বৈশাখে শুদ্ধ সংস্কৃতির প্রত্যর্পণ প্রত্যাশা

Published: 14 April 2022

এ কে এম শাহনাওয়াজ

জীবন্তসংস্কৃতি চারপাশের নানা ধারার সংস্কৃতিকে আত্মস্থের মাধ্যমে নিজেকে আরো বিকশিত ও বেগবান করে। দুর্বল সংস্কৃতি সবলের ভেতর নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। বাঙালি সংস্কৃতির দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে।

এই সংস্কৃতি প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয় তার সাহিত্য। আর সাহিত্যের বাহন তো ভাষা। বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। এই ঐতিহ্যই দীর্ঘকাল শক্তিমান রেখেছে বাঙালিকে। এ কারণে যুগ যুগ ধরে আগ্রাসী আধিপত্যবাদীরা বাংলা ভাষার শক্তিকে ভয়ের চোখে দেখেছে। বুঝেছে বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক শক্তির প্রণোদনা প্রজন্ম বহন করলে তাদের আর পরাভূত করা যাবে না। এ কারণে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বারবার আঘাত এসেছে।

প্রাচীন বাংলার কালপর্ব থেকে অদ্যাবধি বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার প্রতি আঘাত এসেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা কৌশলেই আঘাত এসেছে। এটি অব্যাহত ষড়যন্ত্রের অংশ। উদ্দেশ্য প্রায় অভিন্ন। উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক বাংলা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ঐতিহ্য ধারণ ও লালন করে আত্মচৈতন্যে ফিরে আসে। স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়। অমন সতেজ জাতিকে বিভ্রান্ত করে কোনো পক্ষের লোভী উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই যুগ যুগ ধরে আগ্রাসী শক্তি বাঙালি প্রজন্মকে ঐতিহ্য ভোলাতে চেয়েছে। ঐতিহ্যের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রধান বাহন ভাষা। তাই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত এসেছে বারবার। এখনো তা অব্যাহত আছে। আজ বাঙালির নববর্ষের প্রাক্কালে খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে এই ভাবনাগুলো পর্যালোচনা করা। যুগ যুগ ধরে বাঙালি পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে এলেও অধুনা একই ষড়যন্ত্রের অংশীদার ধর্মান্ধগোষ্ঠী নববর্ষ পালনের বিরোধিতা করে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ছড়িয়ে অন্ধকার আহ্বান করছে।

প্রাচীন বাংলায় পাল শাসনামলে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের কাছ থেকে বাংলা সাহিত্যের ভ্রূণশিশু চর্যাপদের জন্ম ও বিকাশ ঘটেছিল। আমাদের ইতিহাসচর্চার সীমাবদ্ধতা অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার ধারাবাহিকতা অনুধাবন করতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বেশ কিছুদিন আগে কোনো এক চ্যানেলে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপক পাল রাজাদের অবাঙালি বলেছিলেন। মিডিয়ায় কোনো সিদ্ধান্তমূলক জরুরি কথা বলতে হয় দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। কারণ একই সঙ্গে মিডিয়ায় প্রচারিত বক্তব্য অসংখ্য দর্শককে তথ্যসমৃদ্ধ করতে পারে আবার ভ্রান্তির মধ্যেও ফেলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তাই। আমরা মনে করি, বাঙালি সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ বুঝতে হলে পাল শাসকদের পরিচয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। একসময় তথ্যসূত্রের সংকটের কারণে পালদের অবাঙালি বহিরাগত মনে করা হতো। পরে পাল রাজা রামপালের জীবনী লিখতে গিয়ে সংস্কৃত কবি সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ‘রাম চরিতম’ গ্রন্থে প্রতিষ্ঠাতার পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন ‘গোপাল জনকভূ বরেন্দ্র’। অর্থাৎ গোপালের পিতৃভূমি বরেন্দ্রে। বরেন্দ্রে বাড়ি হলে তাঁরা তো বাঙালিই বটে।

অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পাল রাজাদের। তাই বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে কোনো বাধা ছিল না এই পর্বে। এ সময়ে গড়া ভাস্কর্য, বিশেষ করে পোড়ামাটির অলংকরণশিল্পে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। চর্যাপদ চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেক দূর এগোতে পারত, যদি না এগারো শতকের মাঝামাঝি পালদের পতন ঘটিয়ে দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ সেন বংশীয় রাজারা বাংলার ক্ষমতা দখল না করতেন। বাঙালির স্বাজাত্যবোধ ও লড়াকু ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা ছিল সেনদের। নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের বাস্তবতা সেন রাজাদেরই ভীত করে তুলেছিল। ভেবেছিলেন ঐতিহ্যের প্রণোদনায় সপ্রতিভ বাঙালি হয়তো তাঁদের মেনে নেবে না, প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এ কারণে বাঙালিকে স্তব্ধ করার পরিকল্পনা নেন সেন রাজারা। তাঁরা সমাজকে চতুর্বর্ণে বিভাজন করে ঐতিহ্যে সচেতন বড়সংখ্যক বাঙালিকে শূদ্র অভিধায় অভিহিত করে কোণঠাসা করে ফেলতে চান। বাঙালি প্রজন্ম যাতে ঐতিহ্যের কাছে ফিরে শক্তি সঞ্চয় করতে না পারে তাই নানা অনুশাসন দিয়ে বাংলা ভাষা চর্চা নিষিদ্ধ করে দেন। শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত করেন শূদ্র বাঙালিকে।

তেরো শতকের শুরুতে তুর্কি মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের পথে বড় রকমের অন্তরায় তৈরি হতো, তা বলাই বাহুল্য। বাঙালির সৌভাগ্য, বহিরাগত অবাঙালি মুসলিম শাসকরা মধ্যযুগের প্রায় ৬০০ বছর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বাঙালির ঐতিহ্য চেতনাকে দৃঢ় করেছিলেন। বাঙালির সৌভাগ্য, ঔপনিবেশিক শাসকরা তাঁদের শাসন-দর্শনের কারণে বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেননি। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দ্বিতীয়বার বড় আঘাত আসে পাকিস্তানি শাসনামলের শুরুতে। সেন শাসকদের মতো অভিন্ন মানসিকতা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। বাঙালির ওপর শোষণপ্রক্রিয়া চালানোর পরিকল্পনার পথে হাঁটতে গিয়ে তারা প্রথমেই অনুভব করেছিল বাঙালির উজ্জ্বল ঐতিহ্যের শক্তি। ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা ও স্বরূপ ছড়িয়ে আছে সাহিত্য ও ইতিহাসে। সাহিত্যের বাহন ভাষা। তাই বাঙালি প্রজন্মকে ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন করার জন্য পাকিস্তানি শাসকচক্র হামলে পড়ে বাংলা ভাষার ওপর। এই ষড়যন্ত্রকে বাঙালি তরুণরা রুখে দিয়েছিলেন রক্তমূল্যে। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা মর্যাদা পায়নি পাকিস্তানি শাসকদের কাছে। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে টার্গেট করেন আইয়ুব খান। জাতীয় প্রচারমাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীত প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই ষড়যন্ত্র দৃষ্টি এড়ায়নি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের। প্রতিবাদে তাঁরা ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’। ছায়ানট সিদ্ধান্ত নেয় প্রতি নববর্ষ পালনের সূচনা হবে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। নির্ধারিত হয় ‘এসো হে বৈশাখ…’। প্রথমে বলধা গার্ডেনে, পরে রমনার বটমূলে চলতে থাকে বাংলা নববর্ষের প্রভাতি উদ্বোধন। এটিই হচ্ছে বাঙালির মেধাবী প্রতিবাদ।

স্বাধীন বাংলাদেশে এসে আমরা হাঁফ ছেড়েছিলাম এই ভেবে যে অন্তত বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার মাঠ থেকে অপচ্ছায়া অপসৃত হলো। কয়েক বছর ভালোই কাটল। জমজমাট হতে থাকল পহেলা বৈশাখ উদযাপন। যুক্ত হলো মঙ্গল শোভাযাত্রার চমৎকার অনুষঙ্গ। বাঙালির এই সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য বিশ্বস্বীকৃতি পেল। কিন্তু সুবিধালোভী ধর্মান্ধরা চুপ করে বসে রইল না। বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়ার নানা পাঁয়তারা করতে থাকে। জঙ্গি হামলা হলো রমনার বটমূলে—যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। রক্ত ঝরল। কিন্তু অপশক্তির কাছে নতজানু হলো না বাঙালি। পরের বছর থেকে নববর্ষ পালনের তেজ আরো ব্যাপকতা পেল। ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে।

এখনো বৈশাখ এলে কোনো কোনো মহল ধর্মান্ধ চিন্তা থেকে বিষবাষ্প ছড়াতে চায়। বাঙালির দীর্ঘদিনের লোকজ উৎসবের সৌন্দর্যকে ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে চায় সরলমতি বাঙালি মুসলমানকে। কিন্তু খুব সুবিধা যে তারা করতে পারবে না, তা বাঙালির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বলে দেয়। ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি সংস্কৃতি বিনাশী কোনো চেষ্টা, কোনো ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তবে তাদের হীন চেষ্টা বারবার স্পষ্ট করে যাচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির ঐশ্বর্য। এমন ঐতিহ্য যে জাতি বহন করে, আধিপত্যবাদীরা তাদের দেখে ভীত হবেই। কিন্তু ভয় হয় তখনই, কোনো অসতর্কতায় যাতে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক গরিমাকে না হারিয়ে ফেলি। এই আশঙ্কার কারণ আছে।

১৫-১৬ বছর আগে জয়দেবপুরের (গাজীপুর) সাংস্কৃতিক সংগঠন সুনজরের আমন্ত্রণে তাদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমি খুব চমত্কৃত হয়েছিলাম শিশু-কিশোর শিল্পীদের দেখে। চমৎকার ধ্রুপদি সংগীত, নাচ, আবৃত্তি দিয়ে আমোদিত করেছিল অনুষ্ঠান। এই ভালো লাগা থেকে তাদের অনেক অনুষ্ঠানে গিয়েছি আমি। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির এই চর্চা আমাকে নিশ্চিত করেছিল এই শক্তি ভেদ করে কোনো অপশক্তি দাঁড়াতে পারবে না।

বছর তিনেক আগে আমন্ত্রিত হয়ে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনী উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান কাজ ঐতিহ্য অনুসন্ধান করা। এই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার উচ্চ ধারণা রয়েছে। তারা শিক্ষা গবেষণায় বেশ এগিয়ে আছে। কিন্তু কষ্ট পেলাম তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে। পুরো আয়োজনে বিপন্ন হলো বাঙালি সংস্কৃতি। সারাক্ষণই হিন্দি নাচ-গানের উৎকট উপস্থাপনা। কান ঝালাপালা করা আধুনিক মিউজিক। অনুষ্ঠানটির আয়োজনে শিক্ষার্থীরা যে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেন পথভ্রান্তিতে পেয়ে বসেছে তাদের। দীর্ঘ অনুষ্ঠানে একটি আবৃত্তি নেই। একটি রবীন্দ্রসংগীত বা ধ্রুপদি গান নেই। ভরতনাট্যম, মণিপুরি বা লোকজ কোনো নাচ অনুপস্থিত। বিভাগটির একাডেমিক চেতনার প্রতিফলন আয়োজনে দেখা গেল না।

এতে হয়তো অনেকেই দোষের কিছু খুঁজে পাবেন না, কিন্তু আমার আশঙ্কা অন্য জায়গায়। এর পেছনে কি সুদূরপ্রসারী কোনো ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা কাজ করছে? বাঙালিকে হীনবল করার জন্য তার আবহমানকালের সংস্কৃতিকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রজন্মের কাছ থেকে! যেমন করে সেন রাজারা করেছিলেন, পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান করেছিলেন! কিসের মোহে তবে এই লড়াকু তারুণ্য তার উর্বর সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যকে নির্বাসন দিতে চাইছে।

এই ঘোর থেকে আমাদের বেরোতে হবে। আমরা শঙ্কিত নই। বৈশাখ প্রতিবছর যে তেজ নিয়ে বাঙালির জীবনে ফিরে আসে, এরই তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নেবে প্রজন্মের বিভ্রান্তি আর বৈকল্য। দীর্ঘ উজ্জ্বল সংস্কৃতি চর্চা করা বাঙালির ঐতিহ্যিক শক্তি থেকেই তারুণ্য পথ খুঁজে পাবে। শুধু মনে রাখতে হবে যে ঐতিহ্যের শক্তিতে শক্তিমান একটি জাতিকে হীনবল করে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রীরা প্রথম আঘাত হানে তার সংস্কৃতির মেরুদণ্ডে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়