হালদারের নেতৃত্বে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা লুট
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় জালিয়াতির অন্যতম নায়ক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের নেতৃত্বে বেসরকারি খাতের ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (এফএফআইএল) ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ বা লুট হয়েছে।
পিকে হালদার নিজে ও তার নিকটাত্মীয়স্বজনের নামে ও বেনামে নতুন নতুন কোম্পানি খুলে ঋণ বা লিজ নেয়ার মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাৎ করেন। ফাস ফাইন্যান্সের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে (বিএফআইইউ) দেয়া হয়েছে। তারা এ বিষয়ে আরও বিশদ তদন্ত করছে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকেও পিকে হালদারের দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে। দুদক ইতোমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকসহ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে ফাস ফাইন্যান্সের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ফাস ফাইন্যান্স থেকে মোট লিজ বা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকার ঋণ বা লিজ বেআইনিভাবে ভুয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়েছেন পিকে হালদার ও তার স্বজনরা।
এই ঋণ প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ পিকে হালদারের কাছেই প্রতিষ্ঠানটি জিম্মি হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে এই অর্থ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
একদিকে লুট হওয়ায় বেশির ভাগ ঋণ থেকে কোনো আয়ও হচ্ছে না। নতুন করে আমানতও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েছে ফাস্ট ফাইন্যান্স। এতে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন দায় পরিশোধ করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ফাস ফাইন্যান্সের এমডি প্রশিত কুমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পিকে হালদারের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে আর্থিক দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ওই টাকা আদায় করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে। আমি আশাবাদী প্রতিষ্ঠানটি অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রশান্ত কুমার হালদার নিজে ও ঘনিষ্ঠজনদের নামে-বেনামে অস্তিত্ববিহীন বিভিন্ন কোম্পানি খুলে সেগুলোর নামে শেয়ারবাজার থেকে ফাস ফাইন্যান্সের শেয়ার কিনেছেন। একই সঙ্গে সেগুলো একে অপরের নামে হস্তান্তর করেছেন। এভাবে প্রতিষ্ঠানটিতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। পিকে হালদার তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নামেও কোম্পানি খুলেছেন।
আলোচ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন প্রতিশ কুমার হালদার, সুস্মিতা সাহা, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, অমিতাভ অধিকারী, ওমর শরীফ, মৈত্রী রানী ব্যাপারী, শাহ আলম শেখ, রতন কুমার বিশ্বাস, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, অবন্তিকা বড়াল, গোপাল গাঙ্গুলী।
এদের নামে খোলা প্রতিষ্ঠানগুলো হল- হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সুখদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, আর্থস্কোপ লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, আনান কেমিক্যালস লিমিটেড, দ্রিনান অ্যাপারেলস লিমিটেড, বর্ন এন্টারপ্রাইজ ও এসএ এন্টারপ্রাইজ। এসব কোম্পানির বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। রেজিস্টার খাতায় বা ঋণ প্রস্তাবে যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে বা যে কোম্পানির যে প্যাড ব্যবহার করে ঋণের আবেদন করা হয়েছে তার সবই ভুয়া।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফাস্ট ফাইন্যান্সের ঋণের মধ্যে ৩৭৭ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই। ঋণের অর্থ ব্যবহারের বিষয়ে সুনর্দিষ্ট কোনো তথ্যও দেয়া হয়নি। এমনকি ঋণ প্রস্তাবের বিষয়ে ফাস ফাইন্যান্স কর্তৃক কোনো যাচাই-বাছাইও করেনি। ঋণের আবেদন পাড়ার পর দ্রুত ও অর্থছাড় করা হয়েছে। প্রথম দফায় পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠজনদের নামে ঋণ ছাড় করা হয়। পরে শাখা-প্রশাখা আরও বিস্তৃত হয়। ঋণের অর্থ নিয়ে একই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার নজির রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে বাণিজ্যিক বা শিল্প ঋণ নিয়ে ওই অর্থ দিয়ে শেয়ার কেনার সুযোগ নেই।
আর একই প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থে ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনারও সুযোগ নেই। অথচ পিকে হালদার ও তার স্বজনরা ফাস ফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানেরই শেয়ার কিনেছেন। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারের লঙ্ঘন।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একই ব্যক্তি একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে এত টাকা ঋণ নিল, এটা তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবিতে ধরা পড়ার কথা। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কাই করা হয়নি। যে কারণে প্রচলিত সিস্টেমে এগুলো ধরা পড়েনি।
তিনি বলেন, এখন প্রতিষ্ঠানটিকে উদ্ধার করতে হলে টাকা আদায় করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দেশের ভেতরে যে টাকা আছে, তা জব্দ করে আইনি প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক খাতে সুশাসন কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পিকে হালদার ঘনিষ্ঠ ও অনুগত ব্যক্তিদের ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রেখে জাল-জালিয়াতির ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে গোপন করেছেন। তাদের নিজ নামে শেয়ার ধারণ এবং পরে শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। একই প্রক্রিয়ায় ঋণের অর্থের গন্তব্য যাতে নিশ্চিত হওয়া না যায়, সেটা আড়াল করতে ঘন ঘন অর্থ স্থানান্তর করেছেন। একপর্যায়ে নগদ তুলে নিয়েছেন। নগদ তুলে নেয়া অর্থ দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ১৯৯৭ সালের মার্চে কর্পোরেট কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পায়। প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ১২৩ কোটি টাকা। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে মোট লিজ বা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। মোট দেনার পরিমাণ ১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডিপোজিট আছে ৯০০ কোটি টাকা। মেয়াদি আমানত ৮৯৯ কোটি টাকা। শেয়ারহোল্ডারদের অর্থের পরিমাণ ২০৫ কোটি টাকা। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারপ্রতি আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫ পয়সা। বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা করে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ফাস ফাইন্যান্সের নেয়া ঋণের পরিমাণ ৬৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৫০৭ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৬৫ কোটি টাকা।
সূত্র : যুগান্তর