দেশে নতুন জঙ্গি সংগঠনের আমির আনিসুর গ্রেপ্তার

Published: 24 July 2023

বিশেষ সংবাদদাতা :


নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফীল হিন্দাল শারক্বীয়া’-এর আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদসহ সংগঠনের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গতকাল রবিবার (২৩ জুলাই) দিবাগত রাতে দেশী-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদি পুস্তিকা ও নগদ অর্থসহ মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাবের একটি দল।

আজ সোমবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হয়।

র‍্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং-এর পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফীল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমীর মো. আনিসুর রহমান মাহমুদসহ তিন সদস্যকে দেশী-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদি পুস্তিকা ও নগদ অর্থসহ মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

গত ২৩ আগস্ট ২ কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আটজন তরুণ নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ঘটনায় তরুণদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। গণমাধ্যমসমূহে বহুলভাবে আলোচিত নিখোঁজের এই ঘটনা দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এর প্রেক্ষিতে র‌্যাব ফোর্সেস নিখোঁজদের উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে র‌্যাব “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” নামক একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় থাকার তথ্য পায়। র‌্যাব জানতে পারে যে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।

সম্প্রতি র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা জানতে পারে, এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের আমীর মো. আনিসুর রহমান মাহমুদ সংগঠনের কয়েকজন সদস্যসহ মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকায় একটি বাড়িতে আত্মগোপনে রয়েছে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল রাত তিনটার দিকে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ এর একটি আভিযানিক দল মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে।

অভিযানে সংগঠনটির আমীর মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ (৩২) ও তার দুই সহযোগী কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ (৩৪) ও মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলিকে (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদি পুস্তিকা ও নগদ অর্থ।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’-এর আমীর ছিলেন। তিনি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের একটি সিএনজি রিফুয়েলিং পাম্পে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন।

তিনি ইতোপূর্বে হুজি’র সদস্য ছিলেন।

পরবর্তীতে তার সঙ্গে কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে আনসার আল ইসলামের রক্সি ও ফেলানীর পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তারা যাত্রাবাড়ীতে একটি মিটিং করে নতুন একটি সংগঠন তৈরি ও বিস্তারের পরিকল্পনা করে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র কার্যক্রম শুরু করে।
তিনি কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় উক্ত সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। সে ২০১৬ সাল পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ২০২০ সালে বান্দরবানের গহীন এলাকায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে যান।
বান্দরবানে আসলাম নামক এক ব্যক্তির নিকট প্রায় ০১ মাস সামরিক বিভিন্ন কৌশল, অস্ত্র চালনা, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাসহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি কুমিল্লার প্রতাপপুরে তার বাড়িসহ জমি এক ব্যক্তির নিকট ৫০ লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি করে দেন এবং জমি বিক্রির কিছু টাকা সংগঠনে প্রদান করেন।

অবশিষ্ট টাকা দিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সাড়ে ০৩ বিঘা জমি ক্রয় করে ঐ বছরই সেখানে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং পোল্ট্রি ফার্ম, চাষাবাদ ও গবাদি পশুর খামার পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়।

গ্রেপ্তারকৃত আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদকে জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’-এর পূর্বের আমীর ছিল মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালে রক্সি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হলে সংগঠনের অন্যান্য সূরা সদস্য ও সদস্যদের সিদ্ধান্তে মাহমুদকে আমীর হিসেবে নির্বাচন করা হয়।

পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানের সময় তার সঙ্গে ‘কেএনএফ’ সদস্যদের পরিচয় হয় এবং ‘কেএনএফ’ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুং এর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে ‘কেএনএফ’ এর ছত্রছায়ায় বান্দরবানের গহীন পাহাড়ে জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে তাদের মধ্যে চুক্তি হয়।

চুক্তি অনুযায়ী কেএনএফ ২০২৩ সাল পর্যন্ত জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করবে এবং প্রতিমাসে ‘কেএনএফ’ সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও খাবার খরচ বাবদ ৩-৪ লক্ষ টাকা বহন করা হতো। আমীর মাহমুদের নির্দেশনায় দেশে এবং দেশের বাহিরে থেকে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হতো।
সংগ্রহকৃত অর্থ দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের খরচ ও সারাদেশে অন্যান্য সাংগঠনিক কাজের জন্য অর্থ প্রদান করা হতো। এছাড়াও, তার নির্দেশনায় ‘কেএনএফ’ থেকে ১৭ লক্ষ টাকার বিভিন্ন ধরণের ভারী অস্ত্র ও বিদেশি অগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় করা হয় যা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

আমীর মাহমুদের নির্দেশনায় ‘কেএনএফ’ প্রধান নাথান বমকে রাজধানীর বাসাবো এলাকায় সংগঠনের অর্থায়নে একটি বাসা ভাড়া করে দেওয়া হয় যেখানে নাথাম বম পরিবারসহ মাঝে মধ্যে অবস্থান করত।
তার নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে আনসার হাউজ তৈরি এবং পরিচালিত হতো। ভুল ঝুঝিয়ে কিছু সদস্যকে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে নিয়ে যায় এবং প্রশিক্ষণ চলাকালীন তারা প্রশিক্ষণ করতে অসম্মতি জানায় ও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আমীর মাহমুদের নির্দেশনায় তাদেরকে শাস্তিস্বরূপ নিজস্ব তৈরী জেলখানায় বন্দি করে রাখা হয়। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণরত সদস্যদের কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বা বিদ্রোহ করলে গুলি করে হত্যা করার ঘোষণা দেয় গ্রেপ্তারকৃত মাহমুদ।

গ্রেপ্তারকৃত আমীর মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সুসর্ম্পক ছিল। শীর্ষ জঙ্গি মেজর জিয়ার সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ২০২২ সালে কিশোরগঞ্জে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে একটি মিটিং এ আমীর মাহমুদ ও আনসার আল ইসলামের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত ও আনসার আল ইসলাম আমীর মাহমুদকে ১৫ লক্ষ টাকা প্রদান করে এবং পরবর্তীতে আরো টাকা প্রদান করবে বলে জানা যায়। চুক্তি অনুযায়ী জামাতুল আনসারের সদস্যদের আনসার আল ইসলাম আইটি ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করবে।