ফ্রান্সের নির্বাচনের ফলাফলে স্বস্তি প্রকাশ করেছে ইউরোপ ও বিশ্বের গণতান্ত্রিক অংশীদারেরা
পোস্ট ডেস্ক :
ফ্রান্সের নির্বাচনের ফলাফলে উগ্র ডানপন্থীদের পরাজয়ে স্বস্তিতে ইইউ এবং ন্যাটোসহ ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক অংশীদারেরা। রোববার (৭ জুলাই) অনুষ্ঠিত হয় ফরাসি আইনসভার নিম্নকক্ষ বা অ্যাসেম্বলি ন্যাশনালের দ্বিতীয় দফার নির্বাচন। এর আগে ৩০ জুন প্রথম দফা নির্বাচন শেষে এগিয়ে ছিল মারি লা পেনের অভিবাসীবিরোধী দল ন্যাশনাল ব়্যালি।
দলটি ক্ষমতায় আসতে পারে এমন সম্ভাবনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো এবং বিশ্বব্যাপী উদার গণতান্ত্রিক মহলে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কারণ ফ্রান্স জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি।
৩০ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম দফার ভোটে সবচেয়ে বেশি ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত মারি লা পেনের দল ন্যাশনাল র্যালি (এনআর)। বর্ণবাদ ও ইহুদিবিদ্বেষী ইতিহাসের কারণে এনআর-কে দীর্ঘ সময় ধরে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ফ্রান্সের জনগণের বড় একটি অংশ। তবে সম্প্রতি দলটির সমর্থন বেড়ে যায়। এর পেছনে কাজ করেছে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও অভিবাসন নিয়ে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর প্রতি ভোটারদের ক্ষোভ।
গত রোববার দেশটিতে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ শেষে বুথফেরত জরিপে বলা হচ্ছে, ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ৫৭৭টি আসন আছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, নির্বাচনে এনএফপি পেয়েছে ১৮২ আসন, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের মধ্যপন্থী জোট এনসেম্বল পেয়েছে ১৬৮ আসন, উগ্র ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালি (এনআর) পেয়েছে ১৪৩ আসন।
স্পেনের সোশ্যালিস্ট প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ নির্বাচনে অতি ডান প্রত্যাখ্যাত হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন।
স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সের আইনসভা নির্বাচন এবং যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে একই চোখে দেখছেন। তিনি বলেন, “এই সপ্তাহে ইউরোপের বৃহত্তম দুটি দেশ অতি ডানপন্থীদের প্রত্যাখ্যান করে স্পেনের মতো একই পথ বেছে নিয়েছে।
এক বছর আগে স্পেনও অতি ডানদের প্রত্যাখ্যান করে সোশ্যালিস্ট ও বামেদের প্রতি আস্থা রেখেছিল।
তিনি নিজের এক্স প্ল্যাটফর্মে লেখেন, “কট্টর ডানদের সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সরকার হতে পারে না।
এর আগে তার দল স্প্যানিশ সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি (পিএসওই) নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে এনএফপি জোট এবং বিশেষ করে তাদের একই আদর্শের ফরাসি সোশ্যালিস্ট পার্টিকে (পিএস)
অভিনন্দন বার্তায় জানায়, “এই মহান বিজয় যা উগ্র ডানপন্থীদের সরকারে প্রবেশ আটকে দেয়।”
অর্থনীতি ও মুদ্রা বিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার পাওলো জেন্টিলোনি বলেন, “ফরাসি প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক৷”
পোল্যান্ডের নতুন নির্বাচিত ইউরোপপন্থী প্রধানমন্ত্রী ডনাল্ড টাস্ক বলেছেন, ফ্রান্সের এমন ফলাফলে তিনি ‘খুশি’।
ডনাল্ড টাস্ক ইউরোপীয় কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি। তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধে ইউরোপীয় প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ফ্রান্সের পূর্বের নীতি অব্যাহত থাকার সংবাদে স্বাগত জানিয়েছেন। এনআর ক্ষমতায় এলে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ছিল। দলটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
এই ইউ নেতা তার এক্স সাবেক (টুইটার) অ্যাকাউন্টে লিখেন, “প্যারিস খুশি এবং মস্কোর হতাশ৷ এই ঘটনায় ওয়ারশ বেশ খুশি।
লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ফরাসি নির্বাচনকে ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ আখ্যা দিয়ে বামেদের জোটকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “ এই গুরুত্বপূর্ণ দিনের জন্য ফরাসি জনগণ এবং সামাজিক আন্দোলনগুলিকেও অভিনন্দন জানাই। এটা ঐক্যকে এবং শান্তিকে শক্তিশালী করে তুলেছে। গ্রিসের প্রধান বামপন্থী বিরোধী দল সিরিজার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন স্টেফানোস কাসেলাকিস। ফ্রান্সে রোববারের নির্বাচনের ফলাফল শেষে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “আজ ফরাসি জনগণ আমাদের পথ দেখিয়েছে। পরিবর্তন কোনো ‘ইউটোপিয়া’ নয় বরং তা বাস্তব, ফরাসি জনগণ সেটা দেখিয়ে দিয়েছে।
ব্রাজিলের ক্ষমতায় ফিরেছেন আলোচিত বাম প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা ওরফে লুলা। তিনি রোববার এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “ফ্রান্সের এই ফলাফল দক্ষিণ আমেরিকার জন্য অনুপ্রেরণা। ফ্রান্সের রাজনৈতিক শক্তির মহানুভবতা এবং চরমপন্থার বিরোধিতা দেখে আমি অত্যন্ত খুশি। এই বাম নেতা মনে করেন, চলতি সপ্তাহে ফ্রান্স এবং বৃটেনের ফলাফল গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়বিচার রক্ষার জন্য কাজ করা প্রগতিশীল দলগুলোর মধ্যে সংলাপের গুরুত্বকে শক্তিশালী করবে।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এসপিডি) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য নিলস স্মিড বলেছেন, “সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিস্থিতি এড়ানো গেছে। এই রাজনীতিবিদ জার্মান সংসদে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্লামেন্টারি গ্রুপের বিদেশ নীতি বিষয়ক প্রধান। তিনি আরো বলেন, “এনআর সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট মাক্রন ‘রাজনৈতিকভাবে দুর্বল’ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু, অনিশ্চিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপন্থীরা তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে।”
নিলস স্মিডট ফরাসি গণতান্ত্রিক দলগুলোকে ‘নমনীয়তা’ এবং ‘সমঝোতার ক্ষমতা’ প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছেন। এ দিকে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোটে বামপন্থী দলগুলোর সবচেয়ে বেশি আসন পেতে যাওয়ার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ফ্রান্সের সাধারণ জনগণ। ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দ ফিলিপসহ কয়েকজন মধ্যপন্থী নেতা বলেছেন, স্থিতিশীল সরকার গড়ে তুলতে একটি চুক্তির ব্যাপারে কাজ করার জন্য তারা প্রস্তুত আছেন।
ফ্রান্সের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আতাল বলেছেন, তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। তবে নতুন সরকার গঠনসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের কথা মাথায় রেখে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন তা এখনই গ্রহণ করবেন কি না, নিশ্চিত নয়। অবশ্য গ্যাব্রিয়েল আতাল বলেছেন যে, তিনি তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় থাকবেন।