সাত দিনে ১৯ খুন!

Published: 11 November 2022

বিশেষ সংবাদদাতা :


কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের শিক্ষিকা রোকসানা খানম (৫২) খুন হয়েছেন গত রবিবার রাতে। এ ঘটনায় তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলে নওরোজ কবির নিশাতকে (১৯) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সদর থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন খানের ভাষ্য, জিজ্ঞাসাবাদে ফুফু রোকসানাকে শিল দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছেন নিশাত। টাকা-পয়সা না দেওয়ায় ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে বাধা দেওয়ায় ফুফুর ওপর ক্ষিপ্ত হন তিনি।

এই আক্রোশ থেকে ঘুমন্ত ফুফুর ওপর হামলা চালান নিশাত।
৪ নভেম্বর চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার কড়ইয়া ইউনিয়নে সম্পত্তিগত বিরোধকে কেন্দ্র করে বড় ভাই তাজুল ইসলামের (৬৫) ইটের আঘাতে ছোট ভাই সিরাজুল ইসলামের (৫২) মৃত্যু হয়।

একই দিন নড়াইল সদরের সড়াতলা গ্রামে গৃহবধূ আছিয়া বেগমের (২২) গলা কাটা দগ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, যৌতুক না পেয়ে এক সন্তানের জননীকে হত্যা করেছেন স্বামী রনি শেখ (২৪)। ঘটনার পর পলাতক রনিকে তাঁর সহযোগী আব্বাসসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

৩ নভেম্বর রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় রুবেল মিয়া ওরফে রবিন খুন হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক স্ত্রীর বর্তমান স্বামী জাবেদ মিয়ার ছুরিকাঘাতে খুন হন তিনি। জাবেদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের সহিংসতা ও খুনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা আপনজনদের মধ্যে বিরোধের জেরে। এসব ঘটনায় সম্পর্কের নিবিড় বন্ধন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে হীন স্বার্থ ও পাশবিকতা, যা গোটা সমাজের সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধের জন্য বড় ধরনের হুমকি।

গণমাধ্যম ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১৯ জন নারী-পুরুষ ও শিশু স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে। এর মধ্যে বাবার হাতে সন্তান ও সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। রয়েছে স্বামীর হাতে স্ত্রী ও স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের একাধিক ঘটনা।

এসব খুনের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে সম্পত্তি ও টাকা-পয়সা লেনদেনকে ঘিরে। এরপর রয়েছে পরিবারে আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবনের জের, যৌতুক ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক।

দেশের সার্বিক অপরাধপ্রবণতা নিয়ে কোনো একক জরিপ না থাকলেও সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বলছে, পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে। এই সহিংসতা সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঘটছে। সহিংসতার বেশির ভাগ শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১০ মাসে পারিবারিক কলহের জেরে বিভিন্ন বয়সের ২৫৩ জন নারী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ১৭৫ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হন। স্বামীর পরিবারের অন্য সদস্যদের হাতে ৪০ জন ও নারীর পরিবারের সদস্যদের হাতে ৩৮ জন খুন হন। এই সময়ে আত্মহত্যা করেন ৭৯ জন নারী। ৭৯ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে ১০ মাসে ১০৩ শিশু খুন হয়েছে এবং ২৫ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সংস্থাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

এর আগে সংস্থাটি বছরের প্রথম তিন মাসের (জানুয়ারি-মার্চ) প্রতিবেদনে পারিবারিক সহিংসতায় ৬৬ জন নারী ও ৩১ শিশু খুন হওয়ার তথ্য জানিয়েছিল। সে অনুযায়ী, মাসে গড়ে ২২ নারী খুন হন। এর পর থেকে গত ছয় মাসে অক্টোবর পর্যন্ত খুনের ঘটনা ২৭ জনে পৌঁছায়। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রাজধানীর ৫০ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ৫১০টি মামলা হয়েছে। সে অনুযায়ী, মাসে গড়ে ১৭০টি করে মামলা হয়। পরের ছয় মাসে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ৯৭টি মামলা হয়। এই সময়ে মাসে গড়ে ১৮২টি মামলা হয়। এই পরিসংখ্যানও বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে পারিবারিক কলহে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অক্টোবরে ১৪ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৮৯ জন শিশু, কিশোরী ও নারী খুন হয়েছেন। সেপ্টেম্বরে ছয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৮৭ জন শিশু, কিশোরী ও নারী খুন হন। চলতি বছরে প্রথম তিন মাসে গড়ে এই খুনের ঘটনা ছিল ৮১টি। গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া তথ্যের বরাতে সংস্থাটি বলছে, পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক, প্রেমঘটিত ঘটনা, প্রতিশোধ, যৌন হয়রানি ইত্যাদি কারণে এসব খুনের ঘটনা ঘটে।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া। আরো রয়েছে সুস্থ বিনোদনের অভাব, প্রযুক্তির অপব্যবহার, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদক, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। এসবের বিরূপ প্রভাবে পরিবারে স্বজনদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে বিদ্বেষ বাড়ছে। পরিণতিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, পারিবারিক সহিংসতা আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে সহিংসতার ধরন পাল্টেছে এবং সহিংসতা বাড়ছে।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার অন্যতম কারণ মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ বেড়ে যাওয়া এবং পারিবারিক বন্ধন নড়বড়ে হওয়া। তিনি বলেন, এ ছাড়া প্রযুক্তির অপব্যবহারও এর পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। অনেক সময় প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না ঘটায় কিছু মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এটা পরিবার থেকে শুরু হয়। তাই পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন বাড়াতে হবে। পাড়া-মহল্লায় আগে যেসব স্থানে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব হতো, সেগুলোতে জোর দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সভাপতি খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে এখন ধৈর্য ও পারস্পরিক সম্মান বোধ একেবারে কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে একজন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ঘটছে খুনের মতো ঘটনা। অনেক পরিবারে ব্যক্তির মানসিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয় না। এতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া হয় না।

তিনি বলেন, পারিবারিক সহিংসতা রোধে পরিবার ও সমাজের যদি শক্তিশালী ভূমিকা থাকে, তবে সমস্যাগুলো অনেকাংশে কমে আসবে। সম্প্রতি নিত্যপণ্যের চড়া দামও কিছু ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে পারিবারিক সহিংসতায় যোগসাজশ রাখছে বলে মনে করি।