। এই পটভূমিতে ধর্মনিরপেক্ষ মানে রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সমাজ বিষয়ক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে ধর্মের মাপকাঠিতে কোনো অবিচার না করার নিশ্চয়তা।’ (ইসলাম, ২০০৩ : ২৮১-২৮২)
ইংরেজি Secularism শব্দটির বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে—ধর্মনিরপেক্ষতা। বিশ্বের দেশগুলোতে তিন প্রকারের ধর্মনিরপেক্ষতার অনুশীলন দেখা দেয়, তা হলো—চরম ধর্মনিরপেক্ষতা, নির্দেশকারী ধর্মনিরপেক্ষতা আর নমনীয়/দুর্বল ধর্মনিরপেক্ষতা।
রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সেখানে চরম ধর্মনিরপেক্ষতার অনুশীলন চালু হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রই মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধান দেবে। ধর্মে মুক্তি খোঁজার প্রয়োজন নেই। সেখানে প্রকাশ্যে ধর্ম পালন নিষিদ্ধ করা হয়। বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করে।
যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নমনীয় ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা দেখা যায়। সেখানে রাজা দীর্ঘকাল যাজকের অধীনে ছিলেন। বিপ্লবের হাত ধরে সেখানে রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে রাজাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং যাজকদের রাজার অধীন করা হয়। বর্তমানে রানি ব্রিটিশ চার্চের প্রধান। আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষতা ফ্রান্স বা তুরস্কের কামালীয় উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে আলাদা। সেখানে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লিপিবদ্ধ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ‘নমনীয় ধর্মনিরপেক্ষতা’, যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার নামান্তর। দেশটির সংবিধানের শুরুতে ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে দায়িত্বভার গ্রহণের আগে রাষ্ট্রপতিকে বাইবেল ছুঁয়ে শপথ নিতে হয়। ভাষণের শেষে তাঁদের বলতে হয়—May God Bless America.
আমেরিকার মুদ্রার ওপর মুদ্রিত থাকে—In God We Trust.
নমনীয় ধর্মনিরপেক্ষতার আরেকটি উদাহরণ হলো ভারত। দেশটির সংবিধানের সূচনাতেই বলা হয়েছে, ‘এটি হবে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রিপাবলিক।’
মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, বি আর আম্বেদকার, সুভাষচন্দ্র বসু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ জাতীয় নেতা ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী ছিলেন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রধান রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে এ ধর্মনিরপেক্ষতা চরম কিংবা নির্দেশকারী ধর্মনিরপেক্ষতার পর্যায়ে পড়ে না; বরং এ চর্চা নমনীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে তুলনা করাই যুক্তিযুক্ত। কেননা বঙ্গবন্ধুর সরকারেই দেখা গেছে, তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মচর্চার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ কথাটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। এর ব্যাখ্যা বঙ্গবন্ধু নিজেই দিয়ে গেছেন। সেই ব্যাখা উপেক্ষা করে মুসলমানদের ওপর ধর্মহীনতা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন : ‘বাংলাদেশের যে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ঘোষিত হলো তা ইসলামহীন সেক্যুলারিজম নয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ইসলামসংক্রান্ত অনুষ্ঠান একটু বেশিই যেন প্রচারিত হতো। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে বিশেষ কিছুই হতো না। কিন্তু কেন তা হতো? তা হতো এই জন্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান শ্রোতার কাছে ইসলামী অনুষ্ঠানের বিশেষ আবেদন ছিল। যার বিশেষ আবেদন থাকে, তার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশ কি সেদিন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হতে চেয়েছিল নাকি অসাম্প্রদায়িক হতে চেয়েছিল? সেদিন বাংলাদেশের ধর্মাবলম্বী নির্বিশেষে বাঙালি জনগণ চেয়েছিল অতীতের সাম্প্রদায়িক বিষ ধুয়ে-মুছে একটি সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতিপূর্ণ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে—সেক্যুলার হতে নয়।’ (সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত, বেহাত বিপ্লব ১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১৩, পৃ. ২২৮)
এটাই মূলকথা যে বঙ্গবন্ধু যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন সেটি ইসলামহীন সেক্যুলারিজম নয়।