‘ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প মধ্যপ্রাচ্যে’

Published: 15 August 2020

একটি ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প মাত্রই আঘাত হেনেছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণাকে।এভাবেই বর্ণনা করেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান। খবর বিবিসি বাংলা।

কেন তিনি এটিকে ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প বলছেন, লেখায় সেটি ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। আনোয়ার সাদাতের জেরুসালেমে যাওয়ার মতো কোন ঘটনা এটি নয়- কারণ আরব এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে প্রথম সম্পর্ক খুলে যাওয়ার সেই বড় ঘটনার সমকক্ষ আর কিছুই হতে পারে না। হোয়াইট হাউসের লনে ইতজাক রাবিনের সঙ্গে ইয়াসির আরাফাতের করমর্দনের সঙ্গেও এর তুলনা চলে না। কারণ ইসরায়েলি আর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য সমঝোতার সমান আর কিছুই হতে পারে না।

তবে টমাস এল ফ্রিডম্যানের মতে, ইসরায়েল আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই ঘটনা উপরের দুটি ঘটনার খুবই কাছাকাছি। এ ধরণের ঘটনার স্কোরকার্ডে এটির অবস্থান তিন নম্বরে।

ইসরায়েলের সঙ্গে এর আগে কেবল মাত্র দুটি আরব রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়েছে। প্রথমটি মিশরের সঙ্গে, ১৯৭৯ সালে। এই চুক্তি করার পরিণামে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছে। দ্বিতীয়টি জর্ডানের সঙ্গে, ১৯৯৪ সালে।

বৃহস্পতিবার যেভাবে ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণাটি এসেছিল, তা সবাইকে হতচকিত করেছে। এতে মধ্যস্থতা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনিই প্রথম এক বিবৃতিতে এই ঘটনা জানান।

পুরো আলোচনাটি চলছিল বেশ গোপনে। এতটাই গোপনে যে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত নাকি এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যে এই চুক্তিকে এক ‘ঐতিহাসিক মূহুর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন।

ওভাল অফিসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বরফ যেহেতু গলেছে এখন আমি আশা করবো আরও অনেক আরব এবং মুসলিম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অনুসরণ করবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ঘোষণা দেয়ার পরপরই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হিব্রুতে টুইট করেন, “এক ঐতিহাসিক দিন‍।”

সামনের দিনগুলিতে ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিদল নিয়মিত মিলিত হবেন নানা বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে। এর মধ্যে বিনিয়োগ, পর্যটন, দুদেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ, দুদেশে পরস্পরের দূতাবাস স্থাপন থেকে কিছুই বাদ থাকছে না। দুটি বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে যতরকমের সম্পর্ক থাকার কথা, মনে হচ্ছে সেরকম এক সম্পর্কের দিকে যাচ্ছে দুই দেশ।

এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গতিশীল দুটি সমাজ এবং অগ্রসর দুটি অর্থনীতির মধ্যে এই সরাসরি সম্পর্কের সূচনা পুরো অঞ্চলকে বদলে দেবে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ত্বরান্বিত হবে এবং মানুষে-মানুষে সম্পর্ক তৈরি হবে।

একটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে এই সম্পর্কের বিনিময়ে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা তার সীমানায় ঢোকানোর পরিকল্পনা করছিল, তা আপাতত স্থগিত রাখবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনওয়ার গারগাশ বলেছেন, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে তার দেশ আসলে এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে, কারণ এর মাধ্যমে পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে ইসরায়েল আগাচ্ছিল, সেই ‘টাইম বোমা’ থামিয়ে দেয়া গেছে ।

কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই মন্ত্রী বলছেন, তারা মনে করেন এই সমঝোতার ফলে এই পরিকল্পনা কেবল স্থগিত নয়, পুরোপুরি থেমে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই পদক্ষেপকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এর নিন্দা করে বলেছেন, “এটি জেরুসালেম, আল-আকসা এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

একজন উর্ধ্বতন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা হানান আশরাউই এই সমঝোতার নিন্দা করে বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে তলে তলে যেসব গোপন লেনদেন আর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছিল, সেটা এবার প্রকাশ হয়ে গেল।

তিনি আবুধাবির প্রিন্স মোহাম্মদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নিজের বন্ধুর দ্বারা কেউ যেন এভাবে বিক্রি হয়ে না যান‍।

ইরানও খুব কঠোর ভাষায় এই সমঝোতার নিন্দা করেছে। ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে ‌’বিপজ্জনক’ এবং ‘বোকামি’ বলে বর্ণনা করে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ফিলিস্তিনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ইউএই কখনোই ক্ষমা পাবেনা।

খুবই কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে তুরস্কও। তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ হজম করা যায় না।

তবে ইসরায়েলের মিত্র মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরায়েলের আরেক মিত্র জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, এই চুক্তির পর থমকে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা নতুন করে শুরু হতে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে এই সমঝোতাকে। এক টেলিভিশন ভাষণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা স্থগিত রাখলেও তা বাতিল করেন নি, এই পরিকল্পনা এখনো আছে।

অথচ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাষ্ট্র দেখাতে চাইছিল, এই সমঝোতার ফলে ইসরায়েলকে যেন এই কাজ থেকে বিরত রাখা যাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, দুজনেই আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই সমঝোতা থেকে কিছু ফায়দা তুলতে পারেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটিকে তার পররাষ্ট্রনীতির এক বিরাট বিজয় হিসেবে দেখাতে চাইবেন। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তার ভাবমূর্তিকে চাঙ্গা করতে এরকম কিছু একটা দরকার। আর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে যে বিপদের মধ্যে আছেন, সেখান থেকে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর জ্ন্য এটিকে কাজে লাগাতে পারবেন।