আওয়ামী ন্যারোটিভ, সিভিলাইজেশন স্টেট ও সাম্রাজ্যবাদের ম্যাটিকুলাসের পর কী
হাবীব ইমন
এক।
আত্মজীবনীতে আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা উল্লেখ করেছেন, ‘কারাগার থেকে বের হয়ে যখন সাদাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলাম, তখন দেখলাম, আমাদের কারও মাথায় শিং নেই। অর্থাৎ কেউ কারও অত বড় শক্র নয়। কিন্তু তাদের একসঙ্গে বসা হয়নি। ঘৃণা সংযুক্তির সম্ভাবনা ধ্বংস করে দেয়।’ এমন সম্প্রীতির সহাবস্থান দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে রাজনৈতিক সহাবস্থানের বহু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
জগলুয়ার ‘কনস্ট্রাক্টটে ট্রুথ অ্যান্ড নলজে ইন এ পোস্ট ট্রুথ ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শাসনামলে মোট ৩০ হাজার ৫৭৩টি অসত্য কথা বলেছেন। গড়ে প্রায় প্রতিদিন ২০টি করে ফেইক নিউজ টুইট করতেন।
নোবেলজয়ী ফিলোফিনো সাংবাদিক মারিয়া রোসা তার ‘হাউ টু স্ট্যান্ড আপ টু আ ডিক্টেটর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সত্যের তুলনায় মিথ্যা দৌড়ায় ছয় গুণ গতিতে। ঘৃণাও দ্রুত ছড়ায়। কেবল অসত্যের ক্রেতা নয়, রয়েছে ঘৃণারও ক্রেতা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামল থেকে মানুষ মূলত সত্য-উত্তর দুনিয়ায় প্রবেশ করতে শুরু করেছে। সত্য-উত্তর দুনিয়ায় মানুষ ফ্যাক্টের চেয়ে ফিকশনের প্রতি বেশি আসক্ত। কঠিন সত্যের চেয়ে স্বস্তিদায়ক মিথ্যা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।
গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, যোগাযোগ হলো কর্ম। সেই কর্ম এখন অকর্মের দিকে টার্ন করছে। যথাযথভাবে যোগাযোগ করা কঠিন হচ্ছে। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট ই পার্ক বলেছেন, যোগাযোগ হলো একধরনের মিথস্ক্রিয়া, যার সঙ্গে ইগো বা অহং যুক্ত। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অহংয়ের দাপট বাড়ছে। ঘৃণা হলো সবচেয়ে নিম্নমানের যোগাযোগ।
আমাদের মধ্যে বেশ সহজাত হয়ে উঠছে অন্যকে ছোট করে দেখা। অন্যকে ছোট দেখানোর জন্য আমাদের আচরণ বা বিদ্বেষ ছড়ানো শব্দমালা কেন ‘হেট স্পিচ’ হিসেবে গণ্য হবে না? এ কথা শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি—অন্যকে ছোট করে কেউ কখনো বড় হতে পারে না, কিংবা অন্যের মতপ্রকাশকে সম্মান জানানো উচিত। প্রাত্যহিক জীবনে এসবের উপস্থিতি খুবই কম। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু ঘৃণা বা বিদ্বেষ উদ্গারের অধিকার কারোরই নেই।
দুই।
২০০১ সালের কথা। বিএনপি সবেমাত্র ক্ষমতায় এলো। নোয়াখালীতে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পুরোপুরি বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) নিয়ন্ত্রণে। ওই সময়ে আমি পলাশকুঁড়ি খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক। বিজয় মেলায় আমরা অংশগ্রহণ করি। মাই মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি উচ্চারণ করা মাত্রই জাসাসের সভাপতি আমাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনলেন। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, মুক্তিযুদ্ধ কেন বললাম। এ শব্দটি আওয়ামী লীগের। এটা বলা যাবে না।
প্রশ্ন হলো, মুক্তিযুদ্ধ কি আওয়ামী লীগের? কারা আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে তাদের ফ্রেমে নেওয়ার সুযোগ দিল। সেই হিসাব আমাদের কষতে হবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ইতিহাসকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করে বসি। যেটা মস্ত ভুল। যার কারণে আওয়ামী লীগ বারবার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ন্যারেটিভ করার সুযোগ পেয়েছে, সংকীর্ণ করার প্রয়াস পেয়েছে। এ কাজটা বিএনপি তার মতো করে জিয়াউর রহমানকে নিয়েও করেছে, তাকে দলে অন্তর্ভুক্তিকরণ করেছে। বিএনপি শাসনামল যদি ভুলে না যাই, এমনটা তো দেখা গেছে, হয়তো পরিমাণ কম ছিল। যার ফলে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে কিংবা তার পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণকে পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। জনমানসের চরিত্রটাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ জটিল প্রশ্ন উঠছে। তবে কি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ব? মনে রাখতে হবে, কেউ চূড়ান্ত নন। যে কাউকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। প্রশ্ন জারি রাখাটা বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য খুব অপরিহার্য। আলাপ-আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সত্য চিহ্নিত হবে। বঙ্গবন্ধুও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন, চূড়ান্ত নন। কিন্তু যখন কেউ বঙ্গবন্ধুকে সংকোচনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন বা তাঁর সম্পর্কে দ্রুত উপসংহারমূলক মন্তব্য করছেন, তখন তা জটিল মনে হচ্ছে। আমরা কি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্বিচার মন্তব্য করব, সংকোচনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নেব। নাকি খোলামন নিয়ে দেখব।
ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এ নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্ন মনের ভেতর জাগছে, বাঙালির মননে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে নির্মাণ করেছেন? না তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে? কোনো মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস কি নেতৃত্বশূন্য হয়?
তিন।
২০২১ সালে বিএনপি ৭ মার্চ পালন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা আর ৭ মার্চ পালন করেনি। ওই সময় আয়োজিত আলোচনা সভায় বিএনপি নেতারাই বলেছেন, ‘৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি দিন। সেই সময়ের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ যে আঙ্গিকে হোক, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে হোক, বিএনপির উচিত ছিল ৭ মার্চ পালনের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা। হতে পারতো ইতিহাসের পুরো সত্যটা বিএনপি গোপন করতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের ফ্রেমের বাইরে পড়ার সুযোগ হতো, বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি নির্মোহ হতে পারত। কিন্তু সেদিকে বিএনপি যায়নি, হয়তো তাদেরও মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে সামনে আনা যাবে না। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ তাদের বয়ানে নেওয়ার দায় বিএনপির আছে।
চর্চার ভেতর দিয়ে বিএনপি ইতিহাসকে নিরপেক্ষ করতে পারত। খোদ জিয়াউর রহমান যখন নিজেও একটি লেখায় ৭ মার্চের ভাষণকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন। ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এক লেখায় জিয়াউর রহমান নিজেই লেখেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল তার স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনকের স্বীকৃতি দিতে বিএনপির হীনমন্যতা থাকলেও ওই লেখায় জিয়া নিজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করেন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কীভাবে বিষোদগার করা হতো, তা-ও উঠে এসেছে জিয়ার লেখায়। প্রশ্ন হলো, তিনি কি পেরেছেন ইতিহাসকে রিসেট বাটনে টিপ দিতে? কিংবা ইতিহাসের অমোচনীয় সত্যকে খারিজ করে দিতে পেরেছেন?
বিএনপি ঘরানার অনেকে লেখেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেননি, সেই সময় তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন জিয়াউর রহমান।’ কথা হলো, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কারণেই। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরম্পরা কারও অজানা নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব ছিলেন দুজন। প্রথমজন স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত স্থপতি। দ্বিতীয়জন খোদ সংবিধান জখম করে একদলীয় শাসন কায়েম করা একনায়ক।’ এ বিশ্লেষণের মধ্যে একধরনের অবস্থান বোঝা যায়। বিষয়টি বাতিল না করে ঘটনাপরম্পরার সঠিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বঙ্গবন্ধু যদি কারও হাতে চরমভাবে নিগ্রহ হয়ে থাকেন, সেটা হলো শেখ হাসিনার সরকার। একদিকে তার ছিল দুঃশাসন, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান। বঙ্গবন্ধুর অপ্রয়োজনীয় পুনঃপুন উপস্থাপনের ফলে তাকে টক্সিক করে ফেলা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সব অপশাসন এ ন্যারেটিভের চাদরে ঢাকতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুকে একক সম্পদে পরিণত করেছিল। জনগণের ভেতর বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক মালিকানাবোধ সৃষ্টি করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে পুনঃপুন উপস্থাপন করেছেন। এতে বঙ্গবন্ধু মানুষের কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে গেছেন। প্রশ্ন হলো, সারা দেশে এত এত বঙ্গব্ন্ধুর আত্মজীবনী বিতরণ করা হলো, সেগুলোর ফল কী হলো? মদ্দা কথা হলো, শেখ হাসিনা তার ন্যারেটিভগুলো চূড়ান্ত বিচারে দাঁড় করাতে পারেননি। শেখ হাসিনার পতন মূলত তার ন্যারেটিভের পতন।
চার।
খুব বেশি দূরে নয়। কেউ ফখরুদ্দিন-মইন ইউ আহমেদের কথা ভুলে যাবেন না। রিসেট বাটনে টিপ দিতে গিয়ে তাদের পরিণতি কোন পর্যায়ে গেছে, এটা স্মরণে রাখুন। ইতিহাস যত পুরোনো হোক, সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে কেউ কোনো জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সুবিধা করতে পারেনি। কেউ অতীত মুছতে পারে না। সেটা কোনো শুভ প্রচেষ্টা নয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীত মুছতে তৎপর হয়েছি। অতীত যখন মুছতে থাকি, তখন মূলত ভবিষ্যৎ এসে খুন হয় বর্তমানের ভেতর। ভবিষ্যৎ শূন্য হওয়ার আশঙ্কায় তৈরি হয়। ইতিহাসের এটাই সবচেয়ে বড় মাজেজা, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। মনে রাখতে হবে, রিসেট থাকলে রিবুটও আছে।
প্রশ্ন হলো, জন-আকাঙ্ক্ষাটা কী? আমরা প্রকৃতপক্ষে জন-আকাঙ্ক্ষার দিকে দৃষ্টি মেলাতে পারছি? নাকি কতগুলো সংস্কার, সুশাসন নামক পুরানো শব্দবন্ধীর দিকে আটকা পড়ছি। যেখানে মানুষ তার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, জননিরাপত্তার প্রশ্নটা যেখানে এখনো ঝুলন্ত আছে। বাজার অর্থনীতি ঠিক রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো, প্রতিহিংসা প্রতিহত করা এবং মানুষের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো কাজগুলো খুব সতর্কভাবে করতে হবে। না হলে সরকারের সংস্কার উদ্যোগগুলো মুখথুবড়ে পড়বে—যা দেশকে আরেকটি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। মনে রাখতে হবে, পরিবেষ্টিত ছাত্র বা শিক্ষার্থীই তো জনমানস নয়, এর বাইরে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী আছে, তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কই?
একদিনের একটা ঘটনা বলি। সপ্তাহখানেক আগের কথা। একটা বাইকে মোহাম্মদপুর যাচ্ছিলাম, যেতে যেতে আলাপে জিনিসপত্রের দাম বাড়া নিয়ে বেশ উষ্মা পেলাম ওই বাইকচালকের। তিনি যেটা বললেন, এটা আমার কাছে মারাত্মক ব্যাপার মনে হলো। হয়তো আমি তার মতো এমনটা ভাবিনি। সেই বাইকচালক বললেন, “এই যে ‘সংস্কার-সংস্কার’ করছে সরকার, সংস্কার আসলে কারা করছে, আমরা জনগণ কই? আমরা কি ধরনের সংস্কার চাইছি, এটা তো কেউ জানতে চাইছে না। সংস্কারটা আসলে সুশীল সমাজে চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের পাণ্ডিত্য। আমরা জনগণ সেগুলো খালি গিলবো।”
ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করতেন তারাই বাংলাদেশ। এখনো কি সেই অবস্থা চলছে? চেহারায়ও বদলাল, কিন্তু চরিত্রে বদলাল না। আগে আমরা শুনেছি সোনার বাংলা ও চেতনার কথা, এখন শুনছি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের কথা। প্রশ্ন হলো, কাদের অন্তর্ভুক্তি? সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম জিইয়ে রেখে, পাহাড়ে সেনাশাসন অব্যাহত রেখে, সমাজে ভিন্নমত দমন করে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছে তাদের সমাদর করে, এলজিবিটি কমিউনিটির মানুষের অমর্যাদা দেখিয়ে, কোন ধরনের অন্তর্ভুক্তি চাওয়া হচ্ছে এখন? বলা হচ্ছে সিভিলাইজেশন স্টেটের কথা, যার মূলে রয়েছে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে উঠে সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর ভর দিয়ে নতুন ধরনের রাষ্ট্রীয় দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করা। এখন সিভিলাইজেশন স্টেটের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারত, চীন ও ইরানের কথা। সেসব দেশে কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে? বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতিসত্তার উন্মেষ এবং তারই ধারাবাহিকতায় জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ।
পাঁচ।
জন-আকাঙ্ক্ষা থেকে গণবিস্ফোরণ। ফলে শেখ হাসিনার পতন ছিল তার অনিবার্য পরিণতি। এটিই মূল ঘটনা। যে ঘটনার পরম্পরায় সামনে পেছনে কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত আরও অনেক ঘটনাই ঘটেছে। একক কোনো গোষ্ঠী এর পুরোপুরি কৃতিত্ব বা কুশীলব নয়। এ ঘটনা সম্পাদনে এক অভূতপূর্ব শুভশক্তি সমাবেশে যেমন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিরোধ ছিল, আত্মৎসর্গ করতে নিঃশঙ্কোচিত্ত তারুণ্য ছিল, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ছিল, তেমনি শেখ হাসিনা সরকারের সীমাহীন দুরাচার, লুণ্ঠন, একরোখা গোঁয়ার্তুমি ছিল। আর ছিল অশুভ শক্তি সাম্রাজ্যবাদের ম্যাটিকুলাস তৎপরতা, পেইড অ্যাক্টিভিস্টিং। মূল ঘটনাকে সংহত করতে আমরা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট সব শুভ শক্তিকে মহিমান্বিত করব। কিন্তু একই সঙ্গে অশুভ শক্তি সাম্রাজ্যবাদ ও তার অনুচর উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তৎপরতাকেও ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করব। মুশকিল হচ্ছে, অনেকেই জেনেশুনে সাম্রাজ্যবাদের বিষপেয়ালা গ্রহণ করেছেন। বিশেষ এবং সামগ্রিক বিবেচনাকে গুলিয়ে ফেলেছেন। অশুভ শক্তির প্রসঙ্গ আলোচনায় শুভ শক্তিকে খাটো করা হবে বলে আলাপ দিচ্ছেন। কিন্তু অশুভের উপাদান ৯৯ শতাংশ হলেও তা কখনোই ১ শতাংশ শুভকেও ম্লান করতে পারে না। আদতে তারা নানা কুযুক্তিতে সাম্রাজ্যবাদের ম্যাটিকুলাস অনুপ্রবেশকে আড়াল করতে চাইছেন। অথচ বিশ্বইতিহাসে যেখানেই সাম্রাজ্যবাদের উপস্থিতি, সেখানেই অবশ্যম্ভাবী দুর্যোগ আছড়ে পড়েছে। দেশের নতুন রাজনৈতিক এ বাস্তবতায় আমদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আমরা ফ্যাসিজমের পুনরুত্থান চাই না, তেমনি সাম্রাজ্যবাদের মুখচোরা, সুবিধাভোগীদেরও ঘৃণা করতে চাই। কিন্তু ঘৃণার বাতাবরণ নয়।
হাবীব ইমন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।