আত্মহত্যা করবেন না নিজেকে ভালবাসুন
।। জাফর আহমাদ ।।
আত্মহত্যা করবেন না। নিজেকে ভালবাসুন। আপনার জীবনের মূল্য অনেক অনেক বেশী। এই মূল্যবান জীবনকে ধ্বংস করবেন না। জীবন থেকে পালিয়ে যাবার জন্য যারা আত্মহত্যা করে, সত্যিকারার্থে কি তারা জীবন থেকে পালাতে পারে? কখনো না, বরং এই আত্মহত্যার মাধ্যমে যন্ত্রণার যেই জীবন থেকে সে পালাতে চেয়েছিল, সেই যন্ত্রণা থেকে কখনোই নিস্কৃতি পাবে না। বরং অসীমের আরেক অধিক কঠিণ যন্ত্রণাময় জীবনে তাকে প্রবেশ করতে হবে। সেখানে লেলিহান শিখা তাকে দাহ করবে। দুনিয়ার জীবনে পালাবার সুযোগ থাকলেও সেখান থেকে সে আর পালাতে পারবে না। অনন্তকাল সেখানে তাকে জ¦লতে হবে জ¦লতেই হবে। সেখানকার যন্ত্রণা কত যে ভয়াবহ তা কোন কালি-কলম দিয়ে বর্ণনা করা অসম্ভব এবং তা মানুষের কল্পনাতীত। কুরআন-হাদীস থেকে যতটুকু অনুভব করা যায় তা নীচে সামান্যই বর্ণনা করা চেষ্ঠা করা হয়েছে। তার আগে বলুন, কেন আপনি নিজের এই মূল্যবান জীবনকে ধ্বংস করতে চাচ্ছেন? আল্লাহর এই বিশাল দুনিয়াটা কি খুব ছোট? এই মামুলী যন্ত্রণা নিভাতে আপাতত একটু বেরিয়ে আসুন না, আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দু’টো হাত প্রসারিত করুন। আল্লাহ আপনার যন্ত্রণা প্রশমিত করে দিবেন। সামনের অন্ধকার পথটি তিনি আলোকিত করে দিবেন। একটু চেষ্টা করে দেখুন।
বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় যুবক-যুবতিরাই বেশী জীবন সংগ্রাম থেকে পালাবার জন্য আত্মহত্যার ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়। আমাদের ্এতদঞ্চলে তুচ্ছ খুবই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ধরণের ধ্বংসের পথে পা বাড়াতে দেখা যায়। যেমন: অবৈধ কোন প্রেমের ব্যর্থতা বা প্রতারণা, পারিবারিক কলহ, বখাটেদের উৎপাত, পরীক্ষার রিজাল্ট খারাপ হয়েছে, স্বামীর নির্যাতন, যৌতুক সমস্যা, স্বামীর অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, স্ত্রীর পরকিয়া ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য সাধারণত আত্মহত্যার প্রবণতাই বেশী। এ গুলো কোন সমস্যাই নয়? এই সমস্ত সমস্যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতিতে বিদ্যমান আছে। কিন্তু আমাদের মতো আত্মহত্যার হার খুবই কম। তারা জীবন থেকে না পালিয়ে কঠিণ জীবন সংগ্রামে লেগে যায়। কারণ তারা জীবনকে ভালবাসে। তাই জীবনকে নতুন করে সাজায়। পার্থিব রঙিণ স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যায়। সফলও হয় বটে।
ইসলামে আত্মহত্যা কবীরাহ গুনাহ। ইসলামী চিন্তাবিদগণ শিরকের পর আত্মহত্যাকে মারাত্মক গুনাহ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ আর নিজেকে হত্যা করো না। নিশ্চিত জানো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি মেহেরবান। যে ব্যক্তি জুলুম ও অন্যায় বাড়াবাড়ি করে এমনটি করবে তাকে আমি অবশ্যি আগুনে নিক্ষেপ করবো। আর আল্লাহর জন্য এটা কোন কঠিণ কাজ নয়।”(সুরা নিসা:২৯-৩০) আল্লাহ বলেন, “তোমরা নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।”(বাকারা: ১৯৫)
আল্লাহ রাউফৃম বিল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার প্রতি করুণাশীল। আল্লাহ আমাদের শুভাকাংখী। তিনি আমাদের ভালো চান। তিনি আমাদের এমন কাজ করতে নিষেধ করছেন যার মধ্যে আমাদের নিজেদের ধ্বংস নিহিত রয়েছে। মৃত্যুর কাজটি আল্লাহর অধিকার। অতএব, কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেয় সে মুলত: আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”(ইউনুস:৫৬) তাই নিজে নিজে জীবন হরণ করা আল্লাহ পছন্দ করেন না। এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ তা’আলা বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং পরিণামের ভয়াবহতা, কঠোর যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির কথাও বলেছেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এই কাজটি থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি মানুষকে সতর্ক করেছেন। সাবেত বিন যাহ্হাক রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, তিনি গাছের নীচে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাই’আত করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“ যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের উপর মিথ্যা কসম করে, সে সেই দলেরই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন বস্তু দ্বারা আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন উক্ত বস্তু দ্বারা তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে। যে ব্যক্তি এমন বস্তুর মানৎ করে যার মালিক সে নয়, এরূপ মানৎ কার্যকরী নয়।”(মুসলিম: ২০২, হাদীস একাডেমী, কিতাবুল ঈমান, বাবু গিলাজি তাহরিমি কাতলিল ইনসানি………,বুখারী: ১৩৬৩,৪১৭১, ৪৮৪৩, ৬০৪৭, ৬১০৫, ৬৬৫২, ই.ফা: ২০৩, ই.সে: ২১০)
আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে সে অস্ত্র দ্বারা সে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে, এভাবে তথায় সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্নহত্যা করবে সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অবস্থান করে উক্ত বিষপান করতে থাকবে, এভাবে তথায় সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি নিজে পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি সর্বদা পাহাড় থেকে নীচে গড়িয়ে জাহান্নামের আগুনে পড়তে থাকবে এভাবে সে ব্যক্তি তথায় চিরকাল অবস্থান করবে।”(মুসলিম:২০০, হাদীস একাডেমী, কিতাবুল ঈমান, বাবু গিলাজি তাহরিমি কাতলিল ইনসানি………,বুখারী: ১৩৬৫, ৫৭৭৮, ই.ফা: ২০১, ই.সে: ২০৮)
হাসান বসরী রহ: বলেন, জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রা: বসরার এক মসজিদে আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেন। সে দিন হতে আমরা না হাদীস ভুলেছি না আশংকা করেছি যে, জুনদুব রা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মিথ্যারোপ করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আঘাত পেয়েছিল, তাতে কাতর হয়ে পড়েছিল। অতপর সে একখান চাকু দিয়ে হাতটি কেটে ফেলল। ফলে রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।”(বুখারী: ৩৪৬৩, তাওহীদ পাব. ই.ফা ৩২০৫, আ.প্র. ৩২১৪, কিতাবু আহাদিসুল আন্বিয়া, বাবু মা যুকিরা আন……)
আত্মহত্যা তো দুরের কথা কোন বিপদে পড়ে বা জীবন কাতর হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করাও ইসলাম নিষেধ করেছে। আনাস রা: থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন কোন বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেন বলে, ‘হে আল্লাহ আমাকে সে অবধি জীবিত রাখ, যতক্ষণ আমার জীবনটা আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়।”(বুখারী: ৫৬৭১,কিতাবুল মারধা, বাবু তামান্নাল মারিধ…, ই.ফা:৫১৫৬, আ:প্র: ৫২৬০)
সুতরাং আত্মহত্যা করবেন না। জীবনের প্রতি যদি কখনো বিতৃষ্ণাভাব এসেই যায়, তখন বেশী করে আল্লাহর যিক্র করুন এবং ইবাদাতের প্রতি বেশী মনযোগ নিবদ্ধ করুন। হতাশা, মনোকষ্ট, দু:খ-বেদনা আল্লাহ মুছে দিবেন। জীবনের স্বার্থকতা খুঁেজ পাবেন। ইনশা’আল্লাহ।
লেখক : জাফর আহমাদ, ম্যানেজার, আইবিএিল, জিন্দাবাজার শাখা সিলেট।