স্কুল গভর্নিং কমিটি নির্বাচন, সিন্ডিকেট ও গণতন্ত্রের তন্ত্র মন্ত্রে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বখাটেদের দখলে
নজরুল ইসলাম
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় মেধাবী নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের সাফল্য অর্জনে প্রতিষ্ঠানে যথাযথ নেতৃত্বের ভুমিকা অপরিহার্য। একজন পেশাদার দক্ষ নেতৃত্বদানকারী প্রধান শিক্ষক কিংবা অধ্যক্ষের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটে। দক্ষ নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি অনন্য প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে পারে। যিনি প্রধান শিক্ষক বা প্রশাসক তাঁর নেতৃত্বের উপরই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে।
আজকের আলোচ্য বিষয় স্কুল গভর্নিং বডি বা পরিচালনা পর্ষদ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পুঁজি করে কিছু লোক দেশব্যাপী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্কুল কলেজের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে উক্ত পদ তাদের রুটি-রুজিরর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাহারা এই পদে বছরের পর বছর বহাল তবিয়তে না থাকতে পারলেই মামলা-মোকদ্দমা হুমকি ধামকি রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা।
নতুন বিনিমালার আলোকেও শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির বিরোদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এতে করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সমাজের গণমান্য ব্যক্তিবর্গ ও শিক্ষানুরাগীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সারাদেশ জুড়ে এই চিত্র ভয়াবহ। বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য সোর্স থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ স্টাডি করার পর আমার কাছে যে বিশৃঙ্খলার চিত্র ফুটে উঠেছে এতে দেখা যাচ্ছে, নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির তফসিল ঘোষণায় অভিভাবকদের নিয়ে কোনো আলোচনা বা সভা করা হচ্ছে না। প্রধান শিক্ষক তার পছন্দের লোকজন কমিটিতে নেওয়ার জন্য গোপনীয়ভাবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছেন। ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক উৎসাহী অভিভাবকরা নিজেদের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারছেন না। সারা দেশজুড়ে অভিযোগের ধরন একই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কমিটি থাকলেও কার্যত এখন এই ধরনের কমিটির কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। পরিচালনা কমিটির নামে ক্ষেত্রবিশেষে এখন কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এই কমিটিকে তাদের আয়ের অন্যতম উৎস মনে করেন। অনেক ক্ষেত্রে এই কমিটিকে স্থানীয় বখাটে প্রভাবশালীদের সামাজিক মর্যাদা অর্জনের ক্ষেত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সিন্ডিকেট করে কমিটি জবর দখল করা হচ্ছে। সমাজের শিক্ষিত যোগ্যতাসম্পূর্ণ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষানুরাগী শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন নিয়ে যারা ভাবেন বখাটেদের তাণ্ডবে তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন।
কথায় আছে “চোরে চোরে হালি এক চোরে বিয়া করে আরেক চোরের হালি ” সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মনোনীত একটি স্কুলের সভাপতি পার্শ্ববর্তী স্কুলে তার গোত্র- সহকর্মীকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সভাপতি করতে মারিয়া হয়ে ওঠেন। পেছন থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে এলাকার সকল মূর্খ লোকদের একত্রিত করে স্কুল পরিচালনা করাতে সহায়তা করেন। সমাজের ভালো লোক , শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষানুরাগী এমন লোকেরা সামগ্রিক অবস্থা উপলব্ধি করে অপমানিতবোধ করেন। ম্যানেজিং কমিটি-গভর্নিং বডির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নানামুখী ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের কমিটির কোনো প্রয়োজন আছে কি? স্টাডি থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা সরকারের কাছ থেকে কোনো বেতন পেতেন না। পরবর্তী সময়ে এমপিওভুক্তির মাধ্যমে তারা ৪০ বা ৫০ শতাংশ বেতন সরকার থেকে পাওয়া শুরু করেন। ২০০৪ সাল থেকে শতভাগ বেতন দিচ্ছে সরকার। শুধু বেতন-ভাতাই নয়, প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের খরচই বহন করে সরকার। শিক্ষার্থীদের বই থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চসহ সব আসবাবপত্র, শিক্ষা উপকরণ, নতুন ভবন তৈরি, ভবন সংস্কার, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের খরচ সবই বহন করে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বড় অংশটিই ব্যয় হয় এসব খাতে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে সিন্ডিকেট চক্র স্থানীয়ভাবে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজস্ব উত্স ব্যবহার করে অনেক অর্থ আয় করে, যা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক-কর্মচারী ও পরিচালনা কমিটির মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, একটা সময় সরকার যখন পুরো বেতন-ভাতা দিত না তখন শিক্ষকদের বেতনের টাকা সংগ্রহ করে দেবার জন্য কমিটির দরকার ছিল। এখন আর এর দরকার কী? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের কমিটির আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা শিক্ষানুরাগীরা ভাবছেন। তারা মনে করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সক্ষমতা আছে। ম্যানেজিং কমিটি-গভর্নিং বডির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নানামুখী ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। সময় এসেছে নতুন করে ভাবার।
স্কুল পরিচালনা বিধিমালা অনুযায়ী ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির দায়িত্ব পালনে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে: প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি, ভবন, খেলার মাঠ, বই, ল্যাবরেটরি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠানের তহবিল সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা। আর্থিক অনুদান সংগ্রহ, শিক্ষক নিয়োগ, সাময়িক বরখাস্ত ও অপসারণ, বার্ষিক বাজেট অনুমোদন ও উন্নয়ন বাজেট অনুমোদন, ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের আবেদন মঞ্জুরি, ছুটির তালিকা অনুমোদন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত স্থান সংকুলান ও স্টাফদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন ধরনের আর্থিক তহবিল গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণ, স্কুলের সম্পত্তির কাস্টোডিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে প্রদান নিশ্চিত করা এবং শিক্ষকদের নিয়ে প্রি-সেশন সম্মেলনের ব্যবস্থা করা।
সারা দেশ জুড়ে অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে অধিকাংশ পরিচালনা পর্ষদই এসব কাজের একটিও করে না। বরং প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে বিভিন্ন নামে টাকা লুটপাট করে তহবিল শূন্য করার শত শত অভিযোগ উদাহরণ প্রিন্ট মিডিয়ায়। সংস্কারের কোনো কাজ না করেই টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা মামলা মোকাদ্দমা কোর্ট কাচারিতে গড়িয়েছে। হতাশার ব্যাপার হচ্ছে, স্কুল পরিচালনা কমিটির নতুন বিধিমালা দিয়েও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কমিটি গঠন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি উপজেলায়ই শিক্ষা অফিস আছে। সরকারি স্কুলে ডিসির নেতৃত্বে মনিটরিং কমিটি আছে। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সময়ের দাবি।
আমি নতুন নির্দেশিকা সম্পর্কে কৌতুহলী ছিলাম। সংক্ষিপ্ত অধ্যয়ন করেছি এবং এটি সম্পর্কে কিছুটা জানতে পেরেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নতুন জারি করা বিধিমালায় গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির ওপর শিক্ষা বোর্ডের কর্তৃত্ব অনেক বেশি রাখা হয়েছে। কমিটির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও স্বার্থহানির প্রমাণ মিললে কারণ দর্শানো ছাড়াই এই কমিটি ভেঙে দিতে পারবে শিক্ষা বোর্ড, যা আগের বিধিমালায় ছিল না। এছাড়া ভর্তি, অতিরিক্ত ভর্তি, ফরম পূরণ এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে এবং প্রতিষ্ঠানের অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে গুণগত শিক্ষাদানে অন্তরায় মনে হলেও বিশেষ কমিটি গঠন করতে পারবে। বোর্ড প্রয়োজন মনে করলে বিশেষ পরিস্থিতিতে কমিটি দুই বছরের জন্য গঠন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা বোর্ড, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, নির্বাহী কমিটি, অ্যাডহক কমিটি বা বিশেষ পরিস্থিতি কমিটির যে কোনো বিষয় অনুসন্ধান করিতে কিংবা কোনো অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করিতে এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র তলব করতে পারবে। এই প্রবিধানমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন, সরকার বা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক জারিকৃত কোনো নির্দেশনা অমান্যকরণ, অদক্ষতা, আর্থিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি বা অনুরূপ অন্য কোনো কারণ প্রমাণ হলে শিক্ষা বোর্ড যে কোনো সময় গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, নির্বাহী কমিটি, অ্যাডহক কমিটি বা বিশেষ পরিস্থিতি কমিটি বাতিল করতে পারবে। এছাড়া সভাপতির বা কোনো সদস্যের কোনো কর্মকাণ্ড বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিংবা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ পরিপন্থি হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বা দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের আবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বা সংশ্লিষ্ট কমিটির কোনো সদস্য শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রাখা হয়েছে নতুন বিধিমালায়।সম্প্রতি এই বিধিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নতুন বিধিমালায় আরো উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান বিধিমালায় সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে এইচএসসি উত্তীর্ণ। আগে এই পদে কোনো যোগ্যতা নির্ধারিত ছিল না। বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি একই প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে পরপর দুই বারের বেশি সভাপতি, শিক্ষক প্রতিনিধি বা অভিভাবক প্রতিনিধি হতে পারবেন না। তবে এক মেয়াদ বিরতি দিয়ে পুনরায় নির্বাচন করতে পারবেন। এক জন ব্যক্তি দুটি কলেজের গভর্নিং বডি এবং দুটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিসহ মোট চারটির বেশি পদে সভাপতি থাকতে পারবেন না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক এমন একটি চমৎকার বিধিমালা update করার পরেও দেশ জুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন প্রক্রিয়াই যেন “যেই লাউ সেই কদু , শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারই সব ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকে। এ কারণে গভর্নিং বডির প্রভাব কমিয়ে শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা প্রশাসনের হাতে আরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়া উচিত।
নজরুল ইসলাম ,জার্নালিস্ট, প্রধান সম্পাদক- দা সিলেট পোস্ট ডট কম, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস NHS ইউ কে।