যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজ কী?
ডাঃ ওয়াজেদ খান
আসছে ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমালা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের সাথে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আটকে আছে ইলেক্টোরাল কলেজ গ্যাঁড়াকলে। কোনো ক্যাম্পাস নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ভবন নেই। নেই কোনো শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। তারপরও এর নাম ইলেক্টোরাল কলেজ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিশ্বের একমাত্র ও অভিনব পদ্ধতি এটি। অনেকটা শাখের করাতের মতো দু’দিকে কাটে। এই কলেজের কারণে ২০১৬ সালে ৩০ লাখ পপুলার পেয়েও ট্রাম্পের কাছে হেরে যান হিলারি ক্লিনটন। আবার এই পদ্ধতি না থাকলে শুধুমাত্র ১০টি বড় শহরের ভোটেই নির্বাচিত হতে পারেন গোটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাই এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আমেরিকানরা কি আসলেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেন? এক কথায় বলতে গেলে না। ভোটাররা আপাতঃ দৃষ্টিতে যদি মনে করে থাকেন যে, তারা তাদের পছন্দনীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন আসলে তা ঠিক নয়। তারা ভোট দেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রতি প্রতিশ্রুত ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যদেরকে। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি সত্যিকারার্থেই একটি জটিল প্রক্রিয়া। যা দুর্বোধ্য সাধারণ ভোটারদের নিকট। নির্বাচনের ব্যালট নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ভোটাররা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পরিবর্তে ইলেক্টোরাল কলেজের একদল লোককে বেছে নিচ্ছে তাদের প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে।
আমেরিকায় মোট ইলেক্টোরেটের সংখ্যা ৫৩৮। তন্মধ্যে ৫০টি অঙ্গরাজ্য থেকে মোট ৫৩৫ জন এবং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ৩ জন। প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে কংগ্রেসের হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ সদস্য সংখ্যা সম এবং নির্দিষ্ট সিনেট সদস্য সংখ্যার সমান ইলেক্টোরেট বাছাই করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে নির্দিষ্ট ২ জন সিনেটর এবং ২৭ জন রিপ্রেজেনটেটিভ রয়েছে, সে হিসেব অনুযায়ী নিউইয়র্কের ইলেক্টোরাল ভোটারের সংখ্যা ২৯ জন। মোট ৫৩৮ জন ইলেক্টোরাল এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যিনি ২৭০ ভোট পাবেন তিনিই হবেন বিজয়ী। ২৩৫ বছর যাবত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই পদ্ধতি চলে আসছে। এ নিয়ে বিতর্কও হচ্ছে অনেক। কারো কারো মতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য এটি একটি বাজে পদ্ধতি। এই পদ্ধতির কারণে অনেক ভোটারই ভোট প্রয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
৪৮টি অঙ্গরাজ্যে ইলেক্টোরাল কলেজ একই পদ্ধতিতে কাজ করলেও মেইন ও নেব্রাক্সা রাজ্যে এই প্রক্রিয়া ভিন্নতর। সিংহভাগ আমেরিকান এই পদ্ধতি পছন্দ না করলেও বিশালকায় এই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার প্রধান অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে শুরুতেই ঝামেলা দেখা দেয়। আমেরিকার স্থপতি ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন তৎকালীন আমেরিকার মাত্র ১৩টি ছোট-বড়, দুর্বল ও শক্তিশালী রাজ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি বেছে নিতে বাধ্য হন। ১৭৮৭ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লেখা হচ্ছিল তখন বিশালাকার দেশটিতে যোগাযোগের অভাবের ফলে জাতীয় স্তরে সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। সংবিধান রচয়িতারা তখন ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাদের যুক্তি ছিল, পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লোকেরা তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করে কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই পদ্ধতির পক্ষ নেয় কারণ সেসময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিলো অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকা সত্ত্বেও আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হতো। অবশেষে সাংবিধানিক কনভেনশনের প্রস্তাবে ইলেক্টোরাল কলেজ তথা পরোক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার পদ্ধতি স্বীকৃত হয়। রোমান ক্যাথলিক চার্চে ‘কলেজ অব কার্ডিনালস কর্তৃক পোপ নির্বাচনের আদলেই মূলত ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির উদ্ভাবন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই পদ্ধতিকে পরিবর্ধন ও পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিটি রাজ্য নিজস্ব সংবিধান মোতাবেক ইলেক্টোরাল কলেজ নির্বাচিত করে। কোনো কংগ্রেস সদস্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা ইলেক্টোরেট হতে পারেন না।
রাজনৈতিক দলগুলো এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীগণ প্রতিটি রাজ্যের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর তাদের নিজ দলের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের একটি করে তালিকা পাঠান ইলেক্টোরাল কলেজের জন্য। দলগুলোর জাতীয় কনভেনশনেই সাধারণতঃ তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি না হলে আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ১০টি রাজ্যের প্রধান শহরগুলোর পপুলার ভোটেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির সুবিধাগুলো হলো ছোট অঙ্গরাজ্যগুলো প্রার্থীদের কাছে গুরুত্ব পায়। প্রার্থীদের গোটা দেশ ঘোরার দরকার হয় না, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতি নজর দিলেই চলে। পুনর্গণনা সহজতর, কারণ কর্মকর্তারা একটি অঙ্গরাজ্যের সমস্যা সহজে চিহ্নিত করতে পারেন। অসুবিধা হলো সাধারণ মানুষের ভোটে জয়ী প্রার্থীও নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন। ভোটারদের একাংশের মনে হয় যে, তাদের ব্যক্তিগত ভোটের কোনও মূল্য নেই। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মঙ্গলবারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় বুধবারের পরের সোমবার প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীতে ইলেক্টোরগণ মিলিত হয়ে প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে ভোট দেন।
সেখান থেকে তাদের প্রদানকৃত ভোট সীলগালা করে সিনেটের প্রেসিডেন্টের নিকট পাঠানো হয়। পরবর্তী বছরের ৬ জানুয়ারী ইউএস সিনেট ও কংগ্রেসের উভয় হাউসের সম্মিলিত অধিবেশনে ৫০টি রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট গণনা করে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করা হয়। মোট ইলেক্টোরাল ভোট ৫৩৮ এর মধ্যে যিনি অর্ধেকের চেয়ে একটি ভোট বেশী অর্থাৎ ২৭০টি ভোট পাবেন তিনিই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রেসিডেন্ট হবেন। কখনো কোনো প্রার্থী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সেক্ষেত্রে প্রতি রাজ্য থেকে একজন করে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ শীর্ষ তিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে একজনকে নির্বাচিত করবেন এবং এক্ষেত্রেও সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের সমর্থন প্রয়োজন।
১৮২৪, ১৯৪৮ ও ১৯৬৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করায় তা হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে যায়। ভাইস প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে ইউএস সিনেট প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে একজনকে নির্বাচিত করেন। এখানে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট একই দল থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এটি এক ধরনের প্যাকেজ ডিল। ২০ জানুয়ারি বিকেলে প্রথা অনুযায়ী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রায় ২০ হাজার অতিথির উপস্থিতিতে এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শপথ গ্রহণ করেন। পপুলার ভোট নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটার প্রদত্ত গণনাকৃত মোট ভোটকেই পপুলার ভোট বলা হয়। যে অঙ্গরাজ্যে যে দলের প্রার্থী সবচে’ বেশি ভোট পান সে রাজ্যে ইলেক্টোরেটগণ ঐ দলের হিসেবে জয়ী হন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, স্ব স্ব প্রার্থীর প্রতিশ্রুত ইলেক্টোরগণ ইচ্ছে করলে তাদের প্রার্থীকে ভোট নাও দিতে পারেন। যদিও সচরাচর এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। তারপরও ১৮৭৬-এর নির্বাচনে রাদারফোর্ড হেইস এবং ১৮৮৮-এর নির্বাচনে বেঞ্জামিন হ্যারিসন কম পপুলার ভোট পেয়ে এভাবে নির্বাচিত হন। সংখ্যাধিক্য পপুলার ভোট পেয়েও নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে প্রার্থীকে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হবে। অর্থাৎ ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি ভোট পেতে হবে। কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ পপুলার ভোট পেলেও যদি ইলেক্টোরাল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হয় তাহলে সে প্রার্থী হেরে যাবেন। ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের চেয়ে ৫ লাখ পপুলার ভোট বেশি পেয়েও আলগোর ইলেক্টোরাল ভোটে হেরে যাওয়ায় প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।