সেলসম্যানের ঘর থেকে হোয়াইট হাউসের পথে

Published: 7 November 2020

পোস্ট ডেস্ক : রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন।

ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ম্যাজিক সংখ্যা ২৭০টি নিশ্চিত করেছেন তিনি।

সাধারণ একটি পরিবার থেকে উঠে এসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া- বাইডেনের দীর্ঘ লালিত স্বপ্নের এই পথ মসৃণ ছিল না। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। হাল না ছেড়ে লেগে থাকার মধ্য দিয়ে পূরণ হতে যাচ্ছে তার স্বপ্ন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর পেনসিলভানিয়ার স্ক্রানটনে জন্মগ্রহণ করেন বাইডেন। তিনি বসবাস করেন ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের উইলমিনটনে। তার পিতার নাম জোসেফ রবিনেট বাইডেন সিনিয়র।

বাইডনের জন্মের আগে তার বাবা ভালো একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু বাইডেনের জন্মের পর ব্যবসায় ধস নামে। এক পর্যায়ে তিনি চুল্লি পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন।

পুরনো কার বিক্রয় কর্মী হিসেবে কাজ করেন জোসেফ রবিনেট। এ কারণে বাল্যকালে আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয় বাইডেনকে।

 

পড়াশোনা ও বিয়ে

বাইডেন ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের সেন্ট পল’স ইলেমেন্টারি স্কুলে প্রাথমিক ও আর্কেমিয়ার একাডেমি এবং স্টে হেলেনা স্কুলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা করেন।

তারপর ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ার থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা থেকে খেলাধুলা, নারী ও পার্টি তাকে বেশি টানত। এ কারণে কলেজে বাড়তি দুই বছর কাটান খ্যাতিমান এ রাজনীতিক।
পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা ও আড্ডায় থাকার সময় তার মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিশেষত ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডির প্রেসিডেন্ট অভিষেক বক্তৃতা বাইডেনকে রাজনীতির প্রতি ঝোঁক এনে দেয়।

ছাত্র থাকাবস্থায় সাইরাকস ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নেইলিয়া হান্টারের সঙ্গে পরিচয় হয় বাইডেনের। পরিচয় থেকে ভালো লাগা ও পরিণয়।

নেইলিয়ার প্রেমে পড়ে বাইডেন নিজেও সাইরাকস ইউনিভার্সিটির ল’ স্কুলে আবেদন করেন এবং আইন নিয়ে পড়ার সুযোগ পান।

১৯৬৫ সালে ডেলাওয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েট হওয়ার পর ল’ পড়তে যান এবং ১৯৬৬ সালে নেইলিয়া হান্টারকে বিয়ে করেন।

 

রাজনীতিতে যোগদান

১৯৬৮ সালে আইন পাস করার পর উইলমিংটনে ফিরে যান বাইডেন। সেখানে আইনের প্র্যাকটিস শুরু করেন। একই সঙ্গে ডেমোক্রেটিক দলের সক্রিয় কর্মী হিসেবেও কাজ করতে থাকেন।

আইনের প্র্যাকটিস করতে গিয়ে ধনী ও প্রভাবশালীদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে চাপ অনুভব করেন তরুণ বাইডেন। একই সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় ১৯৭০ সালে নিউক্যাসল কাউন্টি কাউন্সিলে নির্বাচন করে জয়ী হন। ১৯৭১ সালে নিজের একটি ল’ ফার্ম খোলেন বাইডেন।

সন্তান ও নাতি-নাতনি

রাজনীতি ও আইন পেশায় প্রচুর ব্যস্ত থাকলেও পরিবারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েননি তিনি। ১৯৬৯ সালে তার প্রথম সন্তান জোসেফ বাইডেন তৃতীয় (বো), ১৯৭০ সালে হান্টার বাইনে ও ১৯৭১ সালে মেয়ে নাইওমি বাইডেন জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৭২ সালে ডেলওয়ারে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী নেইলিয়া ও মেয়ে নাওমি মারা যান। মারাত্মক আহত হন দুই ছেলেও।

ওই সময় তিনি প্রথমারের মতো সিনেটর নির্বাচিত হয়ে কংগ্রেস অফিসের জন্য লোক নিয়োগের সাক্ষাৎকারে ওয়াশিংটনে ছিলেন।

১৯৭৭ সালে বর্তমান স্ত্রী জিলকে বিয়ে করেন বাইডেন। এই ঘরে তার তিন কন্যা রয়েছে অ্যাশলি, নাওমি (মৃত কন্যা নাওমির নামে) ও ফিনেগান বাইডেন নামে। নাতি-নাতনি রয়েছে বাইডেনের ছেলে ও মেয়ের ঘরের মোট পাঁচজন।

 

সিনেটর নির্বাচন, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি

জো বাইডেন একজন লড়াকু মানুষ। তিনি লক্ষ্য স্থির করে কাজ করেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ের পর ৩০ বছর বয়সে সিনেটর হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেন।

মার্কিন আইন অনুযায়ী ৩০ বছর বয়স না হলে সিনেটর হিসেবে শপথ নেয়া যায় না। ১৯৭২ সালে ডেমোক্রেটিক দল বাইডেনকে ডেলাওয়ারের রিপাবলিকান জনপ্রিয় সিনেটর জে. ক্যাবেল বোগসের বিরুদ্ধে প্রার্থী করে।

বাউডেন ইয়াং প্রার্থী হিসেবে বোগসকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্ত্রী ও মেয়ে নাওমি।

ওই ঘটনায় বাইডেন এমনই ভেঙে পড়েন যে, তিনি আর রাজনীতি না করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভাবেন তিনি। কিন্তু দলের অনুপ্রেরণায় আবারও ফিরে আসেন।

এছাড়া বাল্যকাল থেকে তোতলানোর অভ্যাস থাকায় সহপাঠী, এমনকি শিক্ষকদের কাছ থেকেও বিদ্রুপের শিকার হন তিনি। তবে সবকিছু কাটিয়ে ওঠেন লড়াকু বাইডেন।

নিজের জীবন বাইডেনকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আপনজন হারানো, মানুষের বিদ্রুপ। এমনকি ২০১৫ সালে তার প্রিয় সন্তান বো বাইডেনও মারা যান। তার পরও থেমে থাকেননি বাইডেন।

তার পিতার একটি কথা তাকে অনুপ্রেরণা দেয়। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাকে কে কতবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সেটি বড় কথা নয়। তুমি কত দ্রুত উঠে দাঁড়াতে পেরেছ সেটাই তোমার সাফল্যের পরিচায়ক।’

বাবার এই কথা আমলে নিয়ে বাইডেন কখনও হারেননি। ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হতে না পারা, ২০০৮ সালেও একই অবস্থা হয়।

তারপর বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদ পার করার পর ২০১৫ সালে প্রার্থিতার প্রস্তুতির সময় ছেলের মৃত্যু। কিন্তু সেটিও কাটিয়ে উঠে বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে প্রাইমারিতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উঠে আসেন বাইডেন।

দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অনেকদিন থেকেই হোয়াইট হাউসে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছিলেন বাইডেন। বলা যায়, এ নির্বাচনই সম্ভবত ৭৭ বছর বয়সী বাইডেনের শেষ চেষ্টা ছিল।