সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামে আরেকটি ধাক্কা

Published: 2 October 2021

।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।।

মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের লোকদের জীবনসংগ্রাম এখন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্দিষ্ট আয় দিয়ে তাদের নানা চাহিদা মেটাতে হয়। এ ধরনের মানুষের সাধারণ প্রবণতা হলো নগদ সঞ্চয়। সেটা তারা ব্যাংকে রাখে, যদি সুদের হার ভালো হয়। কিন্তু তাদের কাছে সঞ্চয়ের বড় মাধ্যম হলো সরকারের ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট বা সঞ্চয়পত্র। সীমিত আয়ের লোকদের পক্ষে গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট কেনা কঠিন। তাই সঞ্চয়কে কেন্দ্র করেই আরেকটু ভালো চলা কিংবা স্বপ্নপূরণের চেষ্টা থাকে তাদের। আবার এই শ্রেণির অনেক মানুষ আছে, যারা তাদের সম্পদ সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না। তাই ক্যাশ বা নগদ অর্থের সঞ্চয়ই তাদের প্রধান অ্যাসেট বা সম্পদ। এই প্রক্রিয়াটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ।

সাম্প্রতিককালে সঞ্চয়পত্র কেনার হার বেড়েছে। ব্যাংকের চেয়ে সুদের হার বেশি হলে এবং অন্যান্য সঞ্চয় স্কিম থেকে ভালো সুযোগ-সুবিধা পেলে সঞ্চয়পত্র কেনায় আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা সীমিত আয়ের লোকদের আয়ের একটা উৎস। কারণ ব্যাংকের ৬ শতাংশ সুদ দেওয়ার কথা, কিন্তু সঞ্চয়পত্রে পাওয়া যেত ১১ শতাংশের বেশি। সরকার সম্প্রতি এই সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে ১৫ লাখ টাকার ওপরে কেনা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে। অথচ ১৫ লাখ টাকা এই মুহূর্তে তেমন কিছু নয়। ৩০ লাখ টাকার ওপরে সুদের হার আরেক ধাপ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই টাকাও বেশি কিছু নয়। যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারের খরচ এখন বাড়ছে, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় এক শ্রেণির মানুষ এর অপব্যবহার করছে এবং বেশি আয়ের লোকজন কিনছে। এই তিনটা যুক্তির কোনোটাই আমাদের কাছে জোরালো মনে হয়নি। কোনোটাই অর্থনৈতিক দিক থেকে ঠিক নয়। আমি বলব, সামাজিক যৌক্তিকতা, মানুষের প্রতি সরকারের যে দায়িত্ব, তার সঙ্গে এটা যায় না।

সরকারের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তাদের ভাষ্য, তারা সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর নির্ভর করত এবং এটা মোটামুটি নিরাপদ আয়। এখন আয়টা কমে যাবে। বিশেষ করে কভিডের সময় যখন এর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে, তখন আয় কমে যাওয়া হতাশাজনক।

সরকারের সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাবগুলো বিবেচনা করতে হবে। প্রথমত, সঞ্চয়পত্র থেকে আয় কমে যাওয়ায় নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের কষ্ট বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, সঞ্চয় নিরুৎসাহ হবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমাদের জাতীয় সঞ্চয় হার জিডিপির ৩০-৩১ শতাংশের মতো। আমাদের বিনিয়োগের হারও ৩০ শতাংশের মতো। সুতরাং জাতীয় সঞ্চয় যদি বাড়ে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়বে, বিনিয়োগও বাড়বে। আমাদের বিনিয়োগ ন্যূনতম ৩৪-৩৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আমরা যদি বড় উন্নয়নকাজ করতে চাই, তাহলে সঞ্চয়টা কাজে লাগবে। এই তুলনায় সরকারের সুদ পরিশোধ বাবদ খরচ বাড়ার বিষয়টি বিরাট কিছু নয়। এমনিতে সরকারের বহু প্রকল্প আছে, নানা রকম খরচ আছে, সেসব দিকে কোনো খেয়াল নেই। অনেক লোককে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি পাওয়ার প্লান্টসহ অনেক স্থানে বিরাট বিরাট প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সব প্রজেক্ট থেকে ঠিকঠাক রিটার্ন কি আসে?

আরেকটা জিনিস দেখতে হবে। বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাভারেজ কম। এ ক্ষেত্রে মাত্র জিডিপির ২ শতাংশ খরচ হয়। এর মধ্যে সরকারি চাকুরেদের পেনশন আছে। তবে যাঁরা বেসরকারি খাতে কাজ করেন, যাঁরা শ্রমিক-কর্মচারী, তাঁদের কোনো পেনশন নেই, তাঁদের অবসরে যাওয়ার পর কিংবা কাজে থাকলেও তাঁদের কাছে যে সঞ্চয়টুকু আছে, তার বাইরে তাঁদের কাছে কিছুই থাকে না। তাই সঞ্চয়পত্রকে আমি বলি এক অর্থে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীরই একটা অংশ। এটাকে কমিয়ে দেওয়া, নিরুৎসাহ করা বা বন্ধ করা মানে সামাজিক নিরাপত্তা কমিয়ে আনা। এমনিতে সার্বিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে ১৪০টা প্রকল্প আছে এবং ২২টি সরকারি সংস্থা কাজ করে। এর মধ্যে বেশির ভাগ সুবিধা যায় সচ্ছল লোকদের কাছে, স্থানীয় প্রভাবশালী লোকদের মাধ্যমে এই খরচটা হয়। সঞ্চয়পত্রের সুবিধা হচ্ছে সীমিত আয়ের লোকদের কাছে এটা একটা ভালো মাধ্যম।

আরেকটা জিনিস লক্ষণীয়, সরকারের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ঋণ আছে, তা এখনো জিডিপির ৩২ বা ৩১ শতাংশের বেশি নয়। ভারতে এটা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি, এমনকি সিঙ্গাপুরের মতো একটা দেশে শতভাগের বেশি, অনেক উন্নত দেশেও এটা ১০০ শতাংশের মতো। ওরা তো এ রকমভাবে ঋণ নিয়ে দেশ চালাচ্ছে। তারা কিভাবে চালাচ্ছে বা খরচ বহন করছে? মোদ্দা কথা, ঋণ ব্যবহার ভালো হলে, দুর্নীতি না হলে, অপচয় না হলে ঋণের বোঝাটা বেশি মনে হবে না। কারণ লোকজন ও দেশের অর্থনীতি এসব প্রকল্প থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়। আবার সাধারণ মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের খরচগুলো বহন করে, সেটা ট্যাক্স, ভ্যাট বা অন্যান্য উপায়ে। সুতরাং তাদের বঞ্চিত করা অর্থনৈতিকভাবেও যুক্তিযুক্ত নয়। শুধু একটা গাণিতিক হিসাব দিয়ে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা মোটেও ঠিক নয়।

সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হলে আরেকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেটা হচ্ছে আইনবহির্ভূত ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক লেনদেনে মানুষ ঝুঁকতে পারে। তারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় টাকা জমা রাখতে পারে। দেখা গেল, তারা কিছুদিন বেশি সুদ পাচ্ছে, পরে আর পাবে না। কেউ কেউ একেবারেই পাবে না। যেমনটা আমরা সম্প্রতি ই-কমার্সে ঘটতে দেখেছি। এর আগে যুবক বা ডেসটিনির ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেছে। অনেকে বিকল্প হিসেবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা বলছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ফিন্যানশিয়াল লিটারেসির যে দৈন্য, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করাটা তাদের অনেকের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তাদের পক্ষে নিত্যদিন শেয়ারবাজার মনিটর করা সম্ভব নয়। আমাদের শেয়ারবাজারে কারসাজি করে দাম বাড়ানোর ঘটনাও ঘটে। দেখা যাচ্ছে, কোনো কম্পানি লোকসানে আছে, কোনো প্রডাক্ট নেই; কিন্তু শেয়ারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ওই সব শেয়ার কিনে ওই সব লোকের পথে বসার আশঙ্কা থাকে। এ যেন জোর করে সাধারণ মানুষকে শেয়ারবাজারে ঠেলে দিয়ে তাদের ঝুঁকিতে ফেলা।

আরেকটা বিষয় হলো দেশে আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। মনে রাখা দরকার, আমাদের শুধু প্রবৃদ্ধি দিয়ে চলবে না। এর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ লোকদের বহু চাহিদা ও জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হবে। সেটা হচ্ছে না। তাই দিন দিন বৈষম্যমূলক সমাজ গড়ে উঠছে। এটা মোকাবেলা করতে হলে ভারসাম্য রক্ষা প্রকল্প ও কাউন্টার ব্যালান্স দরকার হয়। সঞ্চয়পত্রের সুদ কমিয়ে কাউন্টার ব্যালান্সের আওতায় একটি কল্যাণকামী ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো।

অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন, সঞ্চয়পত্রের মতো ব্যবস্থা বাজারব্যবস্থার ক্ষতি করে, ব্যাংকের সঞ্চয় কমে যায়। কিন্তু দেখা গেছে যে ন্যাশনাল সেভিং সার্ভিস বাড়লে কোনো দিনই ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের পরিমাণ কমে না। এর সঙ্গে ব্যাংক ডিপোজিটের সম্পর্ক নেই। এখনো ব্যাংক ডিপোজিটের পরিমাণ অনেক। সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণও অনেক। অতএব এটা পরস্পরবিরোধী নয়। ব্যাংকাররা ৫ শতাংশ, ৬ শতাংশ সুদ দেবে। তাহলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ব্যাংকের আমানত বাড়াবেন? এটা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আমার মনে হয় সিদ্ধান্তটি সরকারের পুনর্বিবেচনা করা দরকার। শুধু আর্থিক যুক্তি দিয়ে এটাকে নিরুৎসাহ করা যায় না। দরকার হলে এ জন্য সরকারকে কিছু বাড়তি খরচ বহন করতে হবে। সরকার অনেক কল্যাণকামী কাজে অর্থ ব্যয় করে থাকে। এটাকে সেভাবেই দেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে সরকার যেটা করতে পারে, নজরদারি করা। যাঁরা বেশি অর্থের মালিক বা যাঁরা বিভিন্ন রকম কারসাজি করে সঞ্চয়পত্র কিনছেন, সেটা যেন না হয়। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে অবহেলিত ও প্রান্তিক জনসাধারণের জন্য সরকারকে নানা রকম কার্যক্রম নেওয়া অত্যাবশ্যকীয়। সেই দিক থেকেও সঞ্চয়পত্রের সুদ কমালে ঠিক হবে না। আরেকটা বিষয় হলো, সব কিছু বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া, সব কিছু ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া এবং আশা করা যে ব্যক্তি খাত নিঃস্বার্থভাবে সাধারণ মানুষকে সুযোগ-সুবিধা দেবে—এমনটা আশা করা ঠিক নয়। সব ক্ষেত্রে কাউন্টার ব্যালান্স, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স থাকতে হয়। পৃথিবীর সব দেশে সরকারি খাত যখন শক্তিশালী হয়, দক্ষ হয় এবং সেবা প্রদানে সাশ্রয়ী হয়, তখন বেসরকারি খাতও শক্তিশালী, দক্ষ ও সৎ হতে বাধ্য হয়। না হলে লোকজনের কষ্ট বাড়ে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন : আফছার আহমেদ