স্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতায় অর্থনীতি ভুগবে কেন

Published: 5 April 2021

।। আহসান এইচ মনসুর।।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এ সময় সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস, আদালত ও বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ করবে। শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজ চলবে।

সরকার অবশ্য বলছে প্রয়োজনে লকডাউনের সীমা বাড়বে। প্রজ্ঞাপন থেকে এটা স্পষ্ট যে, এ লকডাউন ‘লিমিটেড’। সবাই সীমিতভাবে অনেক কিছুই করতে পারবে। অনেক প্রতিষ্ঠান চালু থাকবে। করোনা সংক্রমণ যে গতিতে বাড়ছে তাকে কিছুটা স্তিমিত করতে লকডাউন লাগবে, তবে শুধু সীমিত লকডাউনে কাজ হবে না।

গত বছরের সঙ্গে এ লকডাউনের একটি বড় পার্থক্য আছে। গত বছর সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর হাজার হাজার মানুষ গ্রামে ফিরে যায়। আবার গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসে। এতে করোনা গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার এ বছর আন্তঃজেলা গণপরিবহনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তারপরও অনেকেই বড় শহর ছাড়ছে ও ছাড়বে বিভিন্নভাবে। এই সমস্যা সামলানো কীভাবে সম্ভব হবে তা জানি না। তবে গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার। কারণ সামনে ঈদ। এই লকডাউনের ফলে হয়তো মানুষের চলাফেরা সীমিত হবে। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে মানুষের যাতায়াত, সমাগম বাড়বে। গণপরিবহন, শপিংমলসহ হাটবাজারে মানুষের ভিড় বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আগে সংক্রমণ কমে না এলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কাজেই লকডাউন ঘোষণা করে নিরাপদ বোধ করা সমীচীন হবে না।

বস্তুত পুরোদমে লকডাউন দেওয়ার পরিস্থিতিও আমাদের নেই। সাধারণ মানুষ তাতে বিপর্যয়ে পড়বে। আমাদের অর্থনীতি আগামী দিনে কেমন থাকবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এবারের লকডাউনের কারণে আমাদের বড় দুটি উৎসব তথা পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর সেভাবে উদযাপন হবে না। ফলে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। আমরা জানি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা যে কোনো দেশের মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার মূল ক্ষেত্র হলো দুই ঈদ ও পহেলা বৈশাখ। গত বছর আমরা এক্ষেত্রে বড় ধাক্কা খেয়েছি। এ বছরও একই অবস্থার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা হচ্ছে।

বাংলাদেশের মতো দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেই হবে। সেটি সরকার বুঝেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি যাতে কম হয় সেজন্য লকডাউনের মধ্যে কলকারখানা চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আমরা দেখেছি কলকারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু রাখা সম্ভব। কলকারখানায় যে সংক্রমণ ঘটেনি বা ঘটবে না তা বলা যায় না। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, কলকারখানার চেয়ে অধিক সংক্রমণ হয়েছে হাটবাজার, গণপরিবহন ও অন্যান্য জনসমাগম থেকে। কাজেই কলকারখানা চালু রাখার সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে। তবে সেখানে যাতে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।

২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর আমরা অনেকটা সময় পেয়েছি। করোনা সংক্রমণ রোধে আমাদের করণীয়গুলো আমরা সঠিকভাবে পরিপালন করতে পারিনি। ফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থানে এসেছে এবং লকডাউনের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। আমাদের হাতে তথ্যের বড় ঘাটতি রয়েছে। করোনা সংক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিশেষ করে কোন বয়সের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সে বিষয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে পঞ্চাশোর্ধরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের যদি নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করা যেত তাহলে প্রাণহানি হয়তো কমত। বাড়ি থেকে যারা বাইরে কাজ করতে যাবে তাদের থেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের পুরোপুরি আলাদা করে রাখতে হবে। কারণ সংক্রমণ বাড়ছে যারা বাইরে যাচ্ছে তাদের মাধ্যমে। তারাই ভাইরাস বহন করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে এবং এতে অন্যরা আক্রান্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে শুরুতেই জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার ছিল। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। এখন উচিত হবে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তরুণ ও বয়স্কদের আলাদা করা। বয়স্কদের বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। এটা করা না গেলে সংক্রমণ রোধ করা যাবে না।

বাংলাদেশ প্রায় এক বছর সময় পেয়েছে জনস্বাস্থ্য খাতটি গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু কার্যত আমরা দেখলাম সরকারি হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা সেভাবে বৃদ্ধি করা হয়নি। সরকারি হিসাবেই জানা যায়, শত শত আইসিইউ ইউনিট গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরকারি গুদামে মাসের পর মাস পড়ে আছে। সেগুলো মাঠ পর্যায়ে বিতরণ করা হয়নি। এসব যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য দক্ষ মেডিকেল কর্মীও নিয়োগ দেওয়া দেয়নি। সরকার সংগত কারণে বাজেটে স্বাস্থ্য খাত সম্প্রসারণের জন্য ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কিন্তু গত আট মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সে বাজেটের মাত্র ২২ শতাংশ ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে অবশ্যই জবাবদিহি থাকা উচিত। স্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতায় অর্থনীতি ভুগবে কেন?

করোনা সংক্রমণের মধ্যে দেশব্যাপী হাজার হাজার ধর্মসভা হলো, বিসিএস পরীক্ষা, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণসহ লাখ লাখ মানুষের সমাগম করে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হলো। এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দেওয়ার মাশুল দিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে আমাদের বড় ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা রয়েছে। আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। অনেকাংশে ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনীয় শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনা একটি স্মার্ট ভাইরাস, সুতরাং এর মোকাবিলায় আমাদেরও স্মার্ট হতে হবে। আমরা কোনোভাবেই আনস্মার্ট হতে পারি না। আমাদের বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা মানতে হবে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে হসপিটাল ক্যাপাসিটি কমানো হয়েছে। শুরুর দিকে যে হাসপাতালগুলোকে কভিড আক্রান্তদের সেবাদানের জন্য ডেডিকেটেড করা হয়েছিল সংখ্যার দিক থেকে সেটি কমিয়ে আনা হয়েছে। বসুন্ধরায় হাসপাতালের জন্য সরকার মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই হাসপাতালে একজন রোগীকেও সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি। যেহেতু পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে সুতরাং হসপিটাল ক্যাপাসিটি চার-পাঁচগুণ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে।

এর পাশাপাশি ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি জোরদার করা গেলে হার্ড ইমিউনিটির দিকে যাওয়া সহজ হবে। কিন্তু ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচির গতি-প্রকৃতি বলে দিচ্ছে এর জন্য অন্তত দুই-তিন বছর সময় লেগে যাবে। তখন এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা থাকবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার কোনো অংশে কম নয়। আমাদের ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচিও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতার কারণে ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি জোরদার করা যাচ্ছে না। ফলে আমরা সম্ভবত একটি বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি, যেখানে অনেক মানুষ সংক্রমিত হবে, এমনকি সবাই সংক্রমিত হতে পারে। শুধু এই লিমিটেড লকডাউনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। সরকারকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট