মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাকে চায় চীন-রাশিয়া?

Published: 8 October 2020

পোস্ট ডেস্ক : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিখ্যাত স্লোগান- মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন অনুসারে ক্রেমলিন কি এবারও চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অসাধারণ রাষ্ট্র হিসেবে ধরে রাখতে? আর চীন কী চায়, এবারের নির্বাচনে জো বাইডেন জয়ী হোক?

যুক্তরাষ্ট্রে ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এই প্রশ্নগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা, দুই প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকদের মাথায়।

শীর্ষস্থানীয় একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, রাশিয়া, চীন এবং ইরান- এই তিন দেশ ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, এমনকি গোপনেও তৎপরতা চালাবে।

তবে তাঁরা এই তিন দেশের ইচ্ছা ও ক্ষমতাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব দেশের নিজস্ব উদ্দেশ্য ও সক্ষমতা রয়েছে। গোয়েন্দাদের এসব সন্দেহ ও পর্যালোচনা এখনো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা অবশ্য সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনে রাশিয়ার দিক থেকে যেসব ঝুঁকি রয়েছে, সেগুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়েছে।

নির্বাচনের আর তিন সপ্তাহের মতো বাকি। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?

রাশিয়া

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ও পরে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। এ নিয়ে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে অভিযোগও উঠেছে বিস্তর। মার্কিন গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ওই নির্বাচনে ভোটারদেরকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে নিয়ে যেতে চেষ্টা চালিয়েছে রাশিয়া।

এর প্রমাণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্পের নির্বাচনী টিমের সঙ্গে রুশ কর্মকর্তাদের বৈঠক, হিলারি ক্লিনটন ও ডেমোক্র্যাট দলের নির্বাচনী প্রচারণায় সাইবার হামলা, বিভিন্ন রাজ্যের ভোটারদের তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশ এবং অনলাইনে এমন সব ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়ার কথা, যেগুলো নাকি শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে গেছে।

এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সিনেটে রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন একটি প্যানেলও এমন মতামত দিয়েছে। রাশিয়া যে গতবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছিল, তাদের মতামত এই ধারণাকেই আরো বেশি সমর্থন দিয়েছে।

এই প্যানেল বলেছে, ট্রাম্পের প্রচারণায় বিদেশিদের হস্তক্ষেপ খুব সহজ ছিল। তবে এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় তারা কোনো অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র দেখতে পাননি।

এবার ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের জায়গায় জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সেন্টারের (এনসিএসসি) পরিচালক উইলিয়াম ইভানিনা তাঁর পর্যালোচনায় বলেছেন, প্রাথমিকভাবে জো বাইডেনের মানহানি করার জন্য রাশিয়া নানা ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

আরো এক ধাপ এগিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই-এর পরিচালক ক্রিস্টোফার রে-এর অভিমত হচ্ছে, রাশিয়া কখনোই এই তৎপরতা বন্ধ করেনি।

তিনি মনে করেন, ২০১৮ সালের কংগ্রেস নির্বাচনেও রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়েছে এবং সেটাকে তারা নিয়েছে ‘২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি মহড়া’ হিসেবে। তবে বিদেশি নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ শুরু থেকেই বারবার অস্বীকার করেছে রাশিয়া।

এ বছরের শুরুর দিকে ক্রেমলিনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এ ধরনের অভিযোগ আনা মানসিক বৈকল্য এবং এর সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রাশিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে দেখতে চায় কি না সেটি একটি প্রশ্ন। কিন্তু তাঁদের আরেকটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।

যেমন- ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ভুয়া খবর ছড়িয়ে দিয়ে রাশিয়া এই জোটকে মহামারি মোকাবেলার বিষয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। রাশিয়া অবশ্য এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

প্রার্থীরা কী বলছেন

ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, রাশিয়া যদি হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখে, তাহলে ‘এর মূল্য দিতে হবে।’ শুধু তা-ই নয়, রাশিয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রতিপক্ষ’ বলেও উল্লেখ করেছেন।

অন্যদিকে, রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সব সময়ই সেগুলোকে খাটো করে দেখেছেন। তবে এ বিষয়ে তাঁর নিজের গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে মতবিরোধ হয়েছে।

ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ২০১৮ সালে ট্রাম্পের বৈঠকের পর ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি কি মার্কিন গোয়েন্দাদের নাকি পুতিনের দাবি বিশ্বাস করেন? জবাবে ট্রাম্পের উত্তর ছিল, প্রেসিডেন্ট পুতিন বলছেন রাশিয়া কিছু করেনি। তারা কেন সেটা করবে, আমি তার কোনো কারণ দেখি না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য পরে বলেছেন, তিনি ভুল বলেছিলেন।

চীন

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রখ্যাত ব্যক্তিরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে রাশিয়া নয়; বরং চীনই হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আসল হুমকি। অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার বলেছেন, আমি গোয়েন্দা তথ্য দেখেছি। এটাই আমার উপসংহার।

হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে ইন্টেলিজেন্স কমিটির প্রধান ডেমোক্র্যাট রাজনীতিক অ্যাডাম শিফ অবশ্য এটা মানতে রাজি নন। বারের বিরুদ্ধে তিনি ‘মিথ্যা বলার’ অভিযোগ এনেছেন।

ইভানিনা তাঁর পর্যালোচনায় বলেছেন, মার্কিন গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন যে চীন চায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাতে আবার নির্বাচিত না হন। কারণ বেইজিংয়ের কাছে ট্রাম্প ‘নির্ভরযোগ্য’ নন।

‘যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যাপারে চীন তার প্রভাব আরো বিস্তৃত করছে। বেইজিং যাদেরকে চীনা স্বার্থবিরোধী বলে মনে করে তাদের ওপর চাপ বৃদ্ধি করছে, একই সঙ্গে চীনের সমালোচনারও জবাব দিচ্ছে।’ বলেন তিনি।

‘প্রভাব’ শব্দটির ব্যবহার উল্লেখ করার মতো। যদিও অনেকে মনে করেন, মতামতকে প্রভাবিত করতে চীনের অনেক সূক্ষ্ম কৌশল রয়েছে।

ইভানিনা নিশ্চিত নন যে চীন এবারের নির্বাচনে ঠিক কতদূর অগ্রসর হতে পারে। তবে তিনি বলেন, “আগ্রাসী তৎপরতা থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য চীন এই ঝুঁকি নেওয়া অব্যাহত রাখবে।”

চীনের ইচ্ছা হয়তো সারা বিশ্বের ব্যাপারে তাদের যে মতামত সেটা তুলে ধরা। ফেসবুক সম্প্রতি কিছু চীনা অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত একটি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছে। এসব নেটওয়ার্ক থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের মতো বিরোধের ইস্যুতে বেইজিংয়ের স্বার্থের পক্ষেই কাজ করছিল।

অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীন। বেইজিং বলছে, এ ধরনের কাজ করতে তারা অনিচ্ছুক এবং এ রকম কিছু করতে তারা আগ্রহীও নয়।

প্রার্থীরা কী বলছেন

অক্টোবর মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি নিবন্ধ রিটুইট করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীন জো বাইডেনের পক্ষ নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

জো বাইডেনের ছেলে হান্টারের কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লিখেছেন, অবশ্যই তাঁরা বাইডেনকে চায়। আমি চীনের কাছ থেকে শত শত কোটি ডলার নিয়ে সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার এবং আমাদের দরিদ্র কৃষকদের দিয়েছি। বাইডেন আর হান্টার জিতে গেলে চীন যুক্তরাষ্ট্রকেও জিতে নেবে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন খুবই খারাপ পর্যায়ে। করোনাভাইরাস থেকে শুরু করে হংকংয়ে চীনের আরোপিত নতুন নিরাপত্তা আইন নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে তিক্ত বিরোধ তৈরি হয়েছে।

ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন যে চীনের ব্যাপারে জো বাইডেনের অবস্থান নরম। বাইডেন এই অভিযোগ খণ্ডনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, মানবাধিকারসহ অন্যান্য ইস্যুতে তিনি চীনের বিরুদ্ধে কঠোর হবেন।

তবে তাঁর দল ডেমোক্র্যাটদের যুক্তি হচ্ছে, অন্তত নির্বাচনের ব্যাপারে চীনের চেয়েও রাশিয়া অনেক বেশি আগ্রাসী।