কাদের নিয়ে হবে জাতীয় ঐক্য

Published: 12 February 2022

।।মো. জাকির হোসেন।।

‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল’—এই কথা প্রথম কে বলেছিলেন এ বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হলো গ্রিক উপকথার কিংবদন্তি লেখক ঈশপ তাঁর ‘দ্য ফোর অক্সেন অ্যান্ড দ্য লায়ন’ গল্পে প্রথম এই কথা উল্লেখ করেন। গল্পটা হচ্ছে, এক বনে চারটি ষাঁড় বাস করত। চারটিরই পরস্পরের মধ্যে ছিল খুব ভাব। তারা সব সময় একসঙ্গে থাকত, একসঙ্গে মাঠে চরে বেড়াত, গল্প করত, সুখে-দুঃখে সমব্যথীও হতো।

সেই বনে এক সিংহও বাস করত। সিংহটির ইচ্ছা হলো ওদের ঘাড় মটকে মাংস খায়, কিন্তু সে সুযোগ পাচ্ছিল না। সিংহ জানত এই চারটি যতক্ষণ একত্র থাকবে ততক্ষণ সে এদের ঘাড় মটকাতে পারবে না। কারণ ওই চারটি ষাঁড় ছিল এতই বলবান যে একসঙ্গে থাকলে সিংহ ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই তার ইচ্ছাও পূরণ হচ্ছিল না। সিংহ তখন মনে মনে ভাবল, যদি ওদের আলাদা আলাদা মাঠে চরার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ঘাড় মটকানো সহজ হবে। এই ভেবে সিংহটি বেশ কায়দা করে ওদের মধ্যে এমন ঝগড়া বাধিয়ে দিল যে ওদের পরস্পরের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। ফলে ওরা দূরে আলাদা আলাদা মাঠে চরতে শুরু করল। এত দিন অপেক্ষা করার পর এবার সিংহের সুযোগ এসে গেল। সে তখন একে একে ষাঁড়গুলো বধ করে সাধ মিটিয়ে মাংস খেল। ঈশপ গল্পের শেষে লিখলেন, ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল। ’ মানে একতাই বল, বিভক্তিতে পতন।
বাংলাদেশে আমরা প্রায়ই জাতীয় ঐক্যের আহ্বান শুনি। অতি সম্প্রতি জাতীয় সংসদের ১৬তম অধিবেশনে জাতীয় পার্টির গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী রাজনৈতিক ঐক্য তথা জাতীয় ঐক্যের পক্ষে আবেগঘন জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। সংসদ সদস্যের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার সবখানেই আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ওপর জোর দিয়ে বক্তৃতায় তিনি অন্তত ৯ বার জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, ‘বৈদেশিক নীতি গ্রহণে সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরিণতি সবাই জানে। এখন যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে গার্মেন্ট ব্যবসার কী হবে। সৌদি আরব যদি নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে রেমিট্যান্সের কী হবে। যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা দিলে গোটা অর্থনীতি কোন পথে যাবে? তখন বাংলাদেশ তো উলানবাটরের মতো হয়ে যাবে। এখনই উচিত জাপানের সঙ্গে আলোচনা করা, ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের অনেক দিনের বন্ধু। তাদের সঙ্গে আলোচনা করা। এটা করতে হলে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলতে গেলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সরকারি দলের এখানে মুখ্য দায়িত্ব। পাশাপাশি বিরোধী দলের দায়িত্ব রয়েছে। দেশের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ’

একটি রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের জাতীয় ঐক্য কিভাবে কোন পথে হবে? এর রূপরেখা কী হবে? একটি রাষ্ট্রের তথা জাতির ঐক্যের ক্ষেত্রেও কিছু মৌলিক নীতিমালা আছে, যার সঙ্গে কোনোভাবেই সমঝোতা বা আপস করা যায় না। বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন নজিরবিহীন ত্যাগের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ইতিহাস, ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই দলের মধ্যে ব্যবধান এতটাই প্রবল যে একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হলে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে পারে না। ঐকমত্যের ভিত্তি তাহলে কী হবে?

আরো খোলাসা করে বলি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা-স্থপতি-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদানকে পুরোপুরি অস্বীকার করে বিএনপি। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি কিংবা জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে না তারা। ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলন করে ঐক্যফ্রন্ট তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বিষয়ে একটি লিখিত বিবৃতি দেয়। ঐক্যফ্রন্টের বিবৃতিটি পাঠ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিবৃতির প্রথম বাক্যটি ছিল এ রকম ‘একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে। ’ কিন্তু বিবৃতিটি পাঠ করার সময় বঙ্গবন্ধুর নাম এড়িয়ে যান বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিবৃতি পাঠ করার সময় প্রথম বাক্যের কিছু অংশ পড়ার পর বঙ্গবন্ধুর নাম থাকায় মির্জা ফখরুল ইসলাম ইচ্ছাকৃতভাবেই তা বাদ দিয়ে পরের অংশ থেকে পড়া শুরু করেন। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখতে ও শুনতে পাওয়া যায় মির্জা ফখরুল ‘একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণ’ এটুকু পাঠ করার পর বঙ্গবন্ধুর নাম দেখে একটু থমকে যান এবং বঙ্গবন্ধুর নাম এড়িয়ে বাক্যের পরের অংশ পাঠ করেন। ফলে প্রথম বাক্যটি এ রকম দাঁড়ায় ‘একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণ নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে। ’

বিএনপি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা স্বীকার করা দূরে থাক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর কোনো অবদানকেই স্বীকার করতে চায় না। এদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের আর দশজন সাধারণ নাগরিকের চেয়ে বেশি কিছু নন। এদের মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শেখ মুজিব মাত্র। বিএনপি বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয় না। এরা বঙ্গবন্ধুর অবদানের সরাসরি বিরোধিতা করে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা ঘটনার বিকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করে। জাতীয় ঐক্য কি তাহলে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে হবে? এটি কি সম্ভব? বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে যে রাজনীতি তা কি বাংলাদেশের পক্ষের রাজনীতি হতে পারে? ঐক্যের প্রয়োজনে বিএনপি হয়তো বঙ্গবন্ধুকে মেনে নেবে; কিন্তু দাবি তুলবে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে হবে।

আর এমন হলে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধান তথা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’কে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কেননা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত মুজিবনগর সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে শুধু বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অইনানুগ ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, অন্য কারো ঘোষণা বা ঘোষণা পাঠ অনুমোদিত হয়নি। ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণিত আছে—‘যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতিবহির্ভূত ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। ’

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান নিম্নরূপে অনুমোদন করেছে—‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি; এবং এর দ্বারা পূর্বাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি। ’

মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধানের পথ ধরেই আমাদের বর্তমান সংবিধান রচিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কোনো সংযোজন-বিয়োজন বর্তমান সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অস্বীকার করার অর্থ মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশকে অস্বীকার করা নয় কি?

জাতীয় ঐক্যের খাতিরে না হয় এই প্রশ্ন না তুললাম—কে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে সংযোজন করেছিল? কারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের লালন-পালন করেছে? কারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকেছিল? কারা বারবার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে বাধা সৃষ্টি করেছে? কিন্তু ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্তদের বিষয়ে কী হবে? অপরাধীদের সঙ্গেই কি ঐক্য হবে? ঐক্যের প্রয়োজনে অপরাধীদের কি মুক্ত করে দেওয়া হবে? অপরাধীরা কি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন, না সরকার নিজ উদ্যোগে মুক্ত করে দেবে?

সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানালেও ঐক্যের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ আমরা চাচ্ছি না। আমাদের রাষ্ট্রীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে ঐকমত্যের ডাকে সবাই সাড়া দেবে না, এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা। ’ তাহলে কাকে নিয়ে, আর কাকে বাদ দিয়ে ঐক্য হবে? বিদ্যমান বাস্তবতায় জাতীয় ঐক্য কিভাবে, কোন পথে হবে?

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়