টাঙ্গুয়ার হাওরে থামছে না অতিথি পাখি শিকার

Published: 6 January 2025

বিশেষ সংবাদদাতা :


দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওরে কারেন্টের ডিভাইস, বিষটোপ, সুতার ফাঁদ, টর্চ লাইট ও কুঁচ দিয়ে অতিথি পাখি শিকার থামানো যাচ্ছে না। রাতের আঁধারে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত বিভিন্ন কৌশলে পাখি শিকার করছে। গত শুক্রবার মধ্যরাতে টাঙ্গুয়ার হাওরে কারেন্টের ডিভাইস, ফাঁদ দিয়ে বন্য প্রাণী ও অতিথি বুনোহাঁস শিকারের দায়ে দুই দুর্বৃত্তকে হাওরে নিয়োজিত থাকা আনসার ও গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্যরা আটক করে থানায় হস্তান্তর করে। আটককৃতরা হলো, উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের আল-আমিন (২৪) ও কামরুল (২০)। পরে দুই পাখি শিকারিকে আটক করে থানায় নিয়মিত মামলা দেয়া হয় এবং উদ্ধারকৃত বুনোহাঁস সবার সামনে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বংশীকুণ্ডা গ্রামের আতিকুল নামে একজনকে মৎস্য সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘনের দায়ে নিয়মিত একটি মামলা দেয়া হয়েছে।

এ ছাড়া দুর্বৃত্তরা পাখি ধরার দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে প্রচার করে গোপনে বিক্রি করছে। স্পর্শকাতর টাঙ্গুয়ার হাওরে এমন কর্মকাণ্ড চলায় হাওর থেকে অতিথি পাখি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকার জনপ্রতিনিধি ও সচেতন হাওরবাসী। জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম জলমহালগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই হাওরে মোট জলাশয়ের সংখ্যা ৫১টি। মোট আয়তন ৬,৯১২.২০ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০.০০০ একর। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা, মধ্যনগর এবং তাহিরপুর উপজেলার জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠা পানির হাওর টাঙ্গুয়া। ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল করচ শোভিত। অতিথি পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাঙ্গুয়ার মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। এ হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ রয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরকে ১৯৯৯ সালে প্ররিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালে রামসার সম্মেলনে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০০৩ সালে ইজারা প্রথা বিলুপ্ত করে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার সার্বক্ষণিক পাহারায় নিয়োজিত থাকে হাওরে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বন বিভাগ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর জরিপে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রাণ প্রকৃতি কমে যাওয়ার প্রমাণও মিলেছে। ২০২২ সালে ২৭ হাজার ১৭০টি পাখি গণনা করা হয়। এর আগে ২০২১ সালে পাখির সংখ্যা ছিল ৫৯ হাজার ৭৪টি। ২০২০ সালে ৫১ হাজার ৩৬৮টি, ২০১৯ সালে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩০টি, ২০১৮ সালে ৫৯ হাজার ৫৪২টি, ২০১৭ সালে ৯১ হাজার ২৩৬টি, ২০১৬ সালে ৪২ হাজার ৫৫৮টি এবং ২০১৫ সালে ৫২ হাজার ২৯৯টি পাখি গণনা করা হয়। পাখি গবেষক সীমান্ত দীপু জানান, জরিপ অনুযায়ী ২০২৩ ও ২০২৪ সালেও টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫০ হাজারের মতো পাখি মিলেছে। গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরেই টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি নিধন বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলী হায়দার বলেন, কয়েক ধরনের কৌশল ব্যবহার করে অতিথি পাখি শিকার করছে দুর্বৃত্তরা। নতুন করে কারেন্টের ডিভাইস, সুতা দিয়ে ফাঁদ তৈরি, শামুক বা মাছের মধ্যে বিষ মিশিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের লেচুয়ামারা, বেরবেরিয়া, রৌয়া ও হাতিরঘাতা এলাকায় ছিটিয়ে রাতের বেলা উচ্চ পাওয়ারের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে কুঁচ দিয়ে পাখি শিকার করা হচ্ছে। এ ছাড়া হাওর পাহারায় থাকা আনসারারাও এসব অপকর্মে সহায়তা করে থাকে।

হাওর পাড়ের রবিন নামে একজন বলেন, পাখি শিকার করে একদল, বিক্রি করে আরেকদল। এখন অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে পাখি। ক্রেতা-বিক্রেতার বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠালেই নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যায় অতিথি পাখি। চাঁন মিয়া নামে একজন বলেন, পাখি শিকারিরা লেঞ্জা, কালাকুরা’ পাখি তিন থেকে চার হাজার টাকা, এবং বালিহাঁসসহ অন্য পাখি বেশি দামে বিক্রি করে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের লামাগাঁও, শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের বিনোদপুর, মন্দিয়াতা, সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে এবং ধর্মপাশার উপজেলার বংশিকুণ্ডার আমানিপুর ও রংশি, উত্তর বংশিকুণ্ডা ইউনিয়নের আমতরপুরে পাখি শিকারির সংখ্যা বেশি। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আবুল হাসেম জানান, টাঙ্গুয়া হাওরে ফাঁদ দিয়ে বন্য প্রাণী-পাখি ও বুনোহাঁস শিকারের দায়ে দু’জনকে আটক করে থানায় নিয়মিত মামলা দেয়া হয়েছে। হাওরে প্রতিদিন অভিযান চালানো হচ্ছে। পাখি-বুনোহাঁস পরিযায়ী পাখি ইত্যাদি শিকার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।