বড় হোক আমাদের জীবন

Published: 25 December 2024

রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী

বড়দিন ঈশ্বরের মন ও তাঁর বাণীর মানসে মূর্ত হওয়ার কথা বলে। ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি তাঁর প্রেমকে পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রকাশ করেছেন। যুগে যুগে ঈশ্বরের সেই প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক খ্রিস্টভক্ত খ্রিস্টীয় আদর্শ ও মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে মানবসেবার ক্ষেত্রে অনেক যুগান্তকারী কাজ করেছেন। যিশুর প্রচার ও কাজের মূল বিষয় মানব সমাজে ঈশ্বরের শান্তি ও ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠা।

এক ঐতিহাসিক ঘটনার কথা মনে পড়ে। ৩৯১ খ্রিস্টাব্দের কোনো একদিন। রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের এক সন্ন্যাসী। নাম তারা টেলেমাখুস।

প্রাত্যহিক ধ্যান-প্রার্থনায় মগ্ন তিনি। হঠাৎ এক অলৌকিক দর্শন তিনি পেলেন। দর্শনে যিশুখ্রিস্ট তাঁকে বলে গেলেন, ‘টেলেমাখুস! তুমি শিগগিরই রোমে চলে যাও। সেখানে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
’ প্রার্থনা শেষে টেলেমাখুস হেঁটে চললেন রোমের দিকে। রোমের রাজপথ সেদিন লোকে লোকারণ্য। পথ চলতে চলতে টেলেমাখুস জানতে পারলেন নগরের কলসিয়ামে আজ গ্লাডিয়েটরদের যুদ্ধ। ওই যুদ্ধের শেষ পরিণতি যে কী বীভৎস টেলেমাখুস তা অনেকবার শুনেছেন। তিনি জানতেন সম্রাটের ইঙ্গিতে কী নৃশংসতায়ই না বিজয়ী যোদ্ধা তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করে; আর তা দেখে কলসিয়ামের দর্শকরা পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে।
টেলেমাখুসের বুঝতে দেরি হলো না রোমে তাঁকে আজ কোন কাজটি করতে হবে!
হাজার হাজার রোমবাসী কলসিয়ামে উপস্থিত হয়ে অপেক্ষায় রয়েছে সেই যুদ্ধ দেখার জন্য। কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক সেখানে উপস্থিত। এ পর্যন্ত কেউ সেই বিকৃত রুচির পৈশাচিক খেলার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জানাতে সাহস দেখায়নি। ‘হ্যাঁ, আজ আমি, আমিই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব। জীবন দিয়ে হলেও আমি তা করব’—মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করতে করতে ভিড়ের মধ্যে স্থান করে নিলেন টেলেমাখুস। সময়মতোই শুরু হলো যুদ্ধ। কিছুক্ষণ পরে দুই যোদ্ধার একজন মাটিতে পড়ে গেল। এবার প্রথামাফিক সম্রাটের নির্দেশ পেয়ে বিজয়ী যোদ্ধা পরাজিতকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্য থেকে বের হয়ে এলেন টেলেমাখুস। তিনি জোরে চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘তোমার তরবারি রাখো।’ কিন্তু এদিকে গ্যালারি থেকে কিছু দর্শক টেলেমাখুসকে দেখিয়ে তাদের বিজয়ী বীরের প্রতি চিৎকার করে বলল, ‘আগে ওকেই শেষ করো! একেবারে দুই ভাগ করে ফেলো ওর দেহকে!’ মুহূর্তের ভেতর টেলেমাখুসের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল; তাঁর তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল জায়গাটা। কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যেই দেখা গেল অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। পিনপতন এক নীরবতায় ছেয়ে গেল কলসিয়াম। আর গভীর এক আত্মধিক্কার ও লজ্জায় এক এক করে আসন ছেড়ে বের হয়ে গেল সব দর্শক। ইতিহাস বলে ওই ঘটনার পরে সম্রাট অনরিয়ুস আইন করে বন্ধ করে দেন রোমের সেই পৈশাচিক যুদ্ধ খেলা। এক বর্বরতার বিরুদ্ধে টেলেমাখুস সেদিন সরব ও সক্রিয় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, আর সমাজে এনেছিলেন বড় এক ইতিবাচক পরিবর্তন ও সংস্কার। সমাজের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন তিনি দিয়েছিলেন। এর চেয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় দান আর কিছু ছিল না।

পবিত্র বাইবেলে পুরনো নিয়মে মানুষের জন্য ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ আজ্ঞা—‘ঈশ্বরকে সম্মান করো, ও অন্য মানুষকে নিজের মতোই প্রেম করো।’ যিশুখ্রিষ্ট সেই আজ্ঞাকে সম্পূর্ণরূপে পালন করার মাধ্যমেই ঈশ্বরের প্রেম ও ন্যায্যতার বাণী প্রচার করেছেন। নিজের সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক ও নিষ্পাপ জীবন তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন পাপী মানুষের আত্মিক ও সামগ্রিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্য। সভ্যতার উষাকাল থেকেই মানুষে মানুষে হিংসা ও হানাহানি। আজ আবার তার মাত্রা ও তা চরিতার্থ করার কৌশলও মানুষ বাড়িয়েছে অনেক। অশান্তি ও স্বার্থপরতায় উন্মত্ত পৃথিবী। পাপী মানুষকে প্রেম করেন বলেই পরমেশ্বর নিজ পুত্রকে তাঁর মঙ্গলের জন্য দান করেছেন। আমরা যদি ঈশ্বরের সন্তান বলে বিশ্বাস করি, তাহলে আমাদের কাছে তিনি চান যেন অন্যের কল্যাণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত না হই।

খ্রিস্ট তাঁর কথায় ও কাজে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পদমর্যাদাভেদে সব মানুষকে সমান চোখে দেখেছেন। সব মানুষের মধ্যে তিনি দেখেছেন স্রষ্টার প্রতিমূর্তি ও সাদৃশ্য। যেখানেই মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় সেখানেই সেই প্রতিমূর্তি হয় চূর্ণ-বিচূর্ণ। তা সে যে কারণেই হোক না কেন—ধর্মের নামে হোক, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, গোত্রীয় বা যে কোন কারণেই হোক। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে এই একাত্মতা, আছে ভালোবাসা দেওয়ার ও পাওয়ার কর্তব্য এবং দাবিও। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজ তাদের ন্যায্য মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। সাম্প্রদায়িকতা, আর্থ-সামাজিক, জাতি ও বর্ণগত বিভিন্নতার কারণে মানুষে মানুষে কতই না দ্বন্দ্ব-বিভেদ!

কালজয়ী ভাস্কর ও চিত্রকর মাইকেলেঞ্জেলো একদিন বড় এক পাথরখণ্ডের ওপরে হাতুড়-বাটালি নিয়ে কাজ করছিলেন, এমন সময় কোনো একজন লোক এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কেমন করে এসব পাথর কেটে সুন্দর সুন্দর মূর্তি তৈরি করেন?’ মাইকেলেঞ্জেলো ওই লোকটিকে তাঁর উত্তরে বললেন, ‘পাথরটির ভেতরে এক দেবদূত আটকা পড়ে আছেন। ওই দূতের অংশ নয় এমন সব কিছু আমি খুদে বের করে ফেলে দিই।

বড়দিন মনকে, জীবনকে বড় করার দিন। প্রেমের অবতার খ্রিস্ট আজ আমাদের তাঁর চিরায়ত আহবানটিই দেন যেন আমরা আমাদের পাষানতুল্য কঠিন হৃদয় থেকে হিংসা ও স্বার্থপরতাকে ত্যাগ করে অন্যের জন্য ভালোবাসার মানুষ হয়ে উঠি।