চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট প্রণয়ন
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিছু চ্যালেঞ্জ অভ্যন্তরীণ, কিছু বৈশ্বিক। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা কথাবার্তা বলে আসছি। যদি আমরা চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারি, তাহলে আমাদের আরো বড় সংকটের মধ্যে পড়তে হতে পারে। বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিত এবং চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট প্রণয়নআমরা দেখছি যে আর্থিক এবং ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। কমেছে রপ্তানি। এর মধ্যে মুদ্রাপাচার একটা বড় সমস্যা। রিসোর্সগুলো যখন বাইরে চলে যায়, তখন দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে পড়ে। করও বেশি আদায় হচ্ছে না। জ্বালানির দাম কিছুটা সমন্বয় করা হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। এমন একটা অবস্থায় আমাদের বাজেট আসছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কতগুলো বিষয়ে আমাদের দেখতে হবে। প্রথমত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আইএমএফও বলেছে যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অনেক বেড়েছে। দু-একটা ব্যাংক মোটামুটি ভালো করছে। ওদের হয়তো খেলাপি ঋণ কম। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের হার ২১ থেকে ২২ শতাংশের মতো। আইএমএফ বলছে এটা ১০ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আনার জন্য। এদিকে ব্যক্তিমালিকানায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো একটু ভালো আছে, তাদের পরিমাণ ৭ থেকে ৮ শতাংশের মতো, এটাকে ৫ শতাংশে নিয়ে আসতে বলছে।
এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে কিন্তু সঞ্চিত তেমন নেই। এই ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি বেশ কয়েকটি ব্যক্তি খাতের এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেও আছে। আইএমএফও এটা বলছে, খেলাপি ঋণ যদি আমরা ঠেকাতে না পারি, তাহলে কিন্তু দেশের সার্বিক ক্ষতি হবে। তাদের শর্ত পালন করা কঠিন হবে। তারা আমাদের কতগুলো আইন সংশোধন করার কথা বলছে, বিশেষ করে ব্যাংকিং আইন। ব্যাংকিং আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক খাতের জন্য পাঁচটা আইন সংশোধনের কথা বলা হচ্ছিল বারবার, এটা আইএমএফ বলেছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং আইনটা মাত্র মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করেছে, বাকিগুলো হয়নি। বাকিগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন। আছে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন। আছে অর্থঋণ আদালতের ব্যাপারটিও। তারপর আছে দেউলিয়া আইন। এসব আইনের সংস্কারের ব্যাপারটা কিন্তু এগোচ্ছে না।
মোটা দাগে সরকারের এবং দেশের আর্থিক সক্ষমতা অনেকাংশে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রথমত দেশে কর আদায় হচ্ছে না। দেশের অন্যান্য খাতে যে সরকারি বিভিন্ন সোর্স আছে, ফি আছে সেটাও ঠিকঠাক আদায় করা হচ্ছে না। আর বাইরে থেকে আসা আয়, অর্থাৎ রপ্তানি, এফডিআই অথবা রেমিট্যান্স কমে গেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ফরেন রিজার্ভ কমে গেছে। এখন আছে গ্রস প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। তবে নিট রিজার্ভ ২২ বিলিয়নের মতো। আমরা যদি রপ্তানি, রেমিট্যান্স না বাড়াই তাহলে কিন্তু রিজার্ভ বাড়ানো কষ্টকর হবে।
রেমিট্যান্স বাড়ানোর একটা সমস্যা হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের চারটা রেট। একটা অফিশিয়াল রেট, একটা এক্সপোর্ট রেট, একটা ইমপোর্ট রেট, আরেকটা প্রবাসী রেমিট্যান্স রেট। এতগুলো রেট থাকলে লোকজন কিভাবে কী করবে। তারা তো দুদিক থেকে দ্বিধায় পড়বে। তারা দেখছে যে সরকার ঠিক করেছে ১০৭ টাকা। হুন্ডি হচ্ছে। সেখানে ডলারের মূল্য বেশি। হুন্ডির বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। হুন্ডি অনেকটা অর্থপাচারের মতো। এটা রোধ না করতে পারলে আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ানো কঠিন হবে, তদুপরি দেশের অনেক অর্থ বিদেশেও পাচার হবে।
আমাদের গ্যাস উত্তোলন করতে হবে। আমরা যদি না পারি, বৈদেশিক যে কম্পানিগুলো আছে তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। বাংলাদেশ কিছু বিদেশি কম্পানির সঙ্গে এ ব্যাপারে চুক্তি করবে, এটা ইতিবাচক খবর। বিদেশি কম্পানিগুলোরও তো অনেক শর্ত থাকতে পারে। তাদেরও তো প্রচুর বিনিয়োগ করতে হয়। ১০টা কূপ খনন করলে হয়তো একটা কূপও পাওয়া যাবে না। একটা কূপ খনন করতে কয়েক শ কোটি টাকা দরকার।
আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। আমরা যদি সরবরাহ না বাড়াই, উৎপাদন না বাড়াই, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। শুধু যদি আমরা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিই, সেটাতে কিন্তু তেমন কাজ হবে না, সেটা কিন্তু সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি নয়। এতে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। আমাদের বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে, সে জন্য শিল্পক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
আরেকটা বিষয় বাংলাদেশে লক্ষণীয়। আমরা কিন্তু বাজার মনিটরিং করি না। মানুষ নানা রকম কথাবার্তা বলে। একেক পণ্যের দাম একেক সময় বেড়ে যায়। দাম বাড়ার কারণ হয়তো সরবরাহে স্বল্পতা। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেল চিনির। এর আগে সয়াবিন তেল। এভাবে একটার পর একটা পণ্যের দাম বাড়ে। হঠাৎ হঠাৎ দাম বেড়ে যায়। মানে, এটা ব্যবসায়ীদের একটা কারসাজি। এখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দু-একটি জায়গায় যায়। দোকানে গিয়ে জরিমানা করে। এতে কাজ হবে না। ধারাবাহিকভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজন হলে কমার্স মিনিস্ট্রিকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে, তারা বাজার মনিটরিং করবে। মূল্যবৃদ্ধির এই যে সংস্কৃতি, এটা রুখতে হবে।
পাশ্চাত্যে যেখানে ফ্রি ইকোনমি কাজ করে, সেখানেও কিন্তু বাজার মনিটরিং আছে। সেখানকার বাজারে কিন্তু হঠাৎ করে কোনো কিছুর দাম বাড়ে না। এখানে দিন দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, কারো কোনো তদারকি নেই। ভোক্তারা অসহায়। আমাদের দেশে ভোক্তারা কোনো প্রতিবাদ করে না। খেতে হবে, খাব; কী করব, কষ্ট হচ্ছে—এগুলোই বলে সাধারণ ভোক্তারা; কিন্তু অন্যান্য দেশের ভোক্তারা যথেষ্ট সজাগ। লোকজন যখন জানে এটা খারাপ হচ্ছে, তখন তারা শক্তভাবে প্রতিবাদ করে। আওয়াজ তোলে। সামাজিক আন্দোলনের মতো করে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। শুধু সরকারই সব করবে, আমরা শুধু চেয়ে দেখব, বসে থাকব, টিভির সামনে গিয়ে দু-একটা কথা বলব, এতে কিন্তু লাভ হবে না। হতাশামূলক কথা বললে কিন্তু লাভ হবে না। এখন সময় এসেছে সরকারের পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্ব পালন করার। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সরকারকে সহযোগিতা করা। সেটা পালন করতে হবে।
আইএমএফ কিন্তু মূল্যস্ফীতি চ্যালেঞ্জ বিষয়ে বিশেষ করে বলেছে। ওয়ার্ল্ড পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ে কথা বলেছে। এখন দেখছি ডলার থেকে বেরিয়ে রাশিয়া, ভারত, চীন অন্যান্য মুদ্রা বিশ্ববাণিজ্যে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে রুপিতে আদান-প্রদান করবে। এমনকি বাংলাদেশকে বলছে টাকা দিয়ে কিনতে হবে বা রুপি দিয়ে কিনতে পারো। জিনিসটা কিন্তু এত সহজ নয়। এখানেও কিন্তু চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে যাচাই করতে হবে।
কভিডের কারণে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছিল। অর্থনীতির গতি মন্থর ছিল। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমাদের রপ্তানিগুলো যেখানে যায় সেসব দেশের অনেকটির অর্থনীতি কিন্তু এখন খুব বেশি ভালো নয়। এটা কিন্তু আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করছে। যেমন—গার্মেন্ট প্রডাক্ট বেশির ভাগ আমেরিকা ও ইউরোপে যায়, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিন্তু খুব ভালো নয়। যে দেশে আমাদের প্রডাক্ট যায়, তাদের অর্থনীতি যদি খারাপ হয়, তাহলে এটা আমাদের ওপর প্রভাব পড়বে। বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ তখনই গ্রো করবে, যখন অন্যান্য দেশ গ্রো করবে, যখন বিশ্ববাণিজ্য ঠিক থাকবে ও চাঙ্গা থাকবে।
সম্প্রতি আমরা একটা মুভমেন্ট দেখতে পাচ্ছি, সেটা হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগিতা। বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্যের একটি কেন্দ্র, অর্থাৎ সংযোগকারী স্থান হিসেবে বিবেচনা করতে চাইছে কিছু দেশ। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতের জন্য কানেক্টিভিটি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর রাজনীতি আলাদা নয়। দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক অবস্থা ভালো থাকতে হবে। স্থানীয়ভাবে যেন রাজনৈতিক পরিবেশটা ভালো থাকে।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
অনুলিখন : রায়হান রাশেদ