বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের হালচাল

Published: 28 June 2023

মো. জাকির হোসেন

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক সব রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ই রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব স্বীকৃত। বিভিন্ন সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রকৃতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভূমিকার মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

প্রশ্ন হলো, যে কেউ একটি রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিলেই কি তা রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিগণিত হবে? সাধারণভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক দল এমন এক সুসংগঠিত জনগোষ্ঠী, যারা একটি রাজনৈতিক একক হিসেবে কাজ করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা লাভ করে নিজেদের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে প্রয়াস পায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এডমন্ড বার্ক রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দল হলো একটি সুসংগঠিত জনসমষ্টি, যারা কোনো নির্দিষ্ট নীতির দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং যৌথ প্রচেষ্টার দ্বারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে।’ রাজনৈতিক দলকে শুধু সরকারি ক্ষমতা দখলের জন্য উত্সুক সংগঠনরূপে গণ্য করলে ভুল করা হবে। রাজনৈতিক দলকে মূলত জাতীয় স্বার্থ পরিপূরণের জন্য গঠিত রাজনৈতিক সংগঠন হতে হবে।

একটি সংগঠনকে রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে হলে তার রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনসাধারণের মননে সমাজ সম্পর্কে বিশেষ ভাবধারা, চিন্তা ও মূল্যবোধ সঞ্চারিত করা হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের হালচালসুতরাং রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যবোধ, মনোভাব এবং চিন্তাধারার আলোকে নাগরিকদের মনোজগৎ দীক্ষিত ও শিক্ষিত করার প্রক্রিয়া। এভাবে রাজনৈতিক কার্যাবলিতে উদ্বুদ্ধ করে রাজনৈতিক দল বিদ্যমান রাজনৈতিক মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস দৃঢ় করতে অথবা নতুন মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সঞ্চারে সাহায্য করে।

ফলে রাজনৈতিক দলগুলো সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিকে দৃঢ় করে তার নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে সাহায্য করে কিংবা প্রয়োজনমতো রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিদ্যমান কাঠামোর পরিবর্তন করতে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করে থাকে।
একটি সংগঠনকে রাজনৈতিক দল হতে হলে তার মধ্যে সহিষ্ণুতার মনোভাব থাকতে হবে। অসাম্প্রদায়িকতা সেই সংগঠনের মূলমন্ত্র হতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। সংকীর্ণ মনোভাব সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের অনুকূল নয়।

দলের নেতাদের হতে হবে আদর্শস্থানীয় ব্যক্তি। দলের নেতা যদি আদর্শবান না হন, তাহলে কর্মীরাও আদর্শবান হয় না। ফলে দল হয় আদর্শ বিচ্যুত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত মতভেদ থাকতেই পারে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে একটি ন্যূনতম ক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে অবশ্যই ঐকমত্য প্রয়োজন। কোনো দল ব্যক্তিগত স্বার্থ বা গোষ্ঠী স্বার্থের প্রতি বেশি মনোযোগী হলে সে দল প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক দল হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ রাষ্ট্র থাকলেই রাজনৈতিক দলের প্রশ্ন আসে। যেসব শর্ত পূরণ করলে একটি ভূখণ্ড রাষ্ট্র হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকা।
ওপরের মানদণ্ডগুলো বিবেচনায় নিলে রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবিদার আমাদের দেশের অনেক সংগঠনই রাজনৈতিক দল নয়। কারণ এদের অনেকগুলোই হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। আবার কোনো কোনো দলের জন্ম হয়েছে শুধু একটি বিশেষ দলের বিরোধিতা করার জন্য। এরা মুখে যাই বলুক, জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে এরা বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের যন্ত্রী হিসেবে কাজ করছে। ফলে এসব সংগঠন রাজনৈতিক দল নয়, কুচক্রী উপগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের দাবিদার এসব সংগঠন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মঙ্গল সাধনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে না, কিংবা জনসমর্থন লাভের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি প্রচার করলেও ক্ষমতা লাভের পর সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে না। রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট আদর্শ থাকে এবং সে আদর্শকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়। আমাদের অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যারা নিজেদের প্রচারিত আদর্শ বাদ দিয়ে সময় ও সুযোগমতো অন্যের আদর্শ অনুসরণ করে। রাজনৈতিক দল নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী এবং ক্ষমতা দখলের পর দলীয় নীতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু অনেক দল আছে, যারা নির্বাচনে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে অবতীর্ণ হয় না, বরং বিশেষ লাভ ও লোভের বশবর্তী হয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রীদের খেলার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

অনেক রাজনৈতিক দল শুধু ভয়াবহ রকম সাম্প্রদায়িক সংগঠনই নয়, এদের অনেকেই আবার জঙ্গিবাদের দোসরও। ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যা করে এদের কেউ কেউ বলে, এদের ভোট দেওয়া হলে ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ভোট দেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতি প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ। জনসাধারণ রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে অবহিত থাকে। কিন্তু আমাদের অনেক রাজনৈতিক দল বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে গোপন মিশনে ব্রতী হয়। কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাসকে সমান্তরাল সরকার পরিগণিত করে সেখানে অভিযোগ দায়ের করে। বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের একজন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তাদের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেছেন। গুরুতর এই অভিযোগ তাঁর দল থেকেই উঠেছে। আরেকটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে লবিং করে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে সক্ষম হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে জোর তদবির করছে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন ব্যাহত করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে নয় কি? বিএনপির একজন নেতা পত্রিকায় জানিয়েছেন, ছয়টি ঘটনার জন্য ৪৩ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দূতাবাসে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ জন পুলিশ সদস্য। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আছেন ১০ জন। এসব পুলিশ সদস্য ও সরকারি দলের নেতাদের নাম, পদবি এবং ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। তার মানে, বিদেশি দূতাবাস এখন সমান্তরাল বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকার, বিশেষ করে মার্কিন দূতাবাস এখন বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, ভিসানীতিসহ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য আইন বিভাগ। কোনো সংগঠন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে গেলে সেটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠন বিবেচিত হবে কি না তা সময়ই বলে দেবে।

গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক দল একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। গণতন্ত্রের কৃতকার্যতা নির্ভর করে রাজনৈতিক দল কী করছে, কিভাবে করছে তার ওপর। রাজনৈতিক দল আইনসভার অভ্যন্তরে ও বাইরে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্র তথা একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে নিরন্তর সহায়তা করে। রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ ও স্থায়িত্ব রক্ষা হয়। তবে রাজনৈতিক দল একটি সংগঠন হলেও সব সংগঠনই রাজনৈতিক দল নয়, এমনকি তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ দাবি করলেও নয়।