বাংলাদেশে করোনাকালে মানবতা
।। আবুল কাসেম ফজলুল হক ।।
যেসব গুণ শুধু মানুষের আচরণে আছে, অন্য কোনো প্রাণীর আচরণে নেই, সেগুলোই মানবিক গুণ। মানবিক গুণাবলিই মানবতা বা মনুষ্যত্ব। কোনো ব্যক্তির মধ্যে মানবিক গুণাবলির অভাব ঘটলে সেই ব্যক্তি অমানুষ বা পশু বলে অভিহিত হয়। সমাজে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিজয় ও বিকাশ এবং পাশবিক প্রবণতার পরাজয় ও অবদমন কাম্য। মানুষের স্বরূপ বিবেচনা করলে মনে হয় না যে মানুষের মধ্যকার পাশবিক প্রবণতা নির্মূল করা যাবে।
ব্যক্তিগত মানবতার মতোই আছে জাতীয় মানবতা। প্রত্যেক জাতির জীবনেই মানবতা গতিশীল। এর গতিপথ আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু ও অভ্যন্তরীণ বিরোধে জটিল। বৈশ্বিক মানবতাও অত্যন্ত জটিল। মানবিক গুণাবলির বিকৃতিও ঘটে।
কোনো রাষ্ট্রে মানবিক গুণাবলির প্রতি নাগরিকদের আস্থা থাকলে তারা সেই গুণাবলি রক্ষা করে চলতে এবং কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবন ও পরিবেশকে উন্নত করতে চেষ্টা করে। তাতে রাষ্ট্রে সুশাসন সম্ভব হয়। সমাজে মানবিক গুণাবলির প্রতি শ্রদ্ধা কমে গেলে ভাঁওতা-প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জুলুম-জবরদস্তি, অসামাজিক কার্যকলাপ, হত্যা, আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। তাতে রাষ্ট্রে দুঃশাসন অনিবার্য হয়। অবশ্য সরকার, রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের ভূমিকা থাকে। জনসাধারণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনসাধারণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে। নেতৃত্ব সৃষ্টিতে জনসাধারণেরও ভূমিকা থাকে।
চিন্তাশীলতা, ভাষা, উৎপাদনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা, মূল্যবোধ, নৈতিক চেতনা, আইন-কানুন, রীতি-নীতি, স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সম্প্রীতি, সর্বজনীন কল্যাণবোধ, ধর্ম, আদর্শ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, পরিবার, জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে মানুষ চলছে। এসবের ভালো-মন্দ অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় মানুষের সভ্যতা। সভ্যতাই মানবতার অবলম্বন। সংস্কৃতি সভ্যতারই নামান্তর। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষ উন্নতি করতে পারে, পরিবেশকেও উন্নত করতে পারে। অন্য কোনো প্রাণীই এসব পারে না। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের কর্মশক্তি ও সৃষ্টিশক্তি বিকশিত হয় এবং এই বিকাশের সম্ভাবনা অন্তহীন।
মানবতা বা মনুষ্যত্ব নিয়ে বলার মতো আরো অনেক কথা আছে। আপাতত সেসব কথায় না গিয়ে আমরা বুঝতে চাই, করোনাভাইরাসের ফলে গোটা পৃথিবীতে মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখন মানবতার অবস্থা কী? বাংলাদেশেই বা এই সময়ে মানবতার অবস্থা কেমন।
এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া—সব মহাদেশেই করোনার বিস্তার ঘটেছে। সব রাষ্ট্রেই সরকার করোনাকালের জন্য কঠোর বিধান জারি করছে, যেগুলো জনসাধারণ মেনে চলছে। বাংলাদেশেও সরকারের ঘোষিত বিধি-বিধান আছে।
কঠোর সব বিধি-বিধান সত্ত্বেও মানুষের কাজকর্মও চলছে। অফিস চলছে, কলকারখানা চলছে, মালপত্রের আনা-নেওয়া চলছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বাংলাদেশেও লোকে বিধি-বিধান মেনে কাজ করছে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। সরকার তাদের যথাসাধ্য সাহায্য দিচ্ছে। মানুষ জীবনের প্রয়োজনে, অস্তিত্বের প্রয়োজনে কাজ করছে।
লক্ষ করার বিষয় এই যে করোনাকালের আগে যেসব অপরাধমূলক কাজ চলত তার সবই করোনাকালেও চলছে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন অনেক বেড়েছে। সরকার ধর্ষণের শাস্তি প্রাণদণ্ড পর্যন্ত বাড়িয়েছে। ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ যথাবিহিত চলছে। নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন চলছে। নির্বাচনে সুষ্ঠুতা নেই। নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত। অফিসাদিতে দুর্নীতি চলছে। নানা রকম দুর্নীতির অভিযোগে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগ প্রভৃতি সংগঠনের বহু লোক অভিযুক্ত হচ্ছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন অত্যন্ত সতর্ক ও সক্রিয়। করোনাকালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রশাসনে দুর্নীতির জন্য অনেক বেশি লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। ব্যবসায়ী মহলের অনেক লোককে দুর্নীতির জন্য মামলায় ফাঁসাচ্ছে, সরকারি দলের বহু লোক সমাজের স্তরে স্তরে, গ্রামে ও শহরে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-জবরদস্তি চালাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ ও জবরদস্তিপরায়ণ লোকেরা অনেক বেশি অপকর্মে লিপ্ত। সরকার গরিবদের জন্য যে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেই মাল আত্মসাৎ করছে সরকারি দলের লোকেরা। সরকার টিকে আছে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সক্রিয় করে। মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে সাময়িকভাবে দমন করা যায়, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে সব রাষ্ট্রেই গতরখাটা মানুষদের শ্রমের ফলে উৎপাদন অনেক বেড়েছে। ১৯৮০-র দশক থেকেই এই উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদ বৃদ্ধির ব্যাপারটি বোঝা যাচ্ছে। দুনিয়াব্যাপী সব মানুষেরই ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা এখন সম্ভব হচ্ছে। আগে লোকসংখ্যা কম থাকলেও উৎপাদন কম হওয়ার ফলে সবার ভাত-কাপড়ের সুযোগ ছিল না। এখন আইন ও বিধি-বিধান উন্নত করে ন্যায় বাড়ালে এবং অন্যায় কমালে দুনিয়াব্যাপী সব মানুষেরই সম্মানজনক জীবনযাত্রা সম্ভব হবে। বাস্তবে ঘটছে এর বিপরীতটা। অসাম্য বাড়ছে, অন্যায়-অবিচার বাড়ছে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্তরে মানুষের মধ্যে ভারসাম্য কমছে। ফলে শাসক শ্রেণির স্বার্থে দমননীতি কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে, মামলা-মোকদ্দমা, জেলখানা, ফাঁসিকাষ্ঠ ইত্যাদিকে জোরদার করা হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে র্যাব ক্লিনহার্ট অপারেশন, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার বন্দুকযুদ্ধ চালু করা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং তাকে অত্যন্ত সক্রিয় করা হয়েছে, ধর্ষণের শাস্তি প্রাণদণ্ড পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছে। কিন্তু এসবের দ্বারা অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। দমননীতিকে আরো শক্তিশালী করারই চিন্তা-ভাবনা দেখা যাচ্ছে, আইন-কানুন উন্নত করে ন্যায় বাড়ানোর ও অন্যায় কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সব মহাদেশের সব রাষ্ট্রেই দমননীতিকে কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে। ন্যায় বাড়ানোর ও অন্যায় কমানোর জন্য আইন-কানুন ও বিধি-বিধানকে উন্নত করার কথা ভাবা হচ্ছে না। চীন ও আরো কিছু রাষ্ট্র দমননীতি অবলম্বন করছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুসারীরা চীনের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে, চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বোঝার চেষ্টা করছে না।
পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র চলছে বিশ্বব্যাংকের উন্নয়নতত্ত্ব নিয়ে। এই উন্নয়নতত্ত্ব গুরুত্ব দেয় মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধিতে, রাষ্ট্রের মোট আয় বৃদ্ধির শতকরা হারে, আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। এতে মানবতার বিবেচনা প্রায় নেই। উৎপাদন ও সম্পদ যত বাড়ছে, মানবতা ততই নিগৃহীত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা শুধু টাকা বা ডলার দিয়ে উন্নয়ন হিসাব করছেন।
উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য আজ দরকার রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন। সে লক্ষ্যে নতুন চিন্তা-ভাবনা দরকার।
ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ (১৯৯১) পর্যন্ত সময়ে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই মানুষ ছিল পরিবর্তন-উন্মুখ। তখন মানুষের ধারণা ছিল, পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নততর অবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এসব মানুষের মনের অবস্থাকে অন্য রকম করে ফেলা হয়েছে। এখন লোকে মনে করে, পরিবর্তন হলে অবস্থা আরো খারাপ হবে। ফলে মানুষ এখন পরিবর্তনবিমুখ। আগে মানুষ মানবতা বা মনুষ্যত্বকে যে গুরুত্ব দিত, তার কিছুই আর এখন নেই। পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ধনতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে চলছে এবং নিচের স্তরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কোনো রকমে অস্তিত্ব রক্ষার চিন্তার বাইরে কোনো কিছু ভাবে না। ধনতন্ত্র শুধু ধনিক শ্রেণির বা শাসক শ্রেণির অল্প কিছু লোকের ব্যাপার নয়; প্রায় সব রাষ্ট্রে নিম্নমধ্যবিত্তরাও ধনী হওয়ারই চিন্তা করে। ধনতান্ত্রিক মানসিকতা শুধু বুর্জোয়াদের ব্যাপার নয়, শতকরা অন্তত ৬০ ভাগ মানুষ ধনতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে চলছে। কেন্দ্রীয় প্রবণতা বেশি থেকে আরো বেশি সম্পদের মালিক হওয়া।
যে সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক, কবি, শিল্পী, ঋষি ও ধর্ম প্রবর্তকরা মানুষকে দেখাতেন, উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে সেই স্বপ্ন এখন হারিয়ে গেছে। দুনিয়ায় মানুষের সামনে এখন কোনো আদর্শ নেই, ধর্মও নেই। ইতিহাসের চাকাকে পেছন দিকে ঘুরিয়ে ধর্মের পুনরুজ্জীবনের যে ব্যাপার লক্ষ করা যায়, তাকে বুঝতে গেলেই দেখা যায়, এতে আছে শুধু স্বার্থের ব্যাপার, ধর্ম নেই। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারে ভীষণভাবে তৎপর ছিলেন, তাঁরাও সুবিধাবাদী হয়ে ধর্মের কথা বলেন শুধু ক্ষমতার প্রয়োজনে।
এই বাস্তবতার মধ্যে মানবতার প্রয়োজনে, ন্যায় বাড়ানোর ও অন্যায় কমানোর জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার। বাংলাদেশের নাগরিকদেরও এই বাস্তবতা ও করণীয় উপলব্ধি করতে হবে। এ নিয়ে সব রাষ্ট্রেই গভীর ও ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা দরকার। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আদর্শও উদ্ভাবন করা দরকার।
উদার গণতন্ত্রের পরিবর্তে সর্বজনীন গণতন্ত্র, দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার নিয়ে খুব ভাসা ভাসা কিছু চিন্তা দেখা গেছে। কিন্তু পারম্পর্য রক্ষা করে বিক্ষিপ্ত চিন্তাকে চিন্তাধারারূপে বিকশিত করার প্রচেষ্টা নেই। প্রচারমাধ্যম চলমান ধারাকেই অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট। যে পরিবর্তন সাধনের কথা আমরা বলছি তার পক্ষে বিশিষ্টজনদের একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সর্বজনীন কল্যাণের পরিচ্ছন্ন বক্তব্য নিয়ে গেলে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে করি। সাধারণ মানুষ এখন ঘুমন্ত। ঘুমন্ত মানুষদের জাগাতে হবে। দুনিয়াব্যাপী কায়েমি স্বার্থবাদীরা জনসাধারণের এই ঘুমন্ত অবস্থাকেই বজায় রাখার চেষ্টায় লিপ্ত। নতুন রেনেসাঁস ও নতুন গণজাগরণই প্রথমে কাম্য। তারপর পরিস্থিতি বুঝে ধাপে ধাপে নতুন নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে চলতে হবে।
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়