প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অকৃত্রিম বন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

Published: 15 August 2022

মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম

পলাশী যুদ্ধের পর মাত্র দেড় যুগের মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, যা ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (১৭৭০ সালে) সংঘটিত হয়। বাঙালির জীবন এবং বাংলাসাহিত্যে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ বছরটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হিসাবে ইতিহাস-স্বীকৃত। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর গ্রামপ্রধান কৃষিনির্ভর প্রান্তিক বাঙালি জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের গতিধারায় এমন একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ছিল যে, পরের পৌনে দুশ বছরের ব্রিটিশ শাসনামল তো বটেই স্বাধীন পূর্ববাংলায় ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলেও সে প্রভাব অব্যাহত থাকে। বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে আসছিল।

ব্রিটিশরা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখল করে ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জয় লাভ করে এবং মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সংঘটিত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইংরেজদের চতুর্মুখী শোষণের ফলে সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে অনাহারে অসুস্থ হয়ে দেশের এক তৃতীয়াংশ লোক প্রাণ হারায় কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা ওই বছর অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি কর আদায় করে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর স্থায়ী হয়েছিল তিন বছর এবং কোম্পানি তাদের নীতির কোনো পরিবর্তন করেছিল বলে কোনো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

ব্রিটিশদের শোষণ বাংলার সমৃদ্ধ গ্রামীণ অর্থনীতিকে যে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্রিটিশ কর্মকর্তা মুর্শিদাবাদে নিযুক্ত কোম্পানি-কুঠির অধ্যক্ষ বেকারের এক চিঠিতে। ১৭৬৯ সালে বেকার তার এক চিঠিতে দুঃখ প্রকাশপূর্বক উল্লেখ করেন-‘আমি এই দেশটির একদার সমৃদ্ধ অবস্থার কথা বেশ ভালোভাবে স্মরণ করতে পারি। এখানে এক সময় দেশীয় লোকেদের বাণিজ্য করার অধিকার ছিল মুক্ত, সে সময় দেশটি সমৃদ্ধ ছিল; কিন্তু আমি এখন দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে দেশটির বর্তমান ধ্বংসাত্মক অবস্থার জন্য আমাদের একচেটিয়া বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি দায়ী, যার সঙ্গে আমিও যুক্ত।

ব্রিটিশরা বাঙালির স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হলো না, তাদের ধনে-মানে-প্রাণে কীভাবে ধ্বংস করা যায় সে অপতৎপরতাও অব্যাহত রাখল। ১৯৪৭ সালে তারা এ দেশের দখলদারিত্ব ছেড়ে দিল বটে কিন্তু এক সময়ের সমৃদ্ধ কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির সেই ঐতিহ্যটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেল। বাঙালি মুসলমানদের অবস্থাই সব চেয়ে বেশি শোচনীয় হয়ে ছিল। ১৯৪৭-এর আগে মনে করা হয়েছিল, স্বাধীনতা পেলে বাঙালি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। সেই আশা নিয়েই বাঙালি মধ্যবিত্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কিন্তু ততদিনে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ বেশ শক্তভাবেই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে বাঙালি মুসলমান নেতারা মুসলিম লীগপ্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের সঙ্গে একমত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে কাজ শুরু করেন। তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি, তিনি তখন ইসলামিয়া কলেজের তরুণ ছাত্রনেতা। তিনিও আশা করেছিলেন, স্বাধীনতা আসলে গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের ধসে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

অধিকারবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নেতা বঙ্গবন্ধু

৪৭-এর আগস্টে দেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলো। আমাদের এ তরুণ ছাত্রনেতা ৪৭ পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করে এবং দেশ ভাগ ও অব্যবহিত পরে পূর্ববাংলা সম্পর্কে মুসলিম লীগ নেতাদের ভাবনাগুলো বুঝে নিয়ে আশাহত হয়ে সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ফিরে এসে মুসলিম লীগবিরোধী রাজনীতির সূচনা করেন। তার অনুমান সত্যে পরিণত হলো ৪৮ সালেই যখন ভাষার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রকাশ করল।

বঙ্গবন্ধু কৃষকের সন্তান। তার উপলব্ধিতে এটা ছিলই যে পলিগঠিত এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের অর্থনীতির প্রাণশক্তি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের হাতে। পৌনে দুশ বছর ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে পড়ে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করতে না পারলে পূর্ববাংলার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলাকে তাদের উপনিবেশের বাইরে কিছু ভাবতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য-তার গোটা জীবন বিশ্লেষণ করলে এ কথাটি নির্ধিদ্বায় বলা যায়।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় ফিরে আসার পর ১৯৪৯ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় পূর্ববাংলার প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরে ১৯৫৫ সালের কনভেনশনে সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়) অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যেই তিনি মুসলিম লীগ সরকারের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের গঠনের সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলনে নেমে গ্রেপ্তার হন এবং জেলে অবস্থান করছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতিতে তিনি ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন এবং গণমানুষের সঙ্গে তার সংযোগ সুদৃঢ় হতে থাকে। কারণ তিনিও অন্তর্গতভাবে বাংলার গণমানুষের বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মতো দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাদের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বেড়াতেন। কিন্তু ক্ষমতা তো পাকিস্তানি শাসকদের হাতে। কাজেই তিনি অন্য পথ ধরলেন। তিনি ভাবলেন, গণমানুষের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে না পারলে এবং অধিকার আদায়ের এ সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে তাদের সম্পৃক্ত করতে না পারলে কোনোদিনই প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। এ ধারণাটি তিনি আত্মস্থ করেছিলেন আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে থেকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘…কী করলে এদের মনের উদ্বোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে। আমরা যদি বাইরে থেকে সাহায্য করি তাতে এদের অনিষ্টই হবে। কী করলে এদের মধ্যে জীবন সঞ্চার হবে, এ প্রশ্নই তখন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল।’ বঙ্গবন্ধুও সেই পথেই অগ্রসর হলেন। নির্যাতিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মনে নিজেদের ভালো করার, অধিকার আদায় করার স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে কাজ শুরু করলেন, পাশাপাশি তাদের জীবনমান উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনাও তৈরি করলেন। বাংলার নিপীড়িত কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুরসহ সর্বস্তরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলার এবং তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত করার প্রথম সুযোগ আসে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে। এ নির্বাচনের প্রচারণায় তিনি গোটা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়ান এবং মুসলিম লীগ সরকারের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেন। বাংলার গণমানুষ তাদের প্রকৃত বন্ধুকে চিনতে ভুল করেনি। কারণ ২১ দফাভিত্তিক যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী মেনিফেস্টো খুব সতর্কভাবে তৈরি করা হয় পূর্ববাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনুকূলে। ২১ দফার ২, ৩, ৪, ৭, ও ৮ নং দফায় প্রত্যক্ষভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা উল্লেখ করা হয় এবং বাকি ধারাগুলোও এমনভাবে প্রণয়ন করা হয় যেন সেগুলোও পরোক্ষভাবে তাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ১৯৬৬ সালে প্রণীত ৬ দফা প্রণয়ন করা হয়। ৬ দফা ছিল শোষণ ও বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা রক্ষাকবচ। ৬ দফায়ও তাদের বাঁচার দাবি হিসাবে প্রতিফলিত হয়। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ এ ঐতিহাসিক পোস্টারটি সেদিন প্রমাণ করেছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গণমানুষ তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থা কতটা সূচনীয় হয়ে উঠেছিল। ১৯৫৪ সালে ২১ দফার ভিত্তিতে যেমন পূর্ববাংলার গণমানুষ বিপুলভাবে সমর্থন দেয় তেমনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিপুলভাবে সাড়া দেয় ৬ দফার মর্ম উপলব্ধি করে।

অর্থাৎ ৪৭ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত সময়কালে বঙ্গবন্ধু তার মৌলিক কাজে সফল হন- গণমানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে পারেন এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। কাজটি তিনি এত সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন যে, ‘তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরা’ এ অভিধায় ভূষিত বাঙালি একদিন প্রায় খালি হাতে ফাইনেস্ট ফাইটিং মেশিন নামীয় প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হলো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন ছিল দরিদ্র বাঙালির পক্ষে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাধনায় সফলতার প্রথম ধাপ। তার দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর থেকে। অবশ্য দেশ গঠনের কাজে তিনি যেসব পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন সেগুলোর ছক তিনি কষে রেখেছিলেন অনেক আগেই দুই যুগের প্রত্যক্ষভাবে মুসলিম লীগবিরোধী রাজনীতির মাঠে থেকে এবং পাকিস্তানি শাসকদের জেলজুলুম সহ্য করতে করতে।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর কর্মপরিকল্পনা

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রায় সাড়ে তিন বছরে তিনি যেসব কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে ছিলেন সেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের স্বস্তি ফিরিয়ে আনা, তাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা না গেলে ‘এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে’ বলে ১০ জানুয়ারির বিশাল জনসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেন। চব্বিশ বছরের নানামুখী শোষণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এমনিতেই পূর্ববাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল, তার ওপর মুক্তিযুদ্ধের সময় চালানো ধ্বংসযজ্ঞে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষিব্যবস্থা, ছোট-বড়-মাঝারি শিল্পকারখানা, কুটিরশিল্প ইত্যাদি জীবন সহায়ক শক্তিগুলো প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়ে যায় পাক-হানাদার বাহিনী। কাজেই মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুব সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সংগ্রামে আত্মনিবেদিত বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে হাল ধরলেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণ তথা গণমানুষের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটির বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো :

ক. কৃষির পুনর্গঠন ও সংস্কার : এই একটি ক্ষেত্রে যে কী পরিমাণ ক্ষতি সাধন হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া দুরূহ। পাক হানাদার বাহিনী ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, হালের গরু জবাই করে খায়, মজুত গোলার ফসল ও মাঠের ফসল পুড়িয়ে দেয়; সার নেই, বীজ নেই, সেচের পাম্প নেই। কলকারখানা বন্ধ, মেশিনপত্রসহ সব অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কৃষক চাষে হাত দিতে পারছে না, শ্রমিক কাজে যেতে পারছে না, খাদ্যশস্যের ব্যাপক ঘাটতি, কলকারখানায় নিত্যপণ্যে উৎপাদন থেমে রয়েছে-আক্ষরিক অর্থেই কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাথায় দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না সেদিন। বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে একদিকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের রক্ষাকবচ সংবিধান রচনার উদ্যোগ নিলেন, অন্যদিকে প্রথমেই নজর দিলেন কৃষি ও শিল্পকারখানা পুনর্গঠনে, যাতে দেশের বৃহৎ দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্থবির জীবন ক্রমে সচল হতে পারে। কারণ, আজীবন তিনি রাজনীতি করেছেন এদের জন্যই। তার প্রথম লক্ষ্য ছিল দেশে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করা। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না পারলে অন্যান্য খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করা এবং কৃষির আধুনিকীকরণ। প্রথমেই তিনি স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে গণমানুষের কাছে দেয়া অঙ্গীকারগুলো তিনি পূরণ করলেন : ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পরিবার প্রতি সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির সিলিং নির্ধারণ, পাকিস্তানিদের করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা খারিজ করলেন। তারপর সারা দেশে হ্রাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজার লো-লিফট পাওয়ার পাম্প, ২৯০০ গভীর নলকূপ, ৩০০০ অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা করলেন; সাধারণ বীজের পাশাপাশি অধিক ফলনশীল ধানবীজ, পাটবীজ, গমবীজ বিতরণ করা হলো; বিশ্ববাজারের চেয়ে অনেক কম মূল্যে সার সরবরাহ করা হলো; উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে দিলেন; কৃষকদের মধ্যে ১ লাখ হালের বলদ ও ৩০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হলো; কৃষি গবেষণায় গুরুত্ব দিলেন; কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনে উদ্যোগী হন, গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প চালুর ব্যবস্থা করলেন; খ্যদ্য মজুতের জন্য ১০০টি গুদাম নির্মাণ করলেন; কৃষককে তার কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে ‘বঙ্গবন্ধু পুরস্কার’ নামে একটি পুরস্কার প্রবর্তন করলেন। এ পর্যায়ে ২২ লাখ কৃষক পরিবারকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্বাসন করতে হয়েছিল, যাদের কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কৃষকের প্রতি তিনি এতটাই মনোযোগী ছিলেন যে, স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পেতে কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সহযোগিতা চাইতে যে দেশেই সফর করেছেন সেখানেই তিনি কৃষির আধুনিক উপকরণ পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সবচেয়ে বেশি।

খ. কলকারখানা জাতীয়করণ: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ কলকারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা পূর্ববাংলার মেহনতি দরিদ্র শ্রমিকদের নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নিত। সে ধারাবাহিকতা যাতে চলতে না পারে সে জন্য তিনি বৃহৎ ও মাঝারি মাত্রার শিল্পকারখানা (ব্যাংক বিমা) জাতীয়করণ করেন। যাতে শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরি পায় এবং কলকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া কৃষি খাতে উৎপাদিত শিল্প পণ্যের ব্যবহার যাতে নিশ্চিত হয় সেটাও বিবেচনায় ছিল। কৃষি উৎপাদন ও কলকারখানার উৎপাদন সমান্তরাল না হলে উন্নয়নের গতিধারা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। অবশ্য কলকারখানা, ব্যাংক-বিমা জাতীয়করণের পরিকল্পনা তিনি পাকিস্তান আমলেই করেছিলেন, সে লক্ষ্যে যখনই সুযোগ পেয়েছেন তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠনগুলোর জাতীয়করণের দাবি তুলে ধরতেন। ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও জাতীকরণের কর্মসূচি ছিল, ৬-দফাতে ছিল, ৭০ নির্বাচনে ছাত্রদের ১১ দফায়ও ছিল। কাজেই জাতীয়করণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে তিনি বিলম্ব করেননি।

যুগপৎ এ কর্মসূচির কারণে খুব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় গতি সঞ্চারিত হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তার সুফল ভোগ করতে শুরু করে। ক্রমে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে, বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত হতে থাকে। উন্নত বীজ, আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি ও ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শ্রমিক নতুন উদ্যমে কাজ করে কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে থাকে, পাশাপাশি তিনি বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যখন আনুপাতিক একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন তখনই নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রায় সপরিবারে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজীবন সংগ্রাম করে সোনার বাংলা গড়ার যে মাইলফলক তিনি গড়েছিলেন তার সুফল তিনি চোখে দেখে যেতে পারলেন না। ৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর দেশে যে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয় তার সবটুকু অবদান ছিল বঙ্গবন্ধুর নিরলস পরিশ্রম ও যুগোপযোগী পদক্ষেপের ফসল।

আজকের বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। করোনার মতো মহামারি, বিশ্বব্যাপী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জাতীয় সংকট, যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের কেউ অনাহারে থাকে না। বাংলাদেশ নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, অনেকই সমাপ্তির পথে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের আবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে এগিয়ে চলছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ অচিরেই শক্তভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এ ধারাটি অব্যাহত রাখতে হলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার, যা একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি যে অবিকল্প নেতৃত্ব সেটা তিনি গত একযুগে শাসন ক্ষমতায় থেকে প্রমাণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের শরীরে যে অজেয় অগ্রগামী প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে পেরেছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তার দেশের মেহনতি মানুষ শুধু উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করে আত্মতৃপ্তিতে না থেকে উন্নয়নের অংশীদার হবে সঞ্চালক ও প্রভাবক হিসাবে, সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর হাতে তার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নটি সফল হতে দেওয়া হয়নি, যাপিত জীবনের বাঁকে বাঁকে এ দেশের গণমানুষকে সেই আক্ষেপ করতে হয়। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট পিতৃহন্তার মতো জঘন্য ঘটনার অবতারণা না হতো, তাহলে বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নয়ন-সূচকের সব ধাপগুলো অতিক্রম করে রূপে রূপে অপরূপা সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা অপরূপ উন্নত দেশে পরিণত হতে পারত।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অগ্রণী ব্যাংক