ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি প্রসঙ্গে বিশ্বের প্রতিক্রিয়া

Published: 22 November 2024

পোস্ট ডেস্ক :


আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাপরাধের’ অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আদালত বলেছে যে নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্ট “ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সজ্ঞানে গাজার বেসামরিক জনগণকে তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য বস্তু থেকে বঞ্চিত করেছেন।’

মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে হামাসের সামরিক প্রধান মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে আইসিসি। ছয় মাস আগে আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান প্রথম ওয়ারেন্টের আবেদন করেন। আগস্টে, খান আদালতকে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই কার্যক্রমে যেকোনো অযৌক্তিক বিলম্ব ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকারকে প্রভাবিত করবে।’ সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করার পর থেকে, ইসরাইলি কর্মকর্তারা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার নিন্দা করেছেন। ইসরাইলি পরিবহন মন্ত্রী মিরি রেগেভ বলেছেন, ‘বিচারের ছদ্মবেশে এটি আসলে ইহুদি বিরোধিতা।’

ইসরাইল

নেতানিয়াহুর কার্যালয় এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। নেতানিয়াহুর অফিস বলেছে -‘আইসিসি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে করা অযৌক্তিক এবং মিথ্যা পদক্ষেপ ইসরাইল ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরাইল তার নাগরিকদের প্রতিরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। ‘গ্যালান্ট একটি বিবৃতিতে বলেছেন যে যুদ্ধের সময় ইসরাইলের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নেতৃত্ব দেওয়ার বিশেষ অধিকার পেয়ে তিনি গর্বিত। তিনি যোগ করেছেন যে সমস্ত উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ইসরাইল এই যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

হামাস
নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে হামাস। তারা এটিকে ‘বিচারের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছে। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো সদস্য বাসেম নাইম বলেন, “এটি ন্যায়বিচারের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকারের পথ সুগম করবে। তবে এটি সীমিত এবং প্রতীকী থেকে যাবে যদি বিশ্বের সমস্ত দেশ এটিকে সমর্থন না করে।

গাজার মানুষ
মধ্য গাজার দেইর এল-বালাহ থেকে আল জাজিরার হয়ে রিপোর্টিং করার সময় হানি মাহমুদ বলেছেন যে গাজার বাসিন্দারা বিষয়টি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে…কারণ আমরা জানি ইসরাইলের জন্য আমেরিকান অটল সমর্থন রয়েছে’। তাই এটিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে আমেরিকা।’

ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ
আইসিসির সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আশা এবং আস্থার প্রতিনিধিত্ব করে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, যারা অধিকৃত পশ্চিম তীরে শাসন করে। নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের সাথে সমস্তরকম যোগাযোগ ছিন্ন করার জন্য আইসিসি সদস্যদের আহ্বান জানিয়েছে তারা।

আর্জেন্টিনা
প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই এক্স-এ বলেছেন যে তার দেশ এই সিদ্ধান্তের প্রতি “গভীর অসম্মতি” জানিয়েছে। তিনি লিখেছেন যে ওয়ারেন্টটি ‘হামাস এবং হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলির ক্রমাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আত্মরক্ষার বৈধ অধিকারকে খর্ব করে”।

অস্ট্রিয়া

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার শ্যালেনবার্গ এই ওয়ারেন্টটিকে অবোধগম্য এবং হাস্যকর বলেছেন। তার অফিস আরও বলেছে যে রোম আইনের পক্ষ হিসাবে অস্ট্রিয়া আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে বাধ্য।

বেলজিয়াম
‘যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয় সেখানেই দায়মুক্তির বিরুদ্ধে লড়াই দরকার। বেলজিয়ামের কাছে এটি অগ্রাধিকার।’ আইসিসিকে পদক্ষেপকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে বেলজিয়ামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একথা জানিয়েছে। ইসরাইল এবং গাজায় সংঘটিত অপরাধের জন্য যারা দায়ী তাদের অবশ্যই সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করে তারা।

কানাডা
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, কানাডা আন্তর্জাতিক আদালতের রায় মেনে চলবে। তাঁর দাবি, যাতে প্রত্যেকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ‘আইসিসি পরোয়ানা রাজনৈতিক নয়। এটিকে সম্মান ও বাস্তবায়ন করা উচিত। সমস্ত রাজ্য, আদালতের সমস্ত রাষ্ট্রীয় দল, যার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্ত সদস্য অন্তর্ভুক্ত, এই আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। ‘

ফ্রান্স
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ক্রিস্টোফ লেমোইন বলেছেন, ফ্রান্স ‘আইসিসির আইন অনুযায়ী কাজ করবে’। তবে, নেতানিয়াহু দেশে এলে ফ্রান্স নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করবে কিনা তা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন এটি ‘আইনিভাবে জটিল প্রক্রিয়া’।

জার্মানি
একজন সরকারী মুখপাত্র বলেছেন যে জার্মানি নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের জন্য আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সাবধানতার সাথে পর্যবেক্ষণ করবে। তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর দেশে সফর না করা পর্যন্ত পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে না। মুখপাত্র বলেছেন, ফেডারেল সরকার আইসিসি সংবিধির খসড়া তৈরিতে জড়িত ছিল এবং আইসিসির অন্যতম বড় সমর্থক। একইসাথে জার্মান ইতিহাসের কথা স্মরণ করে ওই সরকারি মুখপাত্র বলেন, ইসরাইলের প্রতি আমাদের একটি মহান দায়িত্ব রয়েছে।

হাঙ্গেরি
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজ্জার্তো আইসিসির সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন, এটিকে ‘লজ্জাজনক এবং অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সিদ্ধান্তটি একটি জঘন্য ‘সন্ত্রাসী’ হামলায় আক্রান্ত একটি দেশের নেতাদের ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের নেতাদের সাথে সমান করে বিচারের আওতায় আনা হলো, যা আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থাকে ক্ষুন্ন করে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়।’ হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলেছেন, তিনি আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অস্বীকার করে নেতানিয়াহুকে সফরে আমন্ত্রণ জানাবেন ।

ইরান
ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC) এর প্রধান নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টকে ইসরায়েলের সমাপ্তি এবং রাজনৈতিক মৃত্যু বলে বর্ণনা করেছেন। ইরানের দাবি, আজ বিশ্বে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বাস করছে ইসরাইল এবং এর কর্মকর্তারা। অন্য দেশে গিয়েও আর তারা পার পাবেন না।

আয়ারল্যান্ড
প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেছেন এই পরোয়ানা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’। তিনি যোগ করেছেন যে আয়ারল্যান্ড আইসিসির ভূমিকাকে সম্মান করে এবং যে কেউ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনে সহায়তা করার অবস্থানে থাকলে তাকে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা করা হবে।

ইতালি
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি বলেছেন, রোম মিত্রদের সাথে বিবেচনা করবে কিভাবে সিদ্ধান্তটি ব্যাখ্যা করা যায় এবং একসাথে কাজ করা যায়। তাজানি বলেন, ‘আমরা আইসিসিকে সমর্থন করি… আদালতকে অবশ্যই আইনি ভূমিকা পালন করতে হবে, রাজনৈতিক ভূমিকা নয়। ‘

জর্ডান
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, আইসিসির সিদ্ধান্তকে সম্মান ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ফিলিস্তিনিরা ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য।

নেদারল্যান্ডস

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাসপার ভেল্ডক্যাম্প বলেছেন যে তার দেশ ‘আইসিসির বিচারকে সম্মান করে। আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে কাজ করব। কারণ আমরা আইসিসির রোম সংবিধি সম্পূর্ণরূপে মেনে চলি।’

নরওয়ে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্থ এইডে বলেছেন, “আইসিসির আদেশটি ন্যায়সঙ্গতভাবে পালন করা গুরুত্বপূর্ণ। আমি আত্মবিশ্বাসী যে আদালত সর্বোচ্চ ন্যায্য বিচারের মানদণ্ডের ভিত্তিতে মামলাটি এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

যুক্তরাষ্ট্র
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ইসরাইলি নেতাদের বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করাটা অশোভন। আইসিসি যাই সিদ্ধান্ত নিক ইসরাইল এবং হামাস কখনোই সমতুল্য নয়। আমরা সবসময় ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য হুমকির বিরুদ্ধে তার পাশে দাঁড়াব।”

আইসিসির সিদ্ধান্তকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এই ওয়ারেন্টকে সমর্থন করে বলেছেন, ‘সকলেই বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে এবং অকল্পনীয় মানবিক দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব যদি আন্তর্জাতিক আইনকে সমর্থন না করে, তাহলে আমরা আরও বর্বরতার দিকে এগিয়ে যাবো।’

যুক্তরাজ্য
বৃটেন আইসিসির স্বাধীনতাকে সম্মান করে, যদিও প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের একজন মুখপাত্র খোলসা করেননি বৃটেনে আদৌ এই ওয়ারেন্ট বহাল থাকবে কিনা ।

জাতিসংঘ
সেক্রেটারি-জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেস আইসিসির কাজ এবং স্বাধীনতাকে সম্মান করেন। নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে জারি করা ওয়ারেন্ট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তার মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক একথা বলেছেন। প্যালেস্টাইনে জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ এটাকে ‘উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন।

তুরস্ক
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন, আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যাকারী ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে বিচারের আওতায় আনার জন্য একটি আশাব্যাঞ্জক এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।ফিদান যোগ করেছেন, গণহত্যার শাস্তি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে আমরা কাজ চালিয়ে যাব।

দক্ষিণ আফ্রিকা
একটি বিবৃতিতে, সরকার আইসিসির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বলেছে যে এটি ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনঃনিশ্চিত করে এবং সমস্ত রাষ্ট্র পক্ষকে রোম সংবিধিতে তাদের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী কাজ করার আহ্বান জানায়