সুনামগঞ্জের হাওরে বসেই কাঁদছেন কৃষকরা

Published: 25 April 2022

বিশেষ সংবাদদাতা :


সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বড় ছায়ার হাওরের মাউতির বাঁধ ভেঙে রোববার সকাল থেকে পানি ঢুকতে থাকে। দেখতে দেখতে ডুবে যায় হাওরে থাকা সব জমির পাকা ধান। একই সঙ্গে কেটে রাখা ধানের বোঝা ও খড়কুটোও ডুবে যায়। তাই ফসল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন হাজারো কৃষক। তাদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে পুরো হাওর।

এদিকে জেলা প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে হাওরের ধান কাটা ৯০ ভাগ শেষ। কিন্তু কৃষকরা বলেছেন, ধান কাটা ৬০-৭০ ভাগ শেষ হয়েছে। তবে অনেক কাটা ধান জমিতেই রয়ে গেছে।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শাল্লার মাউতির বাঁধ (৮১ নম্বর পিআইসি) ভেঙে হাওরে পানি প্রবেশ শুরু হতে থাকলে কৃষকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। কৃষকরা কাটা ধান, নাকি জমির পাকা ধান, না খড় তুলে আনবেন এ নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কেউ কেউ কাটা ধানের স্তূপের পাশে বসে কাঁদতে থাকেন।

ভাঙা বাঁধের পাশে কাটা ধানের স্তূপের কাছে বসে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন আভা রানী দাস। স্বামী কানন দাসের মাথায় ধানের বোঝা তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘তারা খালি নিজের চিন্তা করে, বাঁধে লাখ লাখ টেকা দুর্নীতি করে। ২৫ কেয়ার (আট একর) ধান করছিলাম। ৫ কেয়ার (আধ একরের কম) কাটছিলাম, অখন নিতাম পাররাম না, নিতে নিতে ইগুন নষ্ট অই যাইবো।’

তলিয়ে যাওয়া ফসলের চিন্তায় হাওরে বসেই কাঁদছেন হাজারো কৃষক

শুধু আভা রানী ও কানন দম্পতি নন, পাশেই পানির নিচে থাকা ধান কাটছিলেন আফাজ মিয়া, সিরাজ উদ্দিন, মনির মিয়াসহ হাজারো কৃষক। ফসল হারানোর ভয়ে তারাও কাঁদছেন আর বললেন, এ বাঁধ ভাঙতে পারে না, তদারকি ও অবহেলায় বাঁধটি ভেঙে আমাদের সর্বনাশ হয়েছে।

কৃষক সুমির তালুকদার বলেন, ‘তদারকির অভাবে বাঁধ ভেঙেছে। এখন আমরা কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে গেছি।’

তলিয়ে যাওয়া ফসলের চিন্তায় হাওরে বসেই কাঁদছেন হাজারো কৃষক

কৃষক রহিম মিয়া বলেন, ‘হাওরের সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে এখন ছেলে মেয়েকে কি খাওয়াবো।’

কৃষক জামাল মিয়া বলেন, যারা বাঁধের কাজে গাফলতি করেছে তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।

তলিয়ে যাওয়া ফসলের চিন্তায় হাওরে বসেই কাঁদছেন হাজারো কৃষক

বাঁধে দাঁড়ানো আঙ্গাউড়ার হিমেল সরকার বলেন, ভোর সাড়ে ৫টায় মোটরসাইকেলে যাত্রী নিয়ে খালিয়াজুরীর কৃষ্ণপুরে যাচ্ছিলাম। বাঁধের নিচে বুরুঙ্গা দিয়ে পানি যাচ্ছে দেখে হাওরে থাকা কয়েকজন কৃষককে জানাই। কৃষকরা বাঁশ বস্তা ছাড়াই খড় দিয়ে একঘণ্টা পানি ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এরমধ্যেই বাঁধ ভেঙে যায়। পরে সকাল ৭ টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে কিছুই করতে পারেননি।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের শাল্লার সভাপতি তরুন কান্তি দাসও তদারকির অভাবে বাঁধ ভেঙেছে দাবি করে বললেন, হাওরে ৭০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে তবে ২০ ভাগ কাটা ধান ক্ষেতে আছে। ৪৮ ঘণ্টায় পুরো হাওর ডুবে যাবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) বাঁধের কাজে মনোযোগী ছিল না, কাজও ভালো হয়নি। একই মন্তব্য করেন শাল্লা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউতির বাঁধের পিআইসির সভাপতি কৃপেন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, আমি ভালো করে বাঁধের কাজ করেছি। পানির চাপে বাঁধ ভেঙে গেছে। আমি শনিবার রাতেও বাঁধে ছিলাম।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তালেব বলেন, পানির চাপ বেশি থাকায় বাঁধ রক্ষা করা যায়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী এসএম শহীদুল ইসলাম বলেন, সকালে দায়িত্বশীলদের বাঁধ ঠেকানোর কাজ করতে কোনো বাধা ছিল না। কেন করলেন না তারাই। ভালো বলতে পারবেন।

জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হাওরে ৯০ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধটি মেরামতের সবার্ত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে এবং বাঁধ নির্মাণে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি কোনো অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।