বাংলাদেশ ও ভারতের নদী সম্মেলন কেন গুরুত্বপূর্ণ

Published: 23 May 2022

।।জয়ন্ত ঘোষাল।।


অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী একদা বলেছিলেন, বাংলাদেশের নদীকে যে নিবিড়ভাবে জানতে পারে না, সে কিভাবে বাংলাদেশকে জানবে? বঙ্গোপসাগরের নরম বেলাভূমিতে মিলিত হয়েছে সমুদ্র ও নদী। নদী-নারী, সমুদ্র-পুরুষ, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল ঢেউয়ের দোলায় তাদের মিলন ঘটে। কোমল, পাললিক বঙ্গ তাদের শিশু (চলনবিল, কলকাতা ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ১৭-১৮)।

ঐতিহাসিক কাল থেকে সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনীতি আর বাংলাদেশের ভৌগোলিক গঠনে নদীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নদী বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু শুধু কি বাংলাদেশ? ভারতবর্ষের ইতিহাসের সঙ্গেও তো নদীর ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। নদীকে সম্বল করে পৃথিবীর ইতিহাসে কত সভ্যতা গড়ে উঠেছে। সেই ব্যাবিলন থেকে শুরু করে মেসোপটেমিয়া—সবই তো নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা। এত বছর পর বাংলাদেশের নদ-নদী, নদীতীরবর্তী জনপদ আর ভারতের নদ-নদী সবই কেমন এক গভীর সংকটের মুখে। আসলে আমাদের জীবনযাত্রা ও অস্তিত্ব অনেকটাই তো নদীর ওপর নির্ভরশীল। সুদূর অতীতকাল থেকে আজ অবধি দেশের ভৌগোলিক অবস্থানে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এই নদীকেন্দ্রিক সভ্যতাতেও এসেছে সীমাহীন নৈরাশ্য, বেদনা। অজস্র নদীর মিলনমেলার উৎসক্ষেত্ররূপে নদীমাতৃক দেশ পরিচিত থাকলেও এখন মাত্র কয়েকটা হাতছানি দিয়ে পূর্বপরিচয় বজায় রাখতে যেন দারুণ লজ্জা পাচ্ছে।

বাংলাদেশ মোটামুটিভাবে ছোট-বড়, স্থানীয়, আন্তর্জাতিক সক্রিয়, নিষ্ক্রিয় সর্বসাকুল্যে এখনো নিখুঁতভাবে যদি বর্ণনা করা হয়, গণনা করা হয়, প্রায় এক হাজার ৫০০ নদী পাওয়া যায়। আর সেই পটভূমিতে ভারত এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যখন ২৮ ও ২৯ মে আসামের গুয়াহাটিতে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ রিভার কনফারেন্স, যাকে বলা হচ্ছে রিভার কনক্লেভ, নদী-৩-এ যোগ দিতে চলেছেন। স্বাভাবিক কারণেই বিষয়টি আমাদের সবার বিশেষ নজর কাড়ে। আমরা নজর রাখি সেখানে কী হচ্ছে। সেখানে বোধ হয় মনে করিয়ে দেওয়াটা প্রয়োজন যে ভারত এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজধানীর বাইরে এই প্রথম একটা অন্য কোনো রাজ্যে হচ্ছে। আর সেখানে আরো বেশ কিছু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি থাকছেন। যাঁরা এই নদীমাতৃক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। আরো একটা কথা মনে করাই যে কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শংকর গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ বছর ভারতে আসার জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করা যায় এবং জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের বৈঠক নয়াদিল্লিতে হওয়ার কথা। তার নানা ধরনের ক্ষেত্র তৈরি হবে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে এই দুই দেশের মধ্যে নদী সমস্যা সমাধানে আলোচনা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি দেশের নদী সমস্যার মধ্যেও কিন্তু এসে যায় তিস্তা চুক্তির অসমাপ্ত কর্মসূচি। প্রশ্ন থাকে সেই তিস্তার বিষয়টা এই ধরনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং বহুপক্ষীয় মঞ্চে আলোচিত হবে কি না। যেখানে দুই দেশের বিরোধ আছে, সেটা হাটের মধ্যে আলোচনা না করে দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটাও সাংবাদিক হিসেবে জানতে পারছি যে তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আবার নতুন করে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটা আলাপ-আলোচনার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. মো. আবু হানিফ তাঁর লেখা ‘বাংলাদেশের নদ-নদী ও নদী তীরবর্তী জনপদ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের নদীগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে, নদীতীরবর্তী জনপদগুলোর উন্নয়নের কথা ভাবতে শুরু করেছে, তার কারণ বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতিগুলোর সংস্কার সাধনের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা তৈরি করেছে। অবিলম্বে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

এখানে সুন্দরবনের প্রসঙ্গ এসে যায়। কেননা পৃথিবীর বৃহত্তম গরান বনভূমি বাস্তব পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ৫১টি নদী রয়েছে। এই নদীগুলোর যৌথভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে সেগুলোর উন্নয়ন কঠিন। সেই কারণে বিদ্যমান নদীর প্রবাহ মাত্রা, প্রবাহিত গতিপথ, বন্যানিয়ন্ত্রণ পানি, সেচ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ব্যবস্থাদি প্রবাহিত পথে বাধাদান, ফলে গতিপথের পরিবর্তন নদীর ভাঙন ও তার ভয়াবহতা নিরূপণ যথেচ্ছভাবে নদ-নদীর পানি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ, নতুন ভূমি সৃষ্টি এবং তাদের মালিকানা বিপক্ষে মতামতের তোয়াক্কা না করে পানিপথের গতি পরিবর্তন এবং সেই সব নদীর দূষণ—সবই কিন্তু এই নদী কমিশনের আলোচনার বিষয়ে এসেছে। সম্মেলনেও আসবে, কিন্তু ড. মো. আবু হানিফ শেখ দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন সীমান্তবর্তী নদ-নদীগুলোর মধ্যে সুন্দরবনের উন্নতিও যুক্ত হয়ে আছে। আমরা সুন্দরবনের মধু উৎপাদন নিয়ে যখন আলোচনা করছি, উন্মুক্ত জলাশয় নিয়ে যখন আলোচনা করছি, তখন কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হয় যে ৩০ প্রজাতির সরীসৃপজাতীয় প্রাণী আছে। একটা জায়গার সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে কিন্তু সেই জায়গার নদ-নদীকে যত্ন করে রাখার দায়িত্বটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে আসে।

এবার বাংলাদেশের সিলেটে বন্যা বেশ ভয়াবহ হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও যথেষ্ট। আবার আসামের দিকে অর্থাৎ ভারতের দিকে, সেখানেও কিন্তু বাঁধভাঙা বন্যা দেখা দিয়েছে এবং দুদিকেই ক্ষয়ক্ষতি অনেক। সুতরাং এখনই এই দুই দেশেরই কর্তব্য অতীতের ঐতিহ্যের কথা মনে রেখে নদী সংস্কারের জন্য যৌথভাবে কিছু রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ ব্যাপারে অতীতে অনেক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়িত হতে সময় নিয়েছে। এখন যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক মধুর এবং ভারত মনে করে যে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে এই উপমহাদেশের আজকের চলতি পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেটা খুব জরুরি। আমি আমার অতীতের বহু লেখায় বারবার বলেছি যে আফগানিস্তানের ঘটনা, ইউক্রেনের যুদ্ধসহ বিভিন্ন ঘটনায় আজ ভারত এবং বাংলাদেশকে আরো কাছাকাছি এনে দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি একবার বলেছিলেন যে আমরা ইতিহাস বদলে দিতে পারি, কিন্তু প্রতিবেশী বদলাতে পারি না। ভারত এবং বাংলাদেশ দুই প্রতিবেশী। আমরা প্রতিবেশী বদলাতে চাই না। কিন্তু আমরা আমাদের এই নদীমাতৃক সভ্যতা, তার সংকট বদলে দিয়ে একটা নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারি।

বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমিগুলোর কথা মনে করুন; নওগাঁ, পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লা জেলার লালমাই, ময়নামতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের যেসব শহর গড়ে উঠেছে সেগুলো কোনো না কোনো নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নদী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তা উত্তরবঙ্গের প্রধান এবং বিশিষ্ট নদী। এখানকার জনজীবনে তিস্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, গল্পগাথা পুরাণে তিস্তা নদীকে নিয়ে কথা আছে। ড. অশোক বিশ্বাসের লেখা ‘বাংলাদেশের নদী’ গ্রন্থ থেকে আমি জানতে পারছি যে খুব সম্ভবত তিস্তা বর্মী শব্দ ‘দিস্তাং’ থেকে এসেছে। অনেকে বলেন, ‘ত্রিস্তা স্রোতা’ শব্দের অপভ্রংশ হলো তিস্তা। ত্রি স্রোতা বা তার থেকে তিস্তা। তিস্তা এখানে ত্রি স্রোতা করতোয়া, আত্রাই ও পুনর্ভবা নামে উত্তরবঙ্গের তিনটি বিখ্যাত নদীর কথা বলা হয়। ভুটান সীমান্ত ও উত্তর হিমালয় থেকে উৎসারিত হয়ে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি জেলার ভেতর দিয়ে করোতোয়া বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর উত্তরতম প্রবাহের নাম তিস্তা। ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে তিনটি দক্ষিণ-পূর্ব, মধ্যবর্তী এবং পশ্চিম অংশের নাম পুনর্ভবা। তিস্তার কিন্তু অনেক নাম—যেমন দিস্তাং, সেঙচু, রঙ্গনিউং ইত্যাদি। অনেকের মতে, আবার তৃষ্টা শব্দ থেকেও তিস্তা এসেছে। তিস্তা হচ্ছে তৃষ্ণা মেটানোর নদী।

ইতিহাস বলে, বাংলাদেশ অঞ্চলের খ্রিস্টপূর্বকালের সব নদীর বিবরণ বা অবস্থান সম্পর্কে তথ্যগুলো কিন্তু খুবই অপ্রতুল। তবে খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদীকে ঘিরে বিভিন্ন নগর-শহর-বন্দরের পত্তন ঘটেছিল। সেই সব নদীর কিছু মহাভারতের জাতকের গল্পে, মেগাস্থিনিসের বিবরণ, এলিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্তে, এমনকি সংস্কৃত কবি কালিদাসের লেখায়ও পাওয়া যায়। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে বাংলাদেশের বটেশ্বর নরসিংদী জেলায় নগর গড়ে উঠেছিল। ব্রহ্মপুত্র শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলে সম্ভবত সেই সময় বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে এই স্থান সরাসরি যুক্ত ছিল। ‘মিলিন্দ পঞহো’ গ্রন্থে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের দিকে একটি সামরিক বন্দর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

ইতিহাসের কথা কেন বলছি, তার কারণ ইতিহাসের পথে সাম্প্রতিক সময়ে রচনা হয়। আজ যখন অসময়ে এই নদী সম্মেলন হতে চলেছে। এমন সময়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিলিত হচ্ছেন, যখন গোটা পৃথিবী অস্থির নৈরাজ্যের শিকার। বাংলাদেশ ও ভারত জিওস্ট্র্যাটেজিক অবস্থানগতভাবেও একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরেছে।

আর সেই কারণে মনে রাখতে হবে যে ইবনে বতুতাসহ যত প্রাচীন এবং মধ্যযুগের পরিব্রাজক এসেছিলেন, তাঁদের সেই ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল এই নদী ছিল বলেই। তাঁরা তো এই নদীপথেই এসেছিলেন। ‘ব্রহ্মপুত্র তোমার তিস্তার জল আমার আর তিস্তার পানি তোমার’—এই ঝগড়া বোধ হয় আমাদের এই উপমহাদেশের জন্যই খারাপ। বাংলাদেশে নদীর ভাঙাগড়া ভূমিরূপ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর সে কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের এই নদী সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।