মিয়ানমারে টেকসই গণতন্ত্রের পক্ষে বিশ্ব
।। গাজীউল হাসান খান ।।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাঝেমধ্যে বাঙালির একটি জনপ্রিয় প্রবাদ উল্লেখ করতেন তাঁর বিভিন্ন জনসভার ভাষণে। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি বলতেন, ‘বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে গেছ ধান, এইবার ঘুঘু তব বধিব পরান।’ মিয়ানমারের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দেশটির সামরিক কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা যেন সে প্রবাদবাক্যটি নিয়েই এখন সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তারা চেয়েছিল, তাদের প্রিয় নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বে একটি নির্বাচিত kalerkanthoসরকারের অধীনে দেশ পরিচালনা করতে। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা ঠেকিয়ে রাখার জন্য মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসকরা তৎপর রয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসনের অধীনে মিয়ানমারে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করাই তাদের নীলনকশার মূল উদ্দেশ্য বলে দেশটির রাজনীতি কিংবা অধিকার সচেতন মানুষের বিশ্বাস। তাদের ধারণা, মূলত সে কারণেই গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল ঘোষণা করেছে সামরিক বাহিনী। দেশের নবনির্বাচিত প্রধান কর্মাধ্যক্ষ অং সান সু চিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছে মিয়ানমারের জান্তা।
মিয়ানমারের মিলিটারি সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং দেশে সামরিক আইন জারি করেই নবনির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চিসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করেছেন এবং অন্তরিন করেছেন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উইন মিনকে। সামরিক জান্তার অভিযোগ, গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ ছিল না। সে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই তারা (জান্তা) সে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। সামরিক জান্তা নতুন নির্বাচন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে কবে ও কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে সে নির্বাচন, তা এখনো উল্লেখ করেনি। এরই মধ্যে মিয়ানমারের জনপ্রিয় নেত্রী অং সান সু চিকে আদালতে তোলা হয়েছে। রাখা হয়েছে অন্তরিন অবস্থায়। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিতদের স্থলাভিষিক্ত করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। মিয়ানমারে অতীতের সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা হস্তক্ষেপের কথা ছেড়ে দিলেও গত দুই দশক সামরিক শাসকরা একটানা দেশ শাসন করেছে। তারা ১৯৯০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছিল। তার পরও তারা একটি ১১ সদস্যের মিলিটারি স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল গঠন করে তাদের রাজনৈতিক ও বিশেষ করে প্রশাসনিক প্রভাব বজায় রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে মিয়ানমারের জননেত্রী অং সান সু চি বিগত অর্ধদশক সেনানায়কদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিলেন। সামরিক স্বৈরশাসকরা অং সান সু চির জনপ্রিয়তা এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থার কথা ভালো করেই জানতেন। রাজনীতি ও শ্রেণিগতভাবে তাঁরা ছিলেন এ অবস্থার ঘোর বিরোধী। অন্যান্যের মধ্যে তাদের একটি ধারণা জন্মেছিল, জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দেশ রসাতলে যাবে, বিভিন্ন অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এবং শেষ পর্যন্ত বহু বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক সংঘর্ষ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মিয়ানমারের অখণ্ডতা ধরে রাখা যাবে না। তার প্রভাব প্রতিবেশী ভারত কিংবা এমনকি চীনেও পড়তে পারে। সে রাজনৈতিক বোঝাপড়াকে ভিত্তি করে বাণিজ্য ও সামরিক সাজসরঞ্জামের সরবরাহকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের অপ্রকাশিত অথচ গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫ থেকে সু চির সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সে বছর অং সান সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছিল। সে পরিস্থিতি কিংবা অবস্থাদৃষ্টে মিয়ানমারের ধূর্ত সামরিক গোষ্ঠী একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নির্বাচিত দেশনেত্রী অং সান সু চির রাজনৈতিক বক্তব্য, কর্মকাণ্ড কিংবা গতিবিধির ওপর সামরিক গোষ্ঠী তীক্ষ নজর রাখছিল। শুরু থেকেই তারা তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ ছাড়া তারা তাদের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা ধরে রেখেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। সংসদে এক-চতুর্থাংশ আসন তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল।
এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা কিংবা পরিস্থিতিকে মিয়ানমারবাসী খুব একটা সহজভাবে নিতে পারেনি। তারা একটি দৃশ্যমান ও অর্থবহ পরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিল। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালকে ‘স্থিতিশীল গণতন্ত্রের আবির্ভাবকাল’ বলে মিয়ানমারবাসী উল্লেখ করে থাকে। সে জন্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গত নভেম্বরের নির্বাচনটি ছিল তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভের কারণে সু চি সামরিক শাসকদের কাছে নতুনভাবে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান। তারা দেখতে পায় একে একে তাদের সব আশঙ্কাও এখন দ্রুত সামনে এগিয়ে আসছে। সু চির বিপুল বিজয় দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রত্যাশাকে সুদৃঢ় করে তুলছিল। একুশ শতকের মিয়ানমারের তরুণরা অত্যন্ত আধুনিক ও পাশ্চাত্যমুখী। এ ছাড়া গণতন্ত্রমনা ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। সে কারণে সারা মিয়ানমারে এখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। গত ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে শতাধিক আন্দোলনকারী সামরিক বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। রেঙ্গুন, মান্দালয়সহ বিভিন্ন নগরীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। কখনো কখনো, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা, কারখানার শ্রমিকরা এবং এমনকি অফিস-আদালতের কর্মচারীরা সামরিক শাসন ও শাসকদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়েছে। তারা অবিলম্বে সু চির মুক্তির দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে রাখছে। তারা সু চির নিঃশর্ত মুক্তি এবং সামরিক শাসনের অবসান চায়। এরই মধ্যে নিশিকালীন কারফিউ প্রত্যাহার ও আন্দোলনকারীদের ঘরবাড়ি তল্লাশির মতো কাজগুলো বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। সামরিক আইন প্রত্যাহার ও সভা-সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিতে সর্বাত্মক এক আন্দোলনে নেমেছে ছাত্র-জনতা।
মিয়ানমারের এবারের গণ-অসন্তোষ ও গণ-আন্দোলনের চরিত্র বেশ কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির বলে মনে করা হয়। ছাত্র-জনতা মিয়ানমারে আর সামরিক বাহিনীর ছড়ি ঘোরানো চলতে দিতে চায় না। ২০১৬-১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতা এবং গণহত্যারও প্রতিকার কিংবা সমাধান চায় সংগ্রামী ছাত্র-জনতা। সামরিক জান্তার প্রতি চীনের সমর্থন কোনোভাবেই সমর্থন করে না প্রতিবাদী মানুষ। তাদের ধারণা, চীন ও ভারতের সমর্থনের কারণেই মিয়ানমারে সামরিক স্বৈরশাসন টিকে রয়েছে। তাই চীনের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কারখানা ও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এ অবস্থায় জাপান তাদের দুটি যৌথ মালিকানার কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সামরিক শাসক অং হ্লাইং ও তাঁর ঊর্ধ্বতন সহকারীদের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে সামরিক শাসক ও মিয়ানমারের বাণিজ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ কথা ঠিক, সমগ্র মুক্তবিশ্ব এখন অং সান সু চির মুক্তি, সামরিক শাসনের অবসান এবং সর্বোপরি মিয়ানমারে একটি টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। বর্তমান বিশ্বে সামরিক ব্যক্তিদের প্রভাবাধীন একমাত্র দেশ হচ্ছে এখন মিয়ানমার, যা সভ্য ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম নাগরিককে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। তাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা বছর গড়িয়ে গেলেও সুস্পষ্টভাবে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না এখনো। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। এভাবে আধুনিক যুগে একটি দেশ কিংবা একটি জাতি বেশিদিন চলতে পারে না। মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষ অবিলম্বে এর অবসান চায়। চীন ও ভারতের মতো শক্তিশালী দেশগুলো এটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে না, এমন নয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সার্বিক দিক থেকে উত্তরোত্তর চাপ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে গণতন্ত্রকামী মানুষ মনে করে। এভাবে এমন একটি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলা যেতে পারে না। সামরিক জান্তাদের স্বৈরাচারী কার্যকলাপের অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক। এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে হবে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী মানুষকে। অতিদ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। মিয়ানমারের সংগ্রামী জনতা শূন্য হাতে এবার ঘরে ফিরবে না। তারা গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। সুতরাং তাদের এবারের সার্বিক সংগ্রাম বিফলে যাবে বলে মনে হয় না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক