বাজেটে কর্মসংস্থান ভাবনা এবং বাস্তবতা

Published: 9 June 2021

।। ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।।

বাজেট নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ, হিসাব-নিকাশ, আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অন্যান্য বছরের মতোই বাজেট প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে, ‘বাজেটে কী থাকছে—আর কী থাকছে না।’ বিশেষ করে বর্তমান বাস্তবতায় দেশে কর্মসংস্থান প্রসঙ্গটি অত্যন্ত আলোচিত হচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দীর্ঘ সময় করোনার প্রকোপে কর্মসংস্থান সংকটে বেকারত্বের হার বেড়েছে। অতিমাত্রায় হতাশ হয়েছেন উচ্চশিক্ষিতরা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণদের অনেকের জীবন বিষাদময় হয়ে উঠেছে। ফলে এবারের বাজেটের দিকে বেকার তথা চাকরিপ্রত্যাশীদের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। বাজেটে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কী এবং কেমন থাকছে—সেটি খুঁজে বেড়াচ্ছে তরুণরা।

এক বছরের বেশি সময়ে করোনার প্রকোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা যেভাবে শঙ্কায় নিমজ্জিত হয়েছে, তাতে বাজেটে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ভালো ক্ষেত্র তৈরি করার প্রসঙ্গটি এখন খুব ন্যায্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা না হলে এর ভয়াবহ পরিণাম আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।

গত কয়েক দিন আগে স্নাতকপড়ুয়া আমার এক ছাত্র কুশল বিনিময়ের লক্ষ্যে আমাকে ফোন করে তার হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে একটি আবেগজড়িত অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। সে জানাল, তার মা-বাবা হতাশ হয়ে ইদানীং বলছেন, কেন যে তাঁরা ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন! কেন তাকে ছোটবেলা থেকেই কোনো কাজে লাগিয়ে দেননি! তাঁরা মনে করেন, যদি পড়াশোনা না করিয়ে কোনো কাজে লাগিয়ে দিতেন, তাহলে আজ হয়তো উচ্চশিক্ষিত সন্তানের এই বোঝা দীর্ঘ সময় ধরে টানতে হতো না। এমন অভিজ্ঞতা খুঁজতে গেলে অসংখ্য পাওয়া যাবে। ধরে নেওয়া যায় এটাই নিম্ন এবং মধ্যবিত্তদের বাস্তবচিত্র। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মতামত দেখলে আমরা অনুভব করতে পারি, দেশে কর্মসংস্থানের হাহাকার কতটা ভয়াবহ।

কাজেই প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থান প্রসঙ্গটি কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব কিংবা কর্মসংস্থানবান্ধব হবে তা খুঁজে দেখার ন্যায্যতা অনেক বেশি। কর্মসংস্থান নিয়ে এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রী তাঁর পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরা গণমাধ্যমে এ বিষয়ে ধারণা পেয়েছি। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, বাজেটে যেহেতু ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে, সেহেতু কর্মসংস্থান সৃষ্টিরও বেশ সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া এই বাজেটে স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ‘ইন্টার্নশিপ’ কার্যক্রমের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে উঠতে এমন ইতিবাচক চিন্তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এসব পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং এর সুচিন্তিত প্রয়োগের শঙ্কা আমাদের মনে যথেষ্ট রয়েছে।

এই মুহূর্তে চিন্তা কিংবা শঙ্কার আরো কারণ হয়েছে এ জন্য যে দেশে বিদ্যমান এই অতিমারিতে জাতীয়ভাবে যে ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, তাতে কর্মসংস্থানের সংকট সৃষ্টি হলে এর প্রভাবও তাদের ওপরেই পড়বে। ফলে বেকারদের আগামী দিনের জীবন অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে দীর্ঘ সময়ের জন্য। যেসব শিক্ষার্থী করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন, তাঁদের সামনে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমনকি যাঁদের দু-এক বছরে শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের কথা ছিল তাঁরা আজ চরম হতাশাগ্রস্ত। কারণ করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় সব চাকরির পরীক্ষাই আটকে গেছে। সরকারি চাকরির তিন লাখ ৬৯ হাজার ৪৫১টি পদ শূন্য আছে বলে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বরে জাতীয় সংসদে জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। অনেকেই আছেন, যাঁদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বেশিদিন নেই। আয়-রোজগারের পথ বন্ধ থাকলে সমাজে যে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের উদ্যোগে তারুণ্য জরিপে জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিয়ে তরুণদের উদ্বেগের বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। প্রায় ৭৪.৫ শতাংশ তরুণ মূলত ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চয়তায় থাকে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সভায় ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে একটি রূপরেখা দিতে গিয়ে বাজেটে চারটি খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। খাতগুলো হলো স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং কর্মসংস্থান। তাঁরা মতামত দিয়েছেন, অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে, অর্থনৈতিক গতি ত্বরান্বিত করবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে—এমন ব্যয় রেখে, অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল ব্যয় কাটছাঁট করা যেতে পারে।

করোনা সংকটে দেশে কত লোক কাজ হারিয়েছেন কিংবা কোন শ্রেণির মানুষ বেশি চাকরি হারিয়েছেন, এসব নিয়ে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছেও নেই হালনাগাদ তথ্য। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় সুবিধাভোগী চিহ্নিত করে সঠিক উদ্যোগও নেওয়া সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া আমাদের দেশে জাতীয় কোনো ডাটাবেইস এখনো তৈরি হয়নি। তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির কারণে সঠিকভাবে নীতি প্রণয়নও সম্ভব হয় না। আমার জানা মতে, গত কয়েক বছর শ্রমশক্তি নিয়ে নতুন হালনাগাদ কোনো জরিপ হয়নি।

কাজেই সার্বিকভাবে বলা যায়, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসংস্থান এখন সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দ এবং এর ভিত্তিতে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দাঁড় করানোর বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত যাঁরা কাজ হারিয়েছেন তাঁরা দুঃসহ জীবন যাপন করছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক কর্মী কাজ হারিয়েছেন। অনেকে নতুন করে হয়েছেন কর্মহীন। অনেকে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ অবস্থায় বেকারের তালিকা আরো দীর্ঘ হবে। কর্মহীন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। কাজে ফিরতে না পারা এসব মানুষ আরো দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছেন। করোনায় কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে এক গবেষণায় পাওয়া যায়, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এক কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন, অর্থাৎ এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের অত্যাবশ্যকতা তৈরি হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে স্থায়ীভাবে সংকট সমাধানের বিশেষ তাগিদ অনুভব হচ্ছে। বিদ্যমান শ্রমবাজারের সংকট নিয়ে একটি কর্মসংস্থান কমিশন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। ওই কমিশন চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করবে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে তরুণদের স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্র আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দের বিষয়টি ভাবনায় রাখা প্রয়োজন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়