ঝিনাইদহে টাকার ড্রাগন বিক্রিতে স্বপ্নের হাতছানি

Published: 19 August 2023

বিশেষ সংবাদদাতা :


‘ড্রাগন গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার গৌরীনাথপুর গ্রামটি। এ গ্রামে মাঠকে মাঠ ড্রাগন ফলের চাষ চলছে। যে কারণে ওই গ্রামেই মাত্র তিন মাসে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল ড্রাগনের হাট। এ হাট থেকে প্রতিদিন প্রায় গড়ে বিক্রি হচ্ছে পাঁচ কোটি টাকার ড্রাগন।

যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
হাটটি একেবারে গ্রামাঞ্চলে হলেও যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় খুব অল্প সময়ে জমে উঠেছে। ড্রাগন ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছেন পাইকারি দরে ওই হাটে ফল কিনতে। এই হাট ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার আজমপুর ইউনিয়নের গৌরীনাথপুর গ্রামে।

মহেশপুর পৌর শহর থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বে এবং কোটচাঁদপুর পৌর শহর থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে কোটচাঁদপুর-পুড়াপাড়া সড়কে অবস্থিত।
ওই হাটের ড্রাগন ফলের আড়তদার জসিম উদ্দীন বলেন, এই উপজেলাসহ আশপাশের উপজেলায় ব্যাপক ড্রাগন চাষ হওয়ায় তিনি ওই হাটে বড় একটি টিনের চালা দেন আড়ত হিসেবে। এলাকার মানুষ অনেকেই সে সময় আমাকে পাগল বলেছিল। তারা বলেছিল, গ্রামের মধ্যে ড্রাগনের আবার পাইকারি বাজার হয় কখনো! তিনি তখন জেদের বশেই দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ড্রাগনের ব্যবসা শুরু করেন।

তিনি আরো বলেন, আমার একটিমাত্র আড়তে ব্যাপক বেচাকেনা দেখে মাত্র তিন মাসের মধ্যে ওই বাজারে এখন ৩০টি বড় বড় ফলের আড়ত বসেছে। এ ড্রাগন ফলের হাটে প্রতিদিন প্রায় গড়ে পাঁচ কোটি টাকার ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে।

আরেক আড়তের মালিক ও ড্রাগন চাষি তরিকুল ইসলাম রিয়াল বলেন, আমি নিজেই ১৫ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেছি। আগে এ জমিতে বর্গাচাষিরা ধান ও বাদাম চাষ করত। বর্গাচাষিদের কাছ থেকে আমি পেতাম বিঘাপ্রতি বছরে ৮-১০ হাজার টাকা।

সেই জমিতে নিজেই ড্রাগন চাষ করে বিঘাপ্রতি পাচ্ছি ৮-১০ লাখ টাকা।
তিনি বলেন, জমিতে একবার ড্রাগন লাগালে ৮-১০ বছর থাকে। বিঘাপ্রতি বছরে গড়ে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। ভালো পরিচর্যা করলে ভালো ফলও পাওয়া যায়।

ওই এলাকার ড্রাগনচাষি আজিজ খান বলেন, আমি আজ ক্ষেত থেকে আড়াই শ কেজি ড্রাগন এনে এ হাটে বিক্রি করলাম। দাম পেয়েছি পাইকারি দরে প্রতি কেজি ১৭০ টাকা। গ্রামের হাটে পরিবহন খরচ কম। মোটামুটি ভালো দাম পেয়েছি।

ওই গ্রামের ড্রাগনচাষি ও ড্রাগন আড়ত মালিক নাজমুল হক বলেন, আমি ১৫ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেছি। গাছে ভালো ড্রাগন ফল এসেছে। আশা করছি বিঘাপ্রতি সর্বনিম্ন আট লাখ টাকা করে ড্রাগন বিক্রি করতে পারব। তিনি বলেন, এসব জমিতে আগে ধান, ভুট্টা ও বাদাম চাষ করতাম। খুব বেশি হলেও বিঘাপ্রতি বছরে পাওয়া যেত এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে কৃষিশ্রমিক, সার, কীটনাশকসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিলে খুব একটা লাভ নাই।

একই গ্রামের ড্রাগনচাষি সোহাগ বলেন, এবার আমি ২৫ বিঘা জমিতে ড্রাগনের চাষ করেছি। ড্রাগনে যে পরিমাণ টাকা আসে, অন্য কোনো আবাদে তেমনটি পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, এই গৌরীনাথপুর গ্রামের মাঠে এখন শুধুই ড্রাগনের চাষ। যে কারণে ধানিজমি অনেক কমে গেছে। এ গ্রামসহ আশপাশ এলাকায়ও এখন ড্রাগনের চাষই বেশি। তিনি বলেন, নিজের সংসারের জন্য এবার মাত্র দুই বিঘা জমিতে ধান লাগাব। যা আগে লাগাতাম ১৫ থেকে ২০ বিঘা।

আড়ৎ মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব আড়তে প্রায় আড়াই শ শ্রমিক কাজ করছে। এর আগে তাদের মধ্যে অনেকে কৃষিকাজসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত ছিল। কেউ ছিল ভবঘুরে।

আড়ত শ্রমিক ইব্রাহিম জানান, প্রতিদিন তাদের দুপুরে খাওয়া বাবদ ১০০ টাকা ও দিন শেষে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। অপর শ্রমিক সাইদুর রহমান বলেন, রোদে পুড়ে মাঠে কাজ করতে গেলে ৩০০-৪০০ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। সে অনুযায়ী এখানে অনেক ভালো আছি।

কোটচাঁদপুর উপজেলার হরিন্দিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান এ হাট থেকে ড্রাগন কিনে চট্টগ্রাম নিয়ে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এ হাটে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ড্রাগন ওঠে। যে কারণে আমরা চাহিদা অনুযায়ী পছন্দমতো সাইজের ড্রাগন পাইকারি দামে কিনতে পারি। পাশাপাশি যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় এই হাটটি আমরা এখন বেছে নিয়েছি।

কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর কৃষি অফিস সূত্র জানায়, এ দুটি উপজেলায় প্রায় সাত শ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হয়েছে। এর পরও দিনে দিনে বাড়ছে ড্রাগন চাষ।

মহেশপুর কৃষি কর্মকর্তা ইয়াসমিন সুলতানা ও কোটচাঁদপুর কৃষি কর্মকর্তা রাজেদুল ইসলাম অভিন্ন বক্তব্যে বলেন, যেহেতু গত এক বছরে এ অঞ্চলে চাষিরা ড্রাগন চাষে ঝুঁকে পড়েছে বেশি। সে কারণে ধানি জমি এলাকাভিত্তিক কিছুটা কমে যেতে পারে। ওই কর্মকর্তারা আরো বলেন, বেশির ভাগ ফলচাষিরা তাদের আম, পেয়ারা, কমলা, মাল্টা- এসব ফলে লাভবান হতে না পারায় ওই সব বাগান কেটে দিয়ে তারা ড্রাগন চাষ করছেন। সে কারণে ধানি জমির সংকট খুব একটা হবে না।