এক দফার চ্যালেঞ্জ ও জনমনে শঙ্কা
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
দেশ, জনগণ ও রাজনীতি এখন রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনপদ্ধতিতে আস্থা-অনাস্থার প্রশ্ন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা-না করার প্রশ্নে উত্তাল। এমন উত্তালময় খেলায় স্পষ্টভাবে দুই দিকে দুটি রাজনৈতিক দল রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলেরই (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) কমবেশি ভূমিকা রয়েছে। নব্বই-পরবর্তী সময়ে এই দুই দলই একাধিকবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।
কখনো সরকারি দল আবার কখনো বিরোধী দলের ভূমিকায় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই সরকার গঠিত হয়েছে।
এক দফার চ্যালেঞ্জ ও জনমনে শঙ্কাগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রীতি-নীতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই গণতন্ত্রের খুঁটি হিসেবে বিবেচিত হয়। সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকারের যেমন দায়িত্বশীলতা ও দায়বদ্ধতা রয়েছে, ঠিক তেমনি বিরোধী দলেরও দায়িত্বশীলতা ও দায়বদ্ধতা কম নয়।
কারণ বিরোধী দল সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত গণতন্ত্রের অন্যতম ধারক-বাহক। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্বাচন ও নির্বাচনপদ্ধতির ওপর আস্থার পাশাপাশি যথাযথ রাজনৈতিক অঙ্গীকারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণই গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে পারে।
১৯৯০ সালে সামরিক শাসক এরশাদের পদত্যাগের পর দেশে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা ১৯৯৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছিল।
কারণ তিন জোটের রূপরেখা অমান্য করে দেশে অনুষ্ঠিত (১৯৯১-৯৫) বেশির ভাগ স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও উপনির্বাচনে তৎকালীন সরকারি দল বিএনপি কারচুপির আশ্রয় নেয়। ফলে দাবি ওঠে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত করার। সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০০১ সালে শান্তিপূর্ণ সরকার হাত বদল হয়। আবার পরবর্তী সময়ে বিএনপিই রাজনৈতিক অঙ্গীকার ভাঙার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয় বিচারপতিদের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ করে নিজ দলীয় সমর্থিত সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে। এমনকি সংবিধানে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব ধাপ যথাযথভাবে অনুসরণ না করে বিএনপিপন্থী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের টানাপড়েনের খেলায় ১/১১ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপিই নমনীয়তার প্রশ্নে ছাড় দেয়নি।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাদের মেয়াদের শেষে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বারবার সংলাপের আহ্বান জানিয়েও ব্যর্থ হয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে টেলিফোনে অনুরোধ জানান। কিন্তু বারবারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ওই সময়ে বিরোধী দল জনগণের সঙ্গে ধোঁকাবাজির খেলায় মত্ত থাকে। দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব সহজে কোনো একটি দলের কাছে বিলীন হয়ে যাবে, এটি ঠিক না। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্দোলন হয়। কিন্তু সেখানে মানুষ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মারা হয় না।
দেশের জনগণ রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে। দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার মাধ্যমে শীর্ষ নেতারাই দেশে গণতন্ত্রের মাইলফলক রচনা করতে পারেন। মুখে গণতন্ত্রের বুলি আউড়ে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় না। এটি যেমন সরকার বোঝে, তেমনটি বিরোধী দলও বোঝে। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদ্য ঘোষিত কর্মসূচি যেন শান্তিপূর্ণ হয়, তা দেশবাসীর প্রত্যাশা। কারণ গণতান্ত্রিকভাবে যেকোনো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিই গ্রহণযোগ্যতা পায়। তা না হলে কর্মসূচি ও লক্ষ্য দুটিই ব্যর্থ হয়।
গণতন্ত্র হলো ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’। কাজেই কম্প্রোমাইজ ও নমনীয়তাই গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করতে পারে—এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিধা নেই। আর কয়েক মাস পরই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে গণতন্ত্র রক্ষার নামে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক হুমকি-ধমকি সাধারণ জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্বাচন নিয়ে সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে গণতান্ত্রিক সরকারের শেষ বছরে এসে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংঘাত ও সহিংসতার রাজনীতি অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘোষিত বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অভিন্ন যুগপৎ কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করে তুলেছে। এতে জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন নিয়ে এক দফা দাবিতে অনড় রয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সরকারের প্রধান কে হবেন—এমন সব বিতর্কই মুখ্য হিসেবে কাজ করছে।
বিএনপি মনে করছে, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনকে তারা প্রতিহত করবে এবং সেটি কোনোভাবেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যদিও আওয়ামী লীগ চায় বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচন করতে। তবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না কিংবা বিএনপি সেই নির্বাচনকে প্রতিহত করতে পারবে কি না—সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বিএনপির দাবি না মেনে তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনে গেলে, পরবর্তী সময়ে বিএনপি তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জে টিকতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায়, বিএনপি আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে খুব বেশি চাপে ফেলতে পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বর্তমানে বেশ শক্তিশালী।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা, বজায় রাখা এবং ভোটারের নিরাপত্তা বিধান করা নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও কমিশনের ওপর বর্তাবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।
সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই জনগণের কাছে কাম্য। কোনো সংঘাত কিংবা সহিংসতার পথকে হাতছানি না দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখলেই দেশের মানুষ শান্তি পাবে এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নেবে। এ দায়িত্ব সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়েরই। তবে রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে মনে রাখতে হবে নির্বাচনই গণতন্ত্রের শেষ কথা নয়, এটি গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি মাত্র। কাজেই ভিত্তিপ্রস্তর মজবুতভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সবাইকে সচেতন হতে হবে।